ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় ২০১৭ ॥ কালের গর্ভে আরেকটি বছর

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

বিদায় ২০১৭ ॥ কালের গর্ভে আরেকটি বছর

উত্তম চক্রবর্তী ॥ এসে গেল আরও একটা নতুন বছর। নতুন আশায় বুক বেঁধে নতুন করে পথ চলার ব্রত। কিন্তু, অতীতের বীজেই যে ভবিষ্যতের বৃক্ষ- সে তো আর নতুন নয়। তাই পিছনে ফিরতেই হয়। দেখে নিতে হয়। কেমন গেল, কী মিলল, কী হারাল। আগামীতেই বা কী হবে। এই পিছিয়ে দেখাটা পেছনে যাওয়া নয়, আসলে সামনে এগোনোর তাগিদেই। আজ রাতটুকু পেরুলেই আগামীকাল পূর্বাকাশে দেখা দেবে নতুন বছরের সূর্য। দেখতে দেখতে কেটে গেল আরেকটি বছর। দিনপঞ্জিকার শেষ পাতাটি উল্টে যাবে আজ। নানা কাজের ফিরিস্তি লেখা নিত্যসঙ্গী হাতখাতাটি হয়ে পড়বে সাবেক। পরমায়ুর বৃক্ষ থেকে ঝরে যাবে একটি পাতা। মহাকাল নামের এক অন্তহীন মরুভূমির বুকে যেন এক ফোঁটা জল। আজ মহাকাল সেভাবেই মুছে দেবে বহুল আলোচিত ২০১৭ কে। ‘যেতে নাহি দিব’-এ চিরন্তন বিলাপধ্বনির ভেতরে আবহমান সূর্য একটি পুরনো দিবসকে আজ কালস্রোতের উর্মিমালায় বিলীন করে পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যাবে। বর্ষবরণের আবাহন রেখে কুয়াশামোড়া পা-ুর সূর্য আজ বিদায় নেবে মহাকালের যাত্রায়। সময় হলো খ্রিস্টীয় ২০১৭ সালকে বিদায় বলার। খ্রিস্টীয় নতুন বছর ২০১৮ সালকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত গোটা বিশ্ববাসী। সময় যায়। সময় যাওয়ার সময় বদলে যায় অনেক কিছুই। এ হলো পরম সত্য। সময় যেন এক প্রবহমান মহাসমুদ্র। কেবলই সামনের এগিয়ে যাওয়া, পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। তাই তো জীবন এত গতিময়। সেই গতির ধারাবাহিকতায় মহাকালের প্রেক্ষাপটে একটি বছর মিলিয়ে গেল। আজ আলোড়িত আন্দোলিত বর্ষ বিদায়ের দিন। জীর্ণ ঝরা পল্লবের মতো সরল রৈখিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে আজ খসে পড়বে ‘২০১৭’। মধ্যরাতে নতুন বছর ২০১৮-কে স্বাগত জানানোর উৎসবের বাঁশি বেজে উঠবে সবার প্রাণে। আগামীকাল থেকে শুরু হবে নতুন প্রত্যাশার নতুন বছর, কিন্তু যে বছরটি হারিয়ে গেল জীবন থেকে, ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে, তার সবই কি হারিয়ে যাবে? মুছে যাবে সব? না, সবকিছু মুছে যায় না। ঘটনাবহুল ২০১৭-এর ঘটনার রেশ টেনেই মানুষ এগিয়ে যাবে ২০১৮ সালের মধ্যরাত্রির পথে। অনেক ঘটনা মুছে যাবে বিস্মৃতির ধুলোয়। আবার পাওয়া না পাওয়ার অনেক ঘটনা থাকবে উজ্জ্বল হয়ে। প্রতিবারের মতো এবারও নতুন সূর্যালোকে নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে নতুন একটি বছরে যাত্রা শুরুর জন্য প্রস্তুত সবাই। অসীম প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ অপেক্ষা করছে আজ মধ্যরাতের প্রথম প্রহরের জন্য, যখন সূচিত হবে নতুন আকাক্সক্ষায় উদ্ভাসিত হবে নতুন বছর। যে বছরের খেরোখাতায় চোখ বুলালেই বয়ে যায় আনন্দ-বেদনার স্রোত। হয়তো স্মৃতি সতত সুখের নয়। হিসেবের খেরোখাতায় জমে আছে অনেক বিয়োগ-ব্যথা, হারানোর কান্না, নানা গ্লানি আর মালিন্যের দাগ। বছরজুড়ে অপ্রত্যাশিত নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় আমাদের মন ভীষণ ভারাক্রান্ত, তবু নিরাশার গভীর থেকে ফুঠে ওঠে বিপুল আশার আলো, ধ্বংসস্তূপ থেকে ফোটে নবতর জীবনের ফুল। আমরা আবারও মেতে উঠি সৃষ্টিসুখের উল্লাসে, বৈরী সময়কে মারিয়ে এসে গেয়ে উঠি জীবনের জয়গান। আজ রাত পেরুলেই কাল পূর্বকাশে উঠবে যে নতুন সূর্য- সে সূর্য নতুন বছরের। নতুন আশায় বুক বেঁধে আরও একটি নতুন বছরের দিনলিপি পড়ে থাকবে পেছনে। নতুন বছরে নতুন সূর্যের অসীম প্রতীক্ষা মানুষের। উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়েই মানুষ স্বাগত জানাবে ইংরেজি নতুন বছর ২০১৮ সালকে। ইংরেজি পঞ্জিকার সার্বজনীনতায় কাল বিশ্ববাসীও মেতে উঠবে নতুন বছরের আগমনী আনন্দ-উল্লাসে। স্বপ্ন আর দিনবদলের অপরিমেয় প্রত্যাশার রক্তিম আলোয় উদ্ভাসিত শুভ নববর্ষ ২০১৮। ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’- উচ্চারিত হবে শত কোটি মানুষের কণ্ঠে। বহু ঘটনার জন্ম দিয়ে মহাকালের পরিক্রমায় বিদায় নিল আরও একটি বছর। মিথ্যার কুহেলিকা ভেদ করে সত্য প্রতিষ্ঠিত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভূতপূর্ব পুনর্জাগরণ ঘটিয়ে চিরকালের জন্য আজ হারিয়ে যাচ্ছে ঘটনাবহুল ২০১৭ সাল। বাংলাদেশের ৪৬ বছরের অনেক ইতিহাস বদলে দিয়েছে বিদায়ী বছরটি। সূচনা করেছে জাতীয় জীবনে ও রাজনীতির ইতিহাসে এক অভিনব অধ্যায়ের। যে ভয়াল জঙ্গী সন্ত্রাসের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সারাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার সুগভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল দু’বছর আগে থেকে, শেষ পর্যন্ত সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত আর ভয়াল জঙ্গীবাদকে শক্তহাতে দমন করে বিপুল উন্নয়ন আর জনমনে শান্তি-স্বস্তি দিয়েই বিদায় নিল ২০১৭ সাল। অনেক ঘটনা, অঘটন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, চড়াই-উৎরাই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে আজ হারিয়ে যাচ্ছে এ বছরটি। যে প্রত্যাশার বিশালতা নিয়ে ২০১৭ সালের প্রথম দিনটি বরণ করা হয়েছিল, সেই প্রত্যাশার সব কি পূরণ হয়েছে। হয়নি। কিন্তু যা পাওয়া গেছে তাও কম নয়। নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র শক্তভাবে মোকাবেলা করে সৃষ্টির জাগরণে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনায় আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দুর্নীতি-সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের দেশের কালো তকমা মুছে ফেলে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে প্রমত্তা পদ্মা সেতুর বুকচিরে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণযজ্ঞ চলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গেছে রাজধানীতে মেট্রোরেল নির্মাণ। দেশের ইতিহাসে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সরকারের দক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনায় বাংলাদেশ পেয়েছে বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তাই বিদায়ী বছরে কৃষি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ সার্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণে বলা যায়, আশা-নিরাশার, আনন্দ-বেদনার দোলাচলে যথেষ্ট বাক্সময় ২০১৭। নতুন বছর ২০১৮ সালের অনেক প্রত্যাশার বীজও বুনে গেছে বিদায়ী ২০১৭। দেখতে দেখতে চলে গেল আরেকটি বছর। শেষলগ্নে এসে হাসি-কান্না, পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত সবাই। রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে বিদায়ী বছরটি কেমন গেল, দেশের সব মানুষের এক জবাব- ২০১৭ সাল ছিল নিস্তরঙ্গ রাজনীতির বছর। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কার্যত পুরো বছরটিই কেটেছে শাস্তি, স্বস্তি ও অগ্রগতির মিছিলে। ২০১৫ সালের মতো দেশবাসীকে রাজনীতির নামে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ ও পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার নৃশংসতার ঘটনা বিদায়ী ২০১৭ সালে দেখতে হয়নি। বিদায়ী বছরে সরকারের সাফল্যে বা অর্জনের কমতি ছিল না। একের পর এক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিজয়, সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, দেশীয় অর্থনীতি মজবুত, উপচেপড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিও। বিদায়ী বছরে রাজপথে ছিল না সরকারবিরোধী আন্দোলন কিংবা সংঘাত-সাংঘর্ষিক রাজনীতি। রাজনৈতিক প্রধান প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক সঙ্কটে ফেলার কৃতিত্বও সরকারের ঝুলিতে। পুরো বছরেই রাজনীতির লাগাম ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানরাও বাংলাদেশে অভূতপূর্ব উন্নয়নের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন বিদায়ী বছর জুড়েই। ২০১৭ সালটি কেমন গেল তার সার্বিক পর্যালোচনায় এক কথায় বলা যায়, কিছু ঘটনা ছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উন্নয়নের নবযাত্রার এক বছর পূর্ণ হলো। বিদায়ী এই এক বছরে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতায় পড়তে হয়নি সরকারকে। সংঘাতময় আন্দোলনে যাওয়ার সুযোগ পায়নি বিরোধী দলগুলো। প্রধান বিরোধী দলসহ কোন রাজনৈতিক দলই কোন হরতাল পালন করেনি। বিএনপি-জামায়াতের কর্মসূচীহীন নিস্তরঙ্গ রাজনীতি সত্ত্বেও ২০১৭ সালে বিচ্ছিন্নভাবে সংখ্যালঘু গ্রামে হামলা, নানা জঙ্গীবাদী কর্মকা-, পদত্যাগী প্রধান বিচারপতির কিছু কর্মকা-কে ঘিরে সর্বোচ্চ আদালত নিয়ে টানাপোড়েন, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ নানা ইস্যুতে সরকারকে নানাভাবেই বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। কিন্তু পুরোটা বছরই সুনিপুণ হাতে সবকিছু সামলিয়ে শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে মানবতা ও উন্নয়নের নেত্রী হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। বিদায়ী বছরে ঘুরেফিরেই আলোচনার শীর্ষে ছিল রোহিঙ্গা ইস্যু ॥ বিদায়ী বছরে রাজনীতির মাঠ শান্ত থাকলেও ১২ মাসেই আলোচনার শীর্ষে ছিল রোহিঙ্গা ইস্যু। ২০১৭ সাল শুরু হয়েছিল আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ঢল সামলানো এবং তাদেরসহ সব রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে। সেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো তো দূরের কথা, উল্টো নতুন করে যোগ হয়েছে আরও প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে মিয়ানমারের প্রায় ১০ লক্ষাধিক নাগরিককে সম্পূর্ণ ‘মানবিক কারণে’ বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে সারাবিশ্বকেই তাক লাগিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন থেকে শুরু করে পুরো বছরই এই ইস্যুটি ছিল আলোচনার শীর্ষে এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ ইস্যুতে শুধু বাংলাদেশের পাশে এসেই দাঁড়াননি, নানা অভিধানে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। বিদায়ী বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শুরু হওয়া নতুন করে নিধনযজ্ঞের কারণে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বড় অংশই বাংলাদেশে চলে আসে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা এরই মধ্যে ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। তাদের টেকসই প্রত্যাবাসনই এখন বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবসন শুরুর লক্ষ্য ঠিক করা হলেও রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টি হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক। বর্তমান বাস্তবতায় রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা ছাড়া ফিরে যেতে কতটা আগ্রহী হবে, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অন্যদিকে মিয়ানমারও রোহিঙ্গাদের ফেরাতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে মোটেও আন্তরিক নয়। রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়ায় তাদের যাচাই-বাছাই করা হবে, তাও বেশ কঠিন। এর পরও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। তবে কূটনৈতিকভাবে এ সংকটের টেকসই সমাধান আনতে না পারলে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের বোঝা বাংলাদেশকেই টানতে হবে। দিবস বৃত্তে আওয়ামী লীগ, মামলা দৌড়ে বিএনপি ॥ অনেকটা স্বস্তিতেই বছর পার করেছে আওয়ামী লীগ। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতার চতুর্থ বছরে বিরোধী পক্ষের আন্দোলন কর্মসূচী না থাকায় দলীয় ও দিবসকেন্দ্রিক কর্মসূচী পালনের বৃত্তেই বন্দী ছিল দলটির কার্যক্রম। অন্যদিকে মামলার তাড়ায়ই বছর পার করেছে বিএনপি। দলটির শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের একই পরিস্থিতি। নির্বাচন ঠেকানো ও সরকার উৎখাতের নামে বিএনপি-জামায়াতের আগুন সন্ত্রাস, পেট্রোলবোমায় শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা, ভয়াল নাশকতার মামলায় সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন তাদের গন্তব্য ছিল আদালত। অসংখ্য মামলায় হাজিরাকে কেন্দ্র করে বছরের বেশির ভাগ সময় কেটেছে আদালতের বারান্দায়। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমে আওয়ামী লীগ নেতাদের তৎপরতা ছিল বিদায়ী বছরে উল্লেখ করার মতো। বিদায়ী বছরটি স্বস্তিতে পার করলেও আসছে বছর আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েই আসছে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন এবং দলের পক্ষে বিজয় ধরে রাখার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন বছরটি হবে আওয়ামী লীগের অগ্নিপরীক্ষা। এজন্য বছরের শুরু থেকেই নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মকা- জোরদার করতে পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি। এছাড়া আগামী নির্বাচন কি প্রক্রিয়ায় হবে, কার অধীনে হবে- এ নিয়ে নতুন বছরে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ানোর চেষ্টা করা হতে পারে। সে কারণে নতুন বছরের শুরু থেকেই রাজনৈতিক মাঠ দখলের পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে দলটির নীতি-নির্ধারকরা। বিরোধী পক্ষের বড় ধরনের আন্দোলনের কর্মসূচী না থাকায় বিদায়ী বছরে দলীয় ও দিবস কেন্দ্রিক কর্মসূচীতেই ব্যস্ত ছিল ক্ষমতাসীন দলটি। দিবস ভিত্তিক কর্মসূচীতে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। এছাড়া দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদ ও সভাপতিম-লীর বৈঠকও হয়েছে নিয়মিত। এসব বৈঠকের বেশিরভাগই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবনে। দলীয় কর্মসূচীর মধ্যে সদস্য সংগ্রহ, বর্ধিত সভা, তৃণমূলের কাউন্সিলসহ বেশি কিছু কর্মসূচী পালন করা হয় বছর জুড়েই। এদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বছর জুড়েই সংলাপ আয়োজনে বিরোধী পক্ষের দাবির প্রেক্ষিতে শুরু থেকেই কৌশলী ভূমিকায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। বর্তমান সংবিধানের অধীনে আগামী নির্বাচন হবে এমন শক্ত অবস্থানে রয়েছে দলটি। বর্তমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে। এমনটি ধরে নিয়েই নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে তারা। এ ইস্যুতে আলোচনা ও সংলাপ বিষয়টি বরাবরই নাকচ করে আসছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, কোন্ দল নির্বাচন করবে, কোন্ দল নির্বাচন করবে না- এটা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সংবিধান অনুযায়ীই আগামী নির্বাচন হবে এটিও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তবে বিদায়ী বছরে সারাদেশে সৃষ্ট কোন্দল-বিবাদ মেটাতে পারেনি দলটি। এখন সারাদেশের প্রতিটি নির্বাচনী আসনেই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ এখন আওয়ামী লীগ। শুধুমাত্র দলীয় বিভেদের কারণেই বিশাল ভোটের ব্যবধানে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। নির্বাচনে বড় ব্যবধানে পরাজয় চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে দলটির নেতাদের কপালে। দলটির মাঠের নেতারাও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, আগামী নির্বাচনের আগেই দলের কোন্দল, দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সাংগঠনিকভাবে দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যের বন্ধতে বাঁধতে না পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনেও বড় ধরনের মাশুল গুনতে হতে পারে আওয়ামী লীগকে। অন্যদিকে সাংগঠনিক পুনর্গঠন, আন্দোলনের কর্মসূচী প্রণয়নসহ সার্বিকভাবে অগোছালো বছর পার করেছে বিএনপি। এক কথায় বিদায়ী বছরেও সাংগঠনিকভাবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে রাজপথের এই বিরোধী দলটি। এমনকি এতিমের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়েরকৃত দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে প্রতিনিয়ত হাজিরা দিতে হচ্ছে আদালতে। মামলাটি শেষ পর্যায়ে আসায় বিএনপির নেতারাও সন্দিহান, মামলার রায়ে খালেদা জিয়া দোষী সাব্যস্ত হলে আগামী নির্বাচন থেকে ছিটকে যাবেন। তখন কী হবে? বিএনপি নির্বাচনে যাবে, নাকি বিগত নির্বাচনের মতো ফের বর্জনের দিকে যাবে- এ নিয়ে গোলক ধাঁধায় রয়েছে দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে সোচ্চার থাকলেও সে দাবি আদায়ে বিএনপি নিতে পারেনি কার্যকর পদক্ষেপ। বিএনপির নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ফর্মুলাটিও রয়ে গেছে অঘোষিত। বক্তৃতা-বিবৃতিতে নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে অনড় থাকলেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বিএনপির অবস্থান এখন কার্যত নির্বাচনমুখী। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য ও দলীয় কর্মসূচীর মধ্যে ফুটে উঠেছে নির্বাচনমুখী মনোভাব। সরকারকে চাপের মধ্যে রেখে তুলনামূলক অনুকূল পরিস্থিতি পেলেই নির্বাচনে যাওয়ার মনোভাব পোষণ করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সব মহল থেকে জামায়াতকে পরিত্যাগ করার দাবি জানানো হলেও বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া স্বাধীনতাবিরোধী এই দলকে নির্বাচনী জোটে রেখেই ভোটযুদ্ধে নামার ব্যাপারে এখনও অনড় রয়েছেন। আলোচিত-বাংলাদেশ দেশে-বিদেশে ॥ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, রোহিঙ্গা সঙ্কটে মানবতা প্রদর্শনসহ নানা ইস্যুতে সফলতার কারণে বিদায়ী বছরজুড়ে বিশ্বে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে বাংলাদেশ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদার জোগান ঠিক রেখে অব্যাহত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, কৃষি ও বিদ্যুত খাতের উন্নয়ন, রোহিঙ্গা সঙ্কটে মানবতার দৃষ্টান্ত, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ দমন, ক্রিকেটারদের সাফল্যে, পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান অগ্রগতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সততা ও পরিশ্রমের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সফল আয়োজনসহ নানা কারণে বিদায়ী বছরে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর কেড়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব গণমাধ্যমেও এসব অর্জনের খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। বছরজুড়েই বিশ্ব অঙ্গনে আলোচিত ছিল বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন শুধু গল্প নয়, বাস্তবতা। ১৯৭১ সালে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আর ৭০ শতাংশ দারিদ্র্যের বোঝা নিয়ে পথ চলা শুরু করে বাংলাদেশ। এমন দৈন্যদশা ঘুচিয়ে এখন প্রবৃদ্ধির চাকা ঘুরছে ৭ শতাংশের ওপরে। আর দারিদ্র্যের হার কমে ২৩ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে, আর চরম দারিদ্র্যের হার ১২ দমমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে। বাজেটের আকার ৪ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। রিজার্ভ রয়েছে প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলারে, প্রবাসে কর্মী রয়েছে ১ কোটির বেশি, রেমিটেন্স ১৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। রফতানি আয় বেড়ে হয়েছে ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশ প্রায় সব সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন এগিয়ে যাওয়া মধ্যম আয় ও উন্নত দেশের দিকে। ক্রমাগত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্যের হার কমে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী বিশেষভাবে পরিচিত পেয়েছে বাংলাদেশ। আর এসব উন্নয়নের ফলস্বরূপ চলতি বছর দ্য ইকোনমিস্টের জরিপে ‘বর্ষসেরা দেশ’ বা ‘কান্ট্রি অব দি ইয়ার’ নির্বাচিত হওয়ার খুব কাছাকাছি ছিল বাংলাদেশ। মনোনয়নের প্রস্তাবনায় উঠে এসেছিল নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জায়গা দেয়ার বিষয়টিও। ২০১৩ সাল থেকে এই পুরস্কার ঘোষণা করে আসছে দ্য ইকোনমিস্ট। এই তালিকায় সেই দেশটিই সেরা নির্বাচিত হয় যারা বিগত ১২ মাসে লক্ষ্য করার মতো পরিবর্তন এনেছে এবং বিশ্বকে আরও আলোকিত করেছে। তবে তালিকায় আগে থাকলেও ফ্রান্সকে বর্ষসেরা দেশ হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী এই ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশটি যদি প্রকাশ্যে উগ্রপন্থীদের আতঙ্ক ছড়ানোর সুযোগ না দিত- তাহলে হয়তো বাংলাদেশই সেরা নির্বাচিত হতো। ষোড়শ সংশোধনী ও প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে তোলপাড় ॥ বিদায়ী বছরে রাজনীতির মাঠ শান্ত থাকলেও সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে বছরজুড়ে তোলপাড় হয়েছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও প্রধান বিচারপতির পদত্যাগকে ঘিরে বছর জুড়ে চলে তুমুল বিতর্ক। সর্বত্র ছিল আলোচনা-পর্যালোচনা। রাজনৈতিক ও বিচারাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক উত্তাপ। সর্বশেষ তিন মাসের নাটকীয় নানা ঘটনার পর পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। বিচারক অপসারণ নিয়ে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তাকে নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, পদত্যাগের মাধ্যমে তার ইতি ঘটে। এ রায়ে প্রধান বিচারপতির দেয়া বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিলেন মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগেরও দাবি তোলেন। এরই মাঝে পদত্যাগকারী প্রধান বিচারপতির বেশ কিছু দুর্নীতির কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে আপীল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা এস কে সিনহার সঙ্গে এজলাসে বসতে অস্বীকৃতি জানান। ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেই ১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের কাছে চিঠি দিয়ে এক মাসের ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর সিঙ্গাপুর থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন এস কে সিনহা। বিদায়ী বছরে অনেকেই নিয়েছেন চিরবিদায় ॥ বিদায়ী বছরটি প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির দোলাচলে নিয়েছে অনেক কিছু। চিরবিদায় নিয়েছেন অনেকেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ ২৫ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপি চিরবিদায় নিয়েছেন বিদায়ী বছরে। প্রবীণ রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক, সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা, খান টিপু সুলতান, বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ার, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জনপ্রিয় মেয়র আনিসুল হক চিরবিদায় নিয়েছেন আমাদের কাছ থেকে। এছাড়াও কিংবদন্তী চলচ্চিত্র অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক, প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার, বারী সিদ্দিকী, সুরকার লাকী আখন্দ, অভিনেতা নাজমুল হুদা বাচ্চু, মিজু আহমেদসহ অনেকেই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বিদায়ী বছরে অনেকেই চিরবিদায় নিয়েছেন। কিন্তু দিয়েছেও কি খুব কম? এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ২০১৭ অনেক কারণেই স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। মহাকালের আবর্তে হারিয়ে গেলেও বিদায়ী বছরটি দেশের মানুষের মনে দাগ কেটে থাকবে বহুকাল, বহু বছর। পাল্টে দিয়েছে অনেক ইতিহাসও। সব মিলিয়ে বিদায়ী বছরটি ছিল বৈচিত্র্যময়। আজকের গোধূলি বেলায় রক্তিম সূর্য অস্ত যাওয়ার মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাবে ঘটনাবহুল এ বছরটি। এখন নতুন বছর আর নতুন সূর্যের অপেক্ষায় দেশবাসী। অপেক্ষা কেবল মানুষের নিরাপত্তা, শান্তি, স্বস্তি, জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসমুক্ত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণ এবং সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির দেশ গড়ার। ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দলীয় জোট সরকারের কাছে এ প্রত্যাশা রেখেই আগামীকাল সোমবার থেকে নতুন বছরে, নতুন জীবনে যাত্রা করবে এ দেশের মানুষ। কাল শুরু হবে আরও একটি নতুন বছর ২০১৮। বিদায় ২০১৭।
×