ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদা জিয়ার জন্য দুঃসংবাদই বটে!

প্রকাশিত: ০৩:২৯, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭

খালেদা জিয়ার জন্য দুঃসংবাদই বটে!

সম্প্রতি সৌদি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিদেশে টাকা পাচার, দুর্নীতি এবং ঘুষ গ্রহণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার যে তথ্য বা খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বেগম জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের ওপর অদূর ভবিষ্যতে এক প্রকার কালো ছায়া যে নেমে আসবে এতে কোন সন্দেহই নেই! সৌদি কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত তথ্যমতে, বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পুত্রদ্বয় ঘুষ ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মধ্যে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সৌদি আরবে বিশালাকৃতির দোকানপাট ক্রয় এবং অবকাঠামোগত খাতে বিনিয়োগ করেছেন। খালেদা জিয়া ছাড়াও ওই প্রকাশিত খবরে আরও ১৯ ব্যক্তির নাম পাওয়া যাচ্ছে। এদের মধ্যে নামকরা যারা তারা হলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল হারিরি। ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে এক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার নাম প্রকাশিত হওয়াটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে বৈকি! কেন-না, এর সঙ্গে সরাসরি ভারতের জন্য রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি জড়িত। তাই এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখাটাও জরুরী। সৌদি কর্তৃপক্ষ অবশ্যি এ বিষয়ে তাদের তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আর তদন্ত যতই এগুচ্ছে, ততই খালেদার প্রয়াত পুত্র আরাফাত বা কোকোর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের তথ্য বেরিয়ে আসছে। উল্লেখ্য, আরাফাত ২০১৫ সালে মৃত্যুবরণ করে। জানা যায় যে, বিপুল পরিমাণ অর্থ নিজ দেশ থেকে আত্মসাতের পর আরাফাত তা সৌদি আরবে বিনিয়োগ করেছে। সে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল এবং ফেরারি হিসেবে দেশের বাইরে পলাতক অবস্থায় জীবনযাপন করছিল। অন্যদিকে, তার বড় ভাই তারেক রহমান দেশ থেকে আত্মসাতকৃত অগণিত অর্থ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে লুণ্ঠিত অর্থের এক বিরাট অংশ সৌদি আরব ও পশ্চিম এশিয়ার কিছু কিছু দেশে বিনিয়োগ করেছে বলে জানা যায়। এই অপকর্মের গোঁসাই বর্তমানে দীর্ঘদিন ধরে ইংল্যান্ডে পলাতক ব্যক্তি হিসেবে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। ইতোপূর্বে, তথ্যপ্রমাণাদিসহ তারেকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ছিল যে, দুরভিসন্ধিমূলক আর্থিক লেনদেন, বিদেশে অর্থ পাচার আর বিনিয়োগ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতের নিরাপত্তা-বিষয়ক স্বার্থের শত্রু মাফিয়া-ডনদের সঙ্গে তারেকের এতদবিষয়ক সংশ্রব ও ওঠাবসা ভারতের জন্য খানিক দুশ্চিন্তার ব্যাপার নিশ্চয়ই! এসব খতরনক মাফিয়া ডন ভারতে ওয়ান্টেড ব্যক্তি এবং বর্তমানে পলাতক। এ কথা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হয় না যে, পাকিস্তানী চক্রান্তের দোসর হিসেবে তারেক এসব ডনের (যেমন দাউদ ইব্রাহিম) সঙ্গে ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পাকিস্তানী চক্রান্তমূলক এজেন্ডা বাস্তবায়নের ব্যাপারে সে পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে চলেছে বলে তার বিরুদ্ধে ভারতের পক্ষ থেকে রয়েছে শক্ত অভিযোগ। ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে বিঘœ ঘটানোই যে এই চক্রান্তের মূল উদ্দেশ্য তা তো বলাই বাহুল্য। ২০০১ থেকে ২০০৬ অবধি বিএনপি-জামায়াত যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তখন থেকেই তারেক এই চক্রান্তের একজন সারথী হয়ে ওঠে। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার সখ্য প্রধানত ভারতের বিরুদ্ধে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায় থেকে উৎসারিত। ভারতকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করাই এর লক্ষ্য। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী সৌদি আরবের সঙ্গে গভীরতর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সুবাদে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইসলামের তথা জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের গোড়াপত্তন করে। বাংলাদেশকে একটি গোড়া, ধর্মান্ধ এবং ভারতবিদ্বেষী রাষ্ট্রে পরিণত করার গভীর চক্রান্ত চালিয়ে যায়। আর এ জন্য তারা বিএনপির সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় সারাদেশে অসংখ্য সন্ত্রাসী ও ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠন গড়ে তোলে। এদিকে, খালেদা জিয়ার শাসনামলে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিপুল বিনিয়োগ মূলত ভারতের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দেয়ার লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছে। আর এতে করে ভারতের ভেতরে অবস্থানরত চরমপন্থীরা মানসিক ও আর্থিকভাবে দারুণ শক্তি অর্জন করে। স্মর্তব্য যে, ওই আমলেই ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপের নেতা ও সদস্যরা বাংলাদেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় লাভ করছিল অনায়াসেই। মোদ্দাকথা, প্রথম পর্যায়ে ১৯৯১-’৯৬ সালের বিএনপি এবং বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে এরা যারপরনাই সহযোগিতা পায়। তখন ভারতের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ যেমনÑ উলফা, এসসিসিএন (আইএম) পিএলএ এবং অন্যান্য মণিপুরী সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশকে তাদের জন্য অভয়ারণ্য হিসেবে পেয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর সরাসরি তত্ত্বাবধানে উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া নানান ছদ্মনামে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতেই আত্মগোপন করে থাকতে পেরেছিল। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ও গোয়েন্দারা তাদের ভারতবিরোধী তৎপরতা এবং বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ বিষয়ক তথ্যাদি ও ছবি বহুবার বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কাছে তখন উপস্থাপন করা সত্ত্বেও তারা কোনই কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। কী করে নেবে? কেননা, তারাই যে পাকিস্তানের নীলনক্সা বাস্তবায়নকল্পে এ ব্যাপারে যাবতীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছিল! তাই ওইসব তথ্য ও ছবির ব্যাপারে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বরাবরই না জানার ভান করে যাচ্ছিল। এই পাকিস্তানী নীলনক্সার পালের গোদা হিসেবে তখন তারেক রহমান অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে ফিরছিল বলে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন। সম্ভবত সৌদি আরবে বিনিয়োগকৃত অর্থের লভ্যাংশ থেকে ভারতবিরোধী তৎপরতার অর্থ যোগান দেয়া হতো আর একই সঙ্গে মুদ্রা পাচারও চলত দেদার। বর্তমানে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের রাজপরিবারের দুর্নীতিবাজ সদস্য এবং অন্যান্যের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযানে নেমেছেন তাতে খালেদা-তারেক চক্রসহ দেশী-বিদেশী বেশকিছু দুর্নীতিবাজের কার্যকীর্তির পরিচয় পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। বর্তমান এই বাস্তবতার আলোকে ভারত সরকারের উচিত হবে ভারতের আর্কাইভে রক্ষিত খালেদা-তারেকের আমলে ভারতবিরোধী তৎপরতার ইন্ধন যোগানোর যেসব আলামত আছে, তা গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। এর মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়ায় বিনিয়োগকৃত খালেদা-তারেকের অর্থ ভারতবিরোধী চরমপন্থীদের হাতে কিভাবে যাচ্ছে তা উদ্ঘাটন করা এবং সৌদি কর্তৃপক্ষকে সে বিষয়ে অবহিত করা। এতে সৌদি আরবে বর্তমানে দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান চলছে তাতে সহায়তা করা হবে এবং সৌদি-ভারত সম্পর্কও এতে করে লাভবান হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার খালেদা-তারেকের অর্থ পাচার ও বিদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে যে তদন্ত ও অনুসন্ধান করে চলেছে তাতে শক্তি যোগানো হবে। সম্প্রতি শেখ হাসিনা খালেদা-তারেকের এই অর্থ পাচারের বিষয়টি উদ্ঘাটনের ব্যাপারে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ঘোষণা করেছেন। এতে করে ভারতীয় বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বা পেশাদারিত্বপূর্ণ সহায়তা বাংলাদেশ সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে নিশ্চয়ই। ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক শুধু আরও দৃঢ়বদ্ধই হবে না, বেগম জিয়ার দুর্নীতিজনিত দুর্বলতাও জাতির কাছে খোলাসা হবে। লক্ষণীয় যে, সাম্প্রতিক সৌদি ও কানাডার মিডিয়ায় খালেদা-তারেকের এই অর্থপাচার ও দুর্নীতির খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের জন্য এটাই এক মোক্ষম সময়, যাকে কিনা কাজে লাগিয়ে খালেদা জিয়াদের হম্বিতম্বি, মিথ্যাচার ও গলাবাজি স্তব্ধ করে দেয়া যায়। আর তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারের যেমন লাভ, তেমনি লাভ এই দেশ দুটির জনগণের। (এশিয়ান এজ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ অবলম্বনে) লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×