ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম -অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম -অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম

আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু পথহারা মানুষকে সত্য-সুন্দর সৎ পথের দিশা দেবার জন্য হিদায়াতের জ্যোতিতে মানুষকে জ্যোতির্ময় করে তুলবার জন্য, অন্ধকার আর অজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত মানুষকে উদ্ধার করে আলোর পথে পরিচালিত করবার জন্য যুগে যুগে মনুষ্য অধ্যুষিত পৃথিবী নামক এই গ্রহে বহু নবী-রসূল প্রেরণ করেছেন। হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম তেমনি একজন নবী যাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁর কওম বনী ইসরাঈলকে হিদায়াত দান করবার জন্য আমাদের প্রিয় নবী সরওয়ারে কায়েনাত সাইয়েদুল মুরসালীন খাতামুন্নাবীয়ীন হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের প্রায় ৫৭০ বছর পূর্বে। অন্য নবী-রসূলগণের মতো হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামও তাঁর কওম বনী ইসরাইলকে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আদর্শ অনুসরণ করবার নির্দেশ দিয়ে যান। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : স্মরণ করো, ঈসা ইবনে র্মাইয়াম বলেছিল : হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের নিকট এসেছি আল্লাহ্র রসূল হয়ে এবং আমার পূর্ব থেকে তোমাদের কাছে যে তওরাত রয়েছে আমি তার সত্যায়নকারী এবং আমার পরে আহমদ নামে যে রসূল আসবেন আমি তাঁর সুসংবাদদাতা। (সূরা সফ্ফ: আয়াত ৬)। মূল বাইবেল (ইঞ্জিল)-এর বহু পরিমার্জন, সংযোজন, বিয়োজন, ভাষান্তর হওয়া সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্য করি তাতেও জেসাস ক্রাইস্ট যে, শেষ নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আগমনের আগাম খবর দিয়েছিলেন তা রয়েছে। জেসাস ক্রাইস্ট বলেন : ও ডরষষ চৎধু ঋধঃযবৎ, ধহফ ঐব ঝযধষষ মরাব ুড়ঁৎ ঢ়বৎরয়ষুঃড়ং (চধৎধ পষবঃব, পড়সভড়ৎঃবৎ, চধৎধপধষড়হ), ঃযধঃ যব সধু ধনরফব রিঃয ুড়ঁ ভড়ৎ বাবৎ- আমি স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করব এবং তিনি তোমাদের জন্য আরেকজন পেরিক্লাইটস (প্যারাক্লিট, কম্ফোটার, প্যারাক্যালন) প্রেরণ করবেন যেনো তিনি তোমাদের সঙ্গে চিরকাল থাকতে পারেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ইঞ্জিন কিতাব হিব্রু ভাষায় অবতীর্ণ হলেও অনুবাদে অনুবাদে এর অনেক শব্দই আসলত্ব খুইয়ে বসেছে। প্রথমে এটা অনূদিত হয় গ্রীক ভাষায়, তারপর লাতিনে, তারপর ইংরেজীতে। ভাষান্তরের এই চলমানতা এবং মূল গ্রন্থের মূল পাঠাংশের অনুপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রেও এর মূল আবেদন বিস্মৃত করে ফেলেছে। তবুও লক্ষ্য করা যায় আরবী আহমদ শব্দটির যে ভাষান্তর করা হয়েছে তা অনেকটা এর অর্থ বহন করে, যেমন পেরিক্লাইটস শব্দের অর্থ মহিমান্বিত প্রশংসিত। আর আহমদ শব্দের অর্থ উচ্চ প্রশংসিত। হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম বিনা পিতায় বিবি মরিয়মের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর এই জন্ম আল্লাহ জাল্লা শানুহুর কুদরতের এক অপূর্ব নিদর্শন। হযরত আদম আলায়হিস্ সালামও জন্মগ্রহণ করেন বিনা পিতা-মাতায় আর হযরত হাওয়া আলায়হিস সালাম হযরত আদমের বাম পাঁজর থেকে। হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামের নানাজানের নাম ইমরান ইবনে মাসান। এ ইমরানের স্ত্রীর নাম হান্না বিনতে ফাকুযার। হান্্নার অনেক বয়স হওয়া সত্ত্বেও কোন সন্তান না হওয়ায় দারুণ দুঃখ নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। একদিন একটি পাখি তার ছানাকে খাওয়াচ্ছে দেখে হান্নার মনে সন্তান লাভের আশা তীব্রতর হয়ে ওঠে। তিনি আল্লাহর কাছে একটি সন্তান লাভের জন্য দু’আ করে মানত করেন যে, আমার একটি সন্তান হলে আমি তাকে ইবাদত গাহের (বায়তুল মুকাদ্দিস) সেবায় উৎসর্গ করব। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : স্মরণ করো, যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিলো : হে আমার রব্, আমার গর্ভে যা আছে তা একান্ত তোমার জন্য উৎসর্গ করলাম, সুতরাং তুমি আমার নিকট হতে তা কবুল করো, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। অতঃপর যখন সে তাকে (কন্যা) প্রসব করল তখন সে বলল: হে আমার রব্ আমি কন্যা প্রসব করেছি। সে যা প্রসব করেছে আল্লাহ্ তা সম্যক অবগত। আর ছেলে তো এই মেয়ের মতো নয়, আমি তার নাম রেখেছি মারইয়াম এবং অভিশপ্ত শয়তান হতে তার এবং তার বংশধরদের জন্য শরণ নিচ্ছি। অতঃপর তার রব্ তাকে কবুল করলেন। (সূরা আলে ইমরান: আয়াত ৩৫-৩৭)। হযরত মারইয়াম জন্মগ্রহণ করেন খ্রিস্টপূর্ব ১৬ অব্দে। তিনি যখন মাতৃগর্ভে তখন তাঁর পিতা ‘ইমরান ইন্তেকাল করেন। পিতৃহারা মারইয়ামের লালন-পালনের অভিভাবকত্ব কে গ্রহণ করবে এ নিয়ে বাদানুবাদ উঠল। শেষ পর্যন্ত ইয়াহুদী কাহিন (যাজক)-দের আপত্তির মুখে কলম বা তীর ছুড়ে লটারী করা হলে তাঁর খালু হযরত যাকারিয়া আলায়হিস্ সালামের ওপর অভিভাকত্বের ভার পড়ল। মারইয়ামের মাতার মানত অনুযায়ী মারইয়ামকে ইবাদত গাহের সেবায় নিয়োজিত করা হলো যখন তিনি কৈশোর বয়সে উপনীত হলেন। তিনি সর্বক্ষণ বায়তুল মুকাদ্দাসের একটি নির্জন প্রকোষ্ঠে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। হযরত যাকারিয়া আলায়হিস্ সালামের স্ত্রী আল-ইয়শ (ইলিশাবেত্ বা ইলিযাবেথ) তাঁর সঙ্গে রাত্রি যাপন করতেন। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : যখন সে (মারইয়াম) তার পরিবারবর্গ হতে পৃথক হয়ে নিরালায় পূর্বদিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল, অতঃপর তাদের থেকে সে পর্দা (হিজাব) করল। (সূরা মারইয়াম আয়াত ১৬-১৭)। একদিন আল্লাহর ফেরেশতা হযরত জিব্রাঈল ‘আলায়হিস সালাম অবতরণ করে হযরত মারইয়াম আলায়হাস্ সালামকে একটি পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলেন। এই সংবাদ শুনে কুমারী মারইয়াম বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : মারইয়াম বলল : কেমন করে আমার পুত্র হবে যখন আমাকে কোন পুরুষই স্পর্শ করেনি আর আমি তো ব্যাভিচারিণীও নই? সে (ফেরেশতা জিবরাঈল) বলল: এমনিতেই হবে। তোমার রব্ বলেছেন, হুয়া আলাইয়্যা হায়ইউনুন, ওয়া লিনাজ আল্লাহু আয়াতাল লিন্নাসি ওয়া রহমাতাম্ মিননা- এটা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং আমি ওকে এজন্য সৃষ্টি করব যেন সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমার নিকট থেকে এক অনুগ্রহ। (সূরা র্মাইয়াম : আয়াত ২০-২১), স্মরণ কর, যখন ফেরেশতারা বলল : হে মারইয়াম! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাকে তার পক্ষ থেকে একটি পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছেন। তার নাম মসীহ্ ঈসা ইব্নে র্মাইয়াম। সে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত হবে এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্তদের অন্যতম হবে। সে দোলনায় থাকা অবস্থায় মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। পরিণত বয়সেও এবং সে পুণ্যবানদের একজন। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ৪৫-৪৬)। চলবে... লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মদ (সা.)
×