ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রভু যিশু খ্রিস্টের আগমন

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

প্রভু যিশু খ্রিস্টের আগমন

প্রভু যিশুর এই জগতে আগমন ছিল ঐতিহাসিক ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। তাঁর এই জগতে আগমন হঠাৎ হয়নি। ভাববাদীরা যুগ যুগ ধরে বলে এসেছেন এই জগতে একজন মানুষের আগমন হবে। যিশাইয় ভাববাদী বলেছেন, ৭:১৪ ‘অতএব প্রভু আপনি তোমাদিগকে এক চিহ্ন দিবেন; দেখ এক কন্যা গর্ভবতী হইয়া পুত্র প্রসব করিবে ও তাঁহার নাম ইমানুয়েল [আমাদের সহিত ঈশ্বর] রাখিবে।’ যিশা : ৯:৬ ‘কারণ একটি বালক আমাদের জন্য জন্মিয়াছেন, একটি পুত্র আমাদিগকে দত্ত হইয়াছে; আর তাঁহারই স্কন্দের উপরে কর্র্তৃত্বভার থাকিবে এবং তাঁহার নাম হইবে- ‘আশ্চর্যমন্ত্রী, বিক্রমশালী ঈশ্বর, সনাতন পিতা, শান্তিরাজ।’ আবার ১১:১ ‘আর যিশাইয়ের গুঁড়ি হইতে এক পল্লব নির্গত হইবেন, ও তাহার মূল হইতে উৎপন্ন এক চারা ফল প্রদান করিবেন।’ ঈশ্বরের যে সঠিক পরিকল্পনা ছিল মানব জাতির পাপ থেকে মুক্তি বা উদ্ধারের জন্য তা তার মনোনীত ভাববাদীদের দ্বারা সম্পন্ন হয়নি। তাই শেষ সময়ে ঈশ্বর তাঁর পুত্রের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন (ইব্রীয় ১:১)। তাঁর আগমন এই জগতে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ভাববাদীগণ (যিশাইয় ৭:১৪; ৯:৬, ১১:১, মীখা ৫:২), স্বর্গ দূতগণ ( লূক ১: ২৬-৩৫, মথি ১: ২০-২৩) এবং স্বয়ংপিতা ঈশ্বর বলেছেন (গালা: ৪:৪) তাঁর জন্ম সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বলেছেন। ৬টি কারণে তাঁর এই জগতে আগমন হয়েছিল ১. পাপী মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধার বা মুক্তি দেবার জন্য লূক ১৯:১০ ‘কারণ যাহা হারাইয়া গিয়াছিল, তাহার অন্বেষণ ও পরিত্রাণ করিতে মনুষ্যপুত্র আসিয়াছেন।’ এখানেই প্রভু যিশুর জন্ম সবার থেকে আলাদা। জগতের দিকে তাকালে দেখা যায় কেহ কারও জন্য নহে। মানুষ স্বার্থপর। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মানুষ মানুষের জন্য খুব কম চিন্তা করে। কিন্তু প্রভু যিশু তাঁর পরিচর্যাকালে সর্বদা অন্যের জন্য চিন্তা করেছেন। অন্যের দুঃখের ভাগী হয়েছেন। তাঁর চিন্তাই ছিল অন্যের জন্য। প্রভু যিশু সক্কেয়ের বাড়িতে গিয়ে তাকে এবং সেখানে উপস্থিত বিশাল জনতার কাছে এই মহামূল্যবান উক্তি করেছিলেন। তিনি যে বাণী সেদিন রেখেছিলেন তা আজও আমাদের ভাবিয়ে তুলে এবং আমরা জীবনে নতুন অনুপ্রেরণা পাই। আমরা পবিত্র বাইবেলে দেখতে পাই প্রভু যিশুর সময় অনেক অবহেলিত, তুচ্ছকৃত, করগ্রাহী, পাপী, দরিদ্র, অনাথ, বিভিন্ন ধরনের অসুস্থ, পীড়িত মানুষ ছিল। যাদের সমাজের তথাকথিত কিছু সমাজপ্রতি সমাজে স্থান দিত না, তাদের সঙ্গে কথা বলত না, তাদের ঘৃণা করত। মোট কথা তাদের দৃষ্টিতে তারা মানুষই ছিল না। কিন্তু প্রভু যিশু তাদেরই অন্বেষণ বা খোঁজ করতে এই জগতে এসেছিলেন। তাদের ভালবেসে কাছে ডেকে ছিলেন। তাদের তিনি নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছিলেন, তাদের বাঁচার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাই যারা আজ হারান অবস্থায় রয়েছে তাদের জন্য তার প্রাণ কাঁদে, তাদের তিনি রক্ষা করতে চান। ২. অন্ধকার রাজ্য থেকে উদ্ধার করে পুত্রের রাজ্যে আনার জন্য কল : ১:১৩ ‘তিনিই আমাদিগকে অন্ধকারের কর্তৃত্ব হইতে উদ্ধার করিয়া আপন প্রেমভূমি পুত্রের রাজ্যে আনয়ন করিয়াছেন।’ মনে রাখতে হবে অন্ধকার কেহ পছন্দ করেন না। যদিও দিনের শেষে রাত আছে, অন্ধকার নেমে আসে। এই অন্ধকার অর্থ ভয়, হতাশা, নিরাশা, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই সব রকমের মন্দ কাজ হয়। রাতে কোন মানুষ ভয়ে ঘর থেকে বের হতে চায় না। ছোট, বড়, ধনী, গরিব সব শ্রেণীর লোক আতঙ্কে থাকে। এমনকি নিরাপত্তাকর্মীরাও ভয় পায়। কিন্তু প্রভু যিশুর জন্ম হয়েছিল জগত অর্থাৎ মানুষের মধ্যে যে অন্ধকার আছে তা দূর করার জন্য। তিনি বলেছেন ‘আমি জগতের জ্যোতি; যে আমার পশ্চাৎ আইসে, সে কোন মতে অন্ধকারে চলিবে না, কিন্তু জীবনের দীপ্তি পাইবে (যোহন ৮:১২ )।’ অন্ধকার অনেক সময় মানুষকে সর্বনাশের দিকে নিয়ে যায়। প্রভু যিশু অন্ধকার দূর করে আলো দিতে এসেছিলেন। যেন আমরা পিতার সঙ্গে বসবাস করতে পারি। ৩. মুক্তির মূল্য হিসেবে তাঁর জীবন দেবার জন্যÑ মথি ২০:২৮ ‘যেমন মনুষ্যপুত্র পরিচর্যা পাইতে আসেন নাই, কিন্তু পরিচর্যা করিতে এবং অনেকের পরিবর্তে আপন প্রাণ মুক্তির মূল্যরূপে দিতে আসিয়াছেন।’ আমরা দেখি বিনামূল্যে কোন কিছু পাওয়া যায় না। তাই কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। আমরা পাপী কিন্তু তারপরও আমাদের কোন কিছু দিতে হয় নাই। প্রভু যিশু আমাদের পাপ থেকে মুক্তির জন্য তাঁর পবিত্র দেহ ও রক্ত দান করেছেন। তাই আমরা দেখতে পাই পরিত্রাণ হলো বিনামূল্যে দান। রোমীয় ৫:৮ ‘কিন্তু ঈশ্বর আমাদের প্রতি তাঁহার নিজের প্রেম প্রদর্শন করিতেছেন; কারণ আমরা যখন পাপী ছিলাম, তখনও খ্রিস্ট আমাদের নিমিত্ত প্রাণ দিলেন।’ প্রভু যিশু পাপীকে জয় করতে জীবন দিয়েছেন। কারণ তিনি পাপীকে ভালবাসেন, কিন্তু পাপকে ঘৃণা করেন। পাপী যেন পাপ থেকে মুক্ত হয় তাই তিনি জীবন দিলেন। তিনি অন্যের পরিচর্যা বা সেবা পাওয়ার জন্য এই জগতে আসেন নাই, কিন্তু বেশির ভাগ লোক যেন তাঁর পরিচর্যা ও সেবা পায় তাই এসেছিলেন। পবিত্র বাইবেলে আমরা দেখি তাঁর পরিচর্যা ও সেবার কাজ। ৪. শয়তানের কাজকে ধ্বংস করার জন্য ১ যোহন ৩:৮ ‘যে পাপাচরণ করে, সে দিয়াবলের; কেননা দিয়াবল আদি হইতে পাপ করিতেছে, ঈশ্বরের পুত্র এই জন্যই প্রকাশিত হইলেন, যেন দিয়াবলের কার্য সব লোপ করেন।’ দিয়াবল বা শয়তান শক্তিশালী কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের ঈশ্বর মহাশক্তিশালী। পবিত্র বাইবেল পাঠ করলে শয়তান বা দিয়াবলের বিষয় দেখা যায়। সৃষ্টির প্রথম থেকেই ঈশ্বরের নিজের পছন্দ মতো সৃষ্টি আদম ও হাওয়ার মধ্যে শয়তান কাজ করেছিল, ঠিক একইভাবে আজও আমরা দেখতে পাই দিয়াবলের কাজ। পবিত্র বাইবেলে শয়তানকে সিংহের মতো গর্জনের কথা বলা হয়েছে (১পিতর ৫:৮), যাকোব তার পত্রে দিয়াবল বা শয়তানকে প্রতিরোধ করতে বলেছেন (যাকোব ৪:৭)। সেই শক্তি বা কৌশল জানতে হবে। তাই খ্রিস্ট বিশ্বাসীদের নিয়মিত পবিত্র শাস্ত্র ঈশ্বরের সেই জীবন্ত বাক্য পাঠ, ধ্যান, মুখস্ত ও পালন করতে হবে এবং প্রার্থনার দুর্গ গড়ে তুলতে হবে এবং পবিত্র আত্মার শক্তিতে পূর্ণ হতে হবে। কোনভাবেই দিয়াবলকে স্থান দেয়া যাবে না। ব্যক্তি জীবনে, পরিবারে, ম-লীতে শয়তান বা দিয়াবলকে প্রতিরোধ করতে হবে। প্রভু যিশু শয়তান বা দিয়াবলের সব মন্দ কাজ যা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে ছিল তা ধ্বংস করার জন্য এসেছিলেন। ৫. আমাদের অনন্ত জীবন দেবার জন্য ১ যোহন ৫: ১১-১২ ‘আর সেই সাক্ষ্য এই যে, ঈশ্বর আমাদিগকে অনন্ত জীবন দিয়াছেন, এবং সেই জীবন তাঁহার পুত্রে আছে। পুত্রকে যে পাইয়াছে, সে সেই জীবন পাইয়াছে; ঈশ্বরের পুত্রকে যে পায় নাই, সে সেই জীবন পায় নাই।’ এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জীবনেই অনন্ত জীবনের প্রয়োজন আছে। একমাত্র প্রভু যিশুই অনন্ত জীবন দিতে পারেন। ঈশ্বর তাঁকে সেই দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনিই মানুষের পাপ ক্ষমা করতে পারেন। প্রভু যিশু স্বর্গ ছেড়ে এই জগতে এসেছিলেন আমাদের অনন্ত জীবন দেবার জন্য। যোহন তিনি তার পত্রে বলেছেন প্রভু যিশুর মধ্য দিয়েই অনন্ত জীবন পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন ‘আমি আসিয়াছি, যেন তাহারা জীবন পায় ও উপচয় পায় (যোহন ১০:১০ পদের শেষ অংশ)।’ প্রভু যিশুর জীবনের আমাদের জন্য আশার বাণী হলো ‘কারণ ঈশ্বর জগতকে এমন প্রেম করিলেন যে, আপনার একজাত পুত্রকে দান করিলেন, যেন যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করে, সে বিনষ্ট না হয়, কিন্তু অনন্ত জীবন পায় (যোহন ৩:১৫)।’ পৃথিবীর সব দেশের, সব বর্ণের, সম্প্রদায়ের পাপী মানুষের জন্য এই অভয় বাণী রয়েছে। ৬. আপনার সহিত আমাদের সম্মিলন করিয়ে দেবার জন্যÑ ২ করি: ৫:১৮ ‘আর সকলই ঈশ্বর হইতে হইয়াছে, তিনি খ্রিস্ট দ্বারা আপনার সহিত আমাদের সম্মিলন করিয়াছেন এবং সম্মিলনের পরিচর্যা-পদ আমাদিগকে দিয়াছেন।’ সৃষ্টির পর থেকেই মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু সর্পের কথা শুনে ঈশ্বরের অবাধ্য হয়ে সেই এদোন উদ্যানের নিষিদ্ধ ফল খাবার পরে ঈশ্বর তাঁর প্রিয় ব্যক্তিদের শাস্তি ও অভিশাপ দিয়েছিলেন। সেই থেকেই মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়েছিল। পরে ঈশ্বর বিভিন্ন সময়ে তাঁর মনোনীত লোকদের এই জগতের মানুষের জন্য বার বার পাঠিয়েছিলেন যেন তার লোকেরা তাঁর কাছে থাকে, তাঁকে ডাকে, তাঁর ভজন বা উপাসনা করেন। কিন্তু কোন মানুষের পক্ষেই এই কাজ করা সম্ভব হয় নাই। ঈশ্বর চায় মানুষ, মানুষ চায় ঈশ্বরকে। মানুষ ঈশ্বর ছাড়া কিছুই করেন না, আবার ঈশ্বর মানুষ ছাড়া অচল। ঈশ্বর চান মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে। ঈশ্বর মানুষ থেকে দূরে থাকতে পারেন না। ঈশ্বর মনোনীত কোন ব্যক্তির পক্ষেই তাঁর সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন নাই। কিন্তু তিনি চান মানুষের সঙ্গে মিলন, সম্পর্ক পুনঃস্থাপন। তাই শেষ সময়ে ঈশ্বর বাধ্য হয়ে প্রভু যিশুকে এই জগতে পাঠিয়েছিলেন তার প্রিয় মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে। প্রভু যিশু আমাদের জন্য জীবন দিলেন যেন আমরা পিতার সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। তিনি আমাদের পক্ষে মধ্যস্থতা করেছেন, তিনিই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সত্যিই প্রভু যিশুর এই জগতে আগমন চিরদিনের জন্য আমাদের জীবনের পরিবর্তন করেছেন। তাঁর এই জগতে আগমন ছিল পাপী মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় পাওনা এবং আশীর্বাদ। তাই দেখা যায় তাঁর এই আগমন আমাদের জীবনে নিয়ে এসেছে- নতুন আশা, নতুন প্রত্যাশা, নতুন জীবন, নতুন ধারা, নতুন উদ্দীপনা, নতুন আনন্দ, নতুন সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি, জীবনের নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি স্বর্গে যাওয়ার দরজা খুলে দিয়েছেন। [email protected]
×