ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাঙ্গুনিয়ার ১৩ যুবককে জীবন্ত মাটিচাপা দেয় পাকবাহিনী

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

রাঙ্গুনিয়ার ১৩ যুবককে জীবন্ত মাটিচাপা দেয় পাকবাহিনী

৪৬ বছর পরেও রাঙ্গুনিয়া পোমরার গণকবরটি সংরক্ষণ করা হয়নি। গণকবরের স্থানটি এখন কেবলই গোচারণ ভূমি। সরকারী, বেসরকারী কোন সংস্থা এই গণকবরটির খোঁজ-খবর পর্যন্ত নিচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো এই গণকবরের কোন খোঁজ-খবর নেয়নি। চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের উপরেই গোচরা চৌমুহনী। পোমরা ইউনিয়নের গোচরা চৌমুহনী থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে সড়কের দক্ষিণ দিকে পোমরার বনবিটের পাশেই এই ঐতিহাসিক গণকবরটি পড়ে আছে চরম অবহেলা আর অমর্যাদায়। গণকবরটি এখন ঘাস, লতাপাতা, গাছ গাছালিতে কেবলই বন্য পরিবেশ। সরকার কিংবা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ উদ্যোগ নিয়ে এই গণকবরটিকে সংরক্ষণ করে দর্শনীয় স্থানে পরিণত করতে পারে। এ কাজটি করা গেলে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হবে নতুন প্রজন্মের। দেশ প্রেমে উজ্জীবিত হবে এ প্রজন্ম। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলা ভাদ্র মাসের ২৬ তারিখ রবিবার। পাক বাহিনীর ৫০-৬০ জনের দলটি পোমরা শান্তিহাটের উত্তর দিকে মধুরাম তালুকদার পাড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ এই হিন্দু পল্লীটির ওপর। বর্বরোচিত হামলা চালায় হানাদার বাহিনী। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কেউ হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি। একপর্যায়ে হানাদাররা ৭ দিন বয়সী এক কন্যাশিশু যার নাম রাখা হয়েছিল ‘যুদ্ধবতী’ তাকে দোলনা থেকে মাটিতে ফেলে রেখে দোলনার রশি খুলে সেই রশি দিয়ে একে একে ১৮ পুরুষকে বেঁধে ফেলে। এরপর টেনে হেঁচড়ে পোমরা বন বিটের সামনে হানাদাররা তাদের আস্তানায় নিয়ে যায় সকলকে। এখানে আনার সময় সকলকে চোখ বেঁধে দেয়া হয়। ধৃতদের নির্মম পরিণতির কথা ভেবে শত শত নারী-পুরুষ পাক বাহিনীর কাছে ছুটে যায়। মহিলারা পাক বাহিনীর পা জড়িয়ে কান্নাকাটি করেও তাদের মন গলাতে পারেনি। তবে ১৮ জনের মধ্যে বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে ৫ জনকে আধমারা করে ছেড়ে দিয়েছিল পাক বাহিনী। যে ৫ জন তখন ছাড়া পেয়েছিল তারা হচ্ছেন- অম্বিনী দাশ, হরে কৃষ্ণ দাশ, মনমোহন দাশ, মনীন্দ্র দাশ এবং হরিকিষ্ট দাশ। তারা কেউ আজ বেঁচে নেই। বাকি ১৩ জনকে দিয়ে নিজেদের কবর নিজেদের খুঁড়তে বাধ্য করে হানাদার বাহিনী। পোমরা বন বিটের পাশেই উল্লাস করতে করতে হানাদাররা এই ১৩ জনকেই জীবন্ত কবর দিয়ে দেয়। যাদের জীবন্ত কবরস্থ করা হয় তারা হচ্ছেন মন্টু আইচ, গান্ধী দাশ, রমণী দাশ, হরিপদ দাশ, জগৎ চন্দ্র দাশ, বাবুল দাশ, বাবুল দাশ (২) বীরাজ দে, বোচা দে, ফকির চাঁদ দাশ, খোকা দাশ, দুলাল দাশ ও শচীন দাশ। এরা সবাই তখন যুবক। কেন এই নির্মমতা, কেন মানুষরূপী পাক বাহিনী এখন জানোয়ারে পরিণত হলো তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন গ্রামের বাসিন্দা এবং তৎকালীন প্রত্যক্ষদর্শী পোমরা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান, রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আলহাজ জহির আহমদ চৌধুরী। তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে রাঙ্গুনিয়ার পোমরা বেতাগীতে মুক্তিযোদ্ধারা একে একে সফল অপারেশনের মাধ্যমে পাক বাহিনীদের পরাস্ত করে চলছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন করিম ও ক্যাপ্টেন নুরুল আলম, (অব, আই,জি,অব পুুলিশ) সফল অপারেশনের মাধ্যমে রাঙ্গুনিয়াকে প্রায় হানাদার মুক্ত করে ছিলেন, হানাদার কর্তৃক পোমরা গণকবর রচিত হওয়ার দুইদিন আগে পোমরা শান্তিরহাটের আধ ক্রোস উত্তরে ৩৩ হাজার ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুত টাওয়ার ধ্বংস করে সমগ্র রাঙ্গুনিয়াকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছিল নুরুল আলমের দল। পাক বাহিনী তখন ভীষণ বেকায়দায় পড়ে যায়। প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে তারা। হিংস্র হায়েনার দলটি প্রতিশোধ নেয় জীবন্ত গণকবরটি রচনা করে। -পান্থ নিবাস বড়ুয়া, রাঙ্গুনিয়া থেকে
×