ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রেকর্ডসংখ্যক কর্মীর বিদেশে চাকরি, সবচেয়ে বেশি সৌদিতে

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭

রেকর্ডসংখ্যক কর্মীর বিদেশে চাকরি, সবচেয়ে বেশি সৌদিতে

ফিরোজ মান্না ॥ বছর জুড়েই শ্রমবাজার নানা চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। অনেক বাজার খুলেছে, আবার অনেক বাজার বন্ধ হয়েছে। মন্ত্রণালয় এ বছরেই নতুন পুরাতন কয়েকটি বাজারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষর করেছে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বাজার প্রবাহিত হলেও এ বছর রেকর্ডসংখ্যক কর্মী বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছেন। উল্টো দিকে রেকর্ডসংখ্যক কর্মী দেশেও ফিরেছেন। মন্ত্রণালয় বলছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ২৮ শতাংশ বেশি কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন সৌদি আরবে। এরপরেই জর্দান ও ওমানে। কর্মীদের যাতে দেশে ফিরে না আসতে হয় সেজন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় পুরনো বাজারগুলোতে প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখে। ফলে যে সংখ্যক কর্মী ফেরার কথা তার চেয়ে অনেক কম কর্মী দেশে ফিরেছেন। নতুন বাজার খুঁজতেও মন্ত্রণালয় বছর ধরেই চেষ্টা চালিয়েছে। এ বছর নতুন বাজারে দক্ষ কর্মী পাঠাতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ বছরই জাপান নতুন বাজার হিসাবে বাংলাদেশ থেকে ইন্টার্ন কর্মী নিয়োগ করছে। নতুন করে আরব আমিরাতের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে মন্ত্রণালয়। কর্মীদের সুরক্ষায় এ বছরই একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ নিয়ে এ বছর সবচেয়ে বেশি নাটক হয়েছে। এই বাজারটি বছরের শুরুতে খুলে দিয়ে আবার ৭ দিনের মাথায় বন্ধ করে দেয়া হয়। কয়েক মাস পরে সরকারী পর্যায়ে আলোচনার পর বাজারটি আবার খুলে দেয়া হয়। এ যাত্রাতেও ফলপ্রসূ কিছু ঘটেনি। বাজারে কর্মী নিয়োগ হয়নি। পরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদল কয়েক দফা মালয়েশিয়ায় যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক করেছেন। একইভাবে মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছেন। এরপর বাজারটি জুনে আবার চালু হয়। কিন্তু চালু হওয়ার পর মাত্র ১৫৫ জন কর্মী দেশটিতে যেতে পেরেছেন। এরপর আবার বাজারটি ঝুলে যায়। সর্বশেষ বাজারটি খুলে দেয়া হয়। কিন্তু মালয়েশিয়ায় অবস্থিত প্রায় ৩ লাখ অবৈধ কর্মীকে দেশে ফিরতে হবে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের পরে এই কর্মীরা আর দেশটিতে থাকতে পারবেন না। দেশটির ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, তারা কোন অবৈধ অভিবাসীকে রাখবে না। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ গত জুলাই থেকে দেশটিতে অবৈধ কর্মী আটক অভিযান শুরু করেছে। এ পর্যন্ত দেশটিতে বাংলাদেশী কর্মী আটকের সংখ্যা কয়েক হাজার। বিষয়টি নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করলেও কোন লাভ হয়নি। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, কোন অবৈধ কর্মী রাখবে না। তাদের কর্মীর প্রয়োজন আছে। কিন্তু কোন অবৈধ কর্মীর প্রয়োজন নেই। নতুন করে বৈধভাবে কর্মী নিয়োগ করবে দেশটি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বি.এসসি. বলেছেন, এ বছর শ্রমবাজারের অর্জনও আছে আবার হারানোও আছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে আমাদের বাজার কিছুটা নষ্ট হয়েছে। এই বাজার উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। মালয়েশিয়ার বাজার এখন মোটামুটি ঠিক হয়েছে। অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে। এখন দেখা যাক মালয়েশিয়া আমাদের অনুরোধ বিবেচনা করে কিনা। নতুন বাজার খোঁজার জন্য বছর ধরেই ১২ টিম বিভিন্ন দেশ সফর করেছে। অনেক দেশে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। জাপান আমাদের দেশ থেকে কর্মী নিয়োগ করছে। বাংলাদেশের জন্য অভিবাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেশের মানুষই দেশের সম্পদ। তারা বিশ্বের ১৬৫টি দেশে শ্রম ঘাম দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে দেশে পাঠাচ্ছেন। তাদের টাকায় দেশের অর্থনীতি প্রতিনিয়ত সুসংহত হচ্ছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোট ৯ লাখ ৫৯ হাজার ৩ শত ৫৪ জন কর্মী চাকরি নিয়ে গেছেন। এযাবৎকালের মধ্যে এবারই প্রথম সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মী চাকরি পেয়েছে। সৌদিতে এ বছর ৫ লাখ ১৩ হাজার ৮শত ৬২ জন কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। ওমানে ৮৩ হাজার ১৬ জন, কাতারে ৭৭ হাজার এক শ’ ৪৫ জন এবং কুয়েতে ৪৬ হাজার ১শ’ ৭৪ জন চাকরি পেয়েছেন। মালয়েশিয়ার বাজারে ৮৩ হাজার ১শত ৬৯ জন এবং সিঙ্গাপুরে ৩৭ হাজার ৬শ’ ৭০ জনের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন দেশে এক লাখ ১৩ হাজার ৯ জন নারী কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। সৌদিতে এ বছর ৭৬ হাজার ৪ শ’ ১০ জন, জর্দানে ১৯ হাজার ১২ জন ও ওমানে ৮ হাজার ৬শ’ ৮৬ জন নারী চাকরি পেয়েছেন। গৃহকর্মী ও গামেন্টর্স কর্মীর বাইরেও সেলসম্যান, কেয়ার গিভার, বেবি সিটারসহ অন্যান্য পেশাতেও নারী কর্মীরা আগ্রহ নিয়েই কাজ করছেন। মন্ত্রণালয় ও এর দপ্তর-সংস্থা অভিবাসন ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়ন, দক্ষ কর্মী তৈরি, যৌক্তিক অভিবাসন ব্যয় এবং অভিবাসী কর্মীদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কার্যকরী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশ্ব শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য বহুবিধ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ঢাকাসহ ২৬টি জেলায় বিদেশ গমনেচছু কর্মীদের সেবা সহজিকরণের লক্ষ্যে ফিঙ্গার প্রিন্ট কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। ফলে উক্ত ২৬টি জেলার কর্মীদের ফিঙ্গার প্রিন্ট কার্যক্রমের জন্য ঢাকায় আসতে হয় না। মন্ত্রী বলেন, প্রবাসী কর্মীদের জন্য এ বছরই একটি নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। আমরা এ বছরের ১১ জুন ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৭’ গেজেট প্রকাশ করেছি। সম্প্রতি মন্ত্রিসভা বৈঠকে ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড আইন-২০১৭ চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করেছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব লাভের পর থেকেই এই সেক্টরে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দক্ষ কর্মী তৈরি করার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন জাপানের’ (আইএম জাপান) সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বি.এসসি. ও আইএম জাপানের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান কিওই ইয়ানাগিসাওয়া সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে আমরা আরও অধিক দক্ষ কর্মী তৈরি করা সম্ভব। দক্ষ কর্মী তৈরি করতে পারলে দেশে-বিদেশে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী পাঠানো সম্ভব হবে। বর্তমানে সারা বিশ্বে দক্ষ কর্মীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ কর্মী তৈরি এবং প্রেরণে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে। জাপানে নির্মাণ খাতে বাংলাদেশি কর্মীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তারা চায় বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিয়োগ করতে। জাপানের বাজারটি দেশের জন্য আর্শীবাদ। এই বাজারে কর্মীদের বেতন ভাতা অনেক ভাল। টেকনিক্যাল ইন্টার্ন ট্রেনিং প্রোগ্রামের (টিআইটিপি) আওতায় জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে টেকনিক্যাল ইন্টার্ন গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ থেকে এ প্রোগ্রামের মাধ্যমে সর্বাধিক পরিমাণ টেকনিক্যাল ইন্টার্ন গ্রহণ করবে দেশটি। বাংলাদেশ থেকে নেয়া শিক্ষানবিশ কর্মীদের পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। পরে তারা দেশে ফিরে নিজেই উদ্যোক্তা হতে পারবেন। আইএম জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ২০১৫ সালের ৮ জুলাই টেকনিক্যাল ইন্টার্ন ট্রেনিং প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। ওই সময় চারটি টেকনিক্যাল এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তখনকার চুক্তিতে টেকনিক্যাল ইন্টার্নগণ তিন বছর মেয়াদী জাপানে কাজের সুযোগ পেয়ে থাকত। নতুন চুক্তির মাধ্যমে টেকনিক্যাল ইন্টার্নগণ পাঁচ বছর মেয়াদী জাপানে কাজের সুযোগ পাবেন। মেয়াদ শেষে তারা দেশে ফিরে নিজেরাই উদ্যোক্তা হতে পারবেন। তাদের অর্জিত দক্ষতা অনুযায়ী শিল্প ও কলকারখানায় উচ্চ বেতনে ম্যানেজার ও সুপারভাইজার পর্যায়ে নিয়োজিত হতে পারবেন। উল্লেখ্য, এই সমঝোতা স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের মেয়াদ তিন বছর থেকে পাঁচ বছর করা, টেকনিক্যাল ইন্টার্ন নির্বাচন ও ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ও নিñিদ্রকরণ, প্রাক-বহির্গমণ প্রশিক্ষণ আরও কার্যকরকরণ, টেকনিক্যাল ইন্টার্নদের পাঁচ বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে ম্যানেজার-সুপারভাইজার পর্যায়ে দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তোলা ও আইএম জাপান, টেকনিক্যাল ইন্টার্নদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমসমূহ থেকে ত্রৈমাসিক রিপোর্ট গ্রহণ করবে ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। এদিকে, এ বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বি.এসসি’র সঙ্গে দেশটির মানবসম্পদ ও এমিরেটাইজেশন মন্ত্রী সাকর গোবাশ সাঈদ গোবাশের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে অধিকসংখ্যক কর্মী নেয়া ও কর্মীদের সুযোগসুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। দেশটির সরকারের সর্বশেষ জারিকৃত ডিক্রীসমূহ অন্যান্য বিদেশী কর্মীদের ন্যায় বাংলাদেশী কর্মীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় কর্মরত বাংলাদেশী কর্মীগণ তাদের নিয়োগকর্তা পরিবর্তন এবং উভয় পক্ষ পারস্পরিক নির্ধারিত নোটিশ পিরিয়ডে নোটিশ প্রদান করে চুক্তিপত্র বাতিল করতে পারবে। কর্মীগণ তাদের সুবিধা ও পছন্দমতো কাজের সুযোগ পাবেন।
×