ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথম এই গোলন্দাজ বাহিনীর স্মরণে চট্টগ্রামে তৈরি হচ্ছে কমপ্লেক্স

মুজিব ব্যাটারির গোলার আঘাতে পিছু হটতে থাকে পাকিরা

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭

মুজিব ব্যাটারির গোলার আঘাতে পিছু হটতে থাকে পাকিরা

আনোয়ার রোজেন ॥ ১৯৭১ সালের জুন মাস। দুই নম্বর সেক্টরের প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতায় রণাঙ্গনে পাকি হানাদারদের কাহিল অবস্থা। যেই দিকে যায়, সেই দিকেই মুক্তিযোদ্ধাদের আকস্মিক আক্রমণ। কিন্তু তারপরেও মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখ যুদ্ধে শক্তভাবে পাকি হানাদারদের চেপে ধরতে পারছিলেন না। কারণ ওদের কাছে ছিল অত্যাধুনিক কামানসমৃদ্ধ গোলন্দাজ বাহিনী, শক্তিশালী ঘাঁটি গেড়ে যখন তারা শেল ছুঁড়ত, তখন সম্মুখসমর চালিয়ে যাওয়াটা বড়ই দুঃসাধ্য হয়ে উঠত। হানাদারদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হলেও, মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে মেজর খালেদ মোশাররফ আফসোস করতেন- ইশ! একটা সংগঠিত গোলন্দাজ বাহিনী যদি থাকত! আর্টিলারি বা ভারী অস্ত্র সংবলিত ইউনিটকে সে সময় রণাঙ্গনের ‘বিধাতা’ মনে করা হতো। কিন্তু তিনি এটাও জানতেন, যেখানে সামান্য অস্ত্র আর গুলি পেতে দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকতে হয়, সেখানে অত্যাধুনিক কামানের গোলন্দাজ বাহিনী দিবাস্বপ্ন মাত্র। অবশ্য হাল ছাড়েননি খালেদ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালী সেনাদের যে গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ছিল, তাদের বেশিরভাগ সেনাকেই ২৫ মার্চ মেরে ফেলা হয়। যে কয়জন পালিয়ে এসেছিলেন, তাদের দুই নম্বর সেক্টরে বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন করেছিলেন খালেদ। তাদের একত্র করা হলো। গঠন করা হবে গোলন্দাজ রেজিমেন্ট। কিন্তু রেজিমেন্ট গঠনের জন্য প্রকৌশলী দরকার, আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দরকার, একটা আলাদা জায়গা দরকার। সবচেয়ে বড় দরকার কামান আর গোলাবারুদের এসব কোথায় পাওয়া যাবে? জরুরী বার্তা পাঠানো হলো ভারতের মিলিটারি অধিনায়কদের কাছে। অতিসত্তর কামান দরকার। অনেক ছোটাছুটির পর ব্যবস্থা হয় কামান আর গোলাবারুদের। ইতিহাস বলছে, ১৯৭১ সালের ২২ জুলাই ৬টি কামান নিয়ে ত্রিপুরার কোনাবান অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম আর্টিলারি ইউনিট। ৯ আগস্ট দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ সর্বাধিনয়ক জেনারেল ওসমানীকে এই কামান ব্যবহারের বিষয়ে চিঠি লেখেন। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামানুসারে এই ইউনিটের নামকরণ হয় ‘মুজিব ব্যাটারি’। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মুহাম্মদ লুৎফুল হক লিখেছেন, মুজিব ব্যাটারি বাংলাদেশ বাহিনীর প্রথম গোলন্দাজ ইউনিট। এই ব্যাটারিতে ৩ দশমিক ৭ ইঞ্চি ছয়টি কামান ছিল। এগুলো ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে ভারতে প্রস্তুত হয়। এ ধরনের কামান সর্বপ্রথম ১৯২০ সালে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীতে যুক্ত হয় এবং ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তা ব্যবহৃত হয়। কামান থেকে প্রতি মিনিটে পাঁচটি করে গোলা সর্বোচ্চ ছয় হাজার ৪০০ মিটার দূরত্বে নিক্ষেপ করা যেত। প্রতিটি কামান পরিচালনার জন্য নয়জন ক্রু লাগত। পাকিস্তান বাহিনী থেকে পালিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দেয়া বাঙালী গোলন্দাজ কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যরা এই ব্যাটারি পরিচালনা করতেন। জনবলের ঘাটতির কারণে গণবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যকেও এই ব্যাটারিতে সংযুক্ত করা হয়। প্রথমে ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ পাশা এবং পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন আনোয়রুল আলম মুজিব ব্যাটারিকে নেতৃত্ব দেন। ‘কে ফোর্স’ গঠিত হলে মুজিব ব্যাটারিকে কে ফোর্সের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। লুৎফুল হক লিখেছেন, জন্মের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই মুজিব ব্যাটারির কামান গর্জে ওঠে এবং সাফল্যের সঙ্গে রণাঙ্গনে শত্রুকে ধ্বংস করার কাজে নিয়োজিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে এ ইউনিটটি কাইয়ুমপুর, কসবা, সালদা নদী, আখাউড়া, নাজিরহাট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে লক্ষ্যভেদী ফায়ারের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ২৩ জুন ভারতীয় বাহিনীর প্রধান জেনারেল বিজয় কুমার সিং স্বাধীনতাযুদ্ধে ব্যবহৃত মুজিব ব্যাটারির ৩ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা দুটি কামান এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানকে হস্তান্তর করেন। ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর সামরিক জাদুঘরে মুজিব ব্যাটারির ছয়টি কামানসহ ‘মুজিব ব্যাটারি কর্নার’ উদ্বোধন করা হয় এবং সর্বসাধারণের জন্য তা উন্মুক্ত করা হয়। চট্টগ্রামে মুজিব ব্যাটারি কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রস্তাব ॥ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রথম গোলন্দাজ ইউনিট ‘মুজিব ব্যাটারির’ স্মারক ও ঐতিহ্য আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য চট্টগ্রাম আর্টিলারি সেন্টার ও স্কুলে মুজিব ব্যাটারি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮০ কোটি টাকা। এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য একটি শক্তিশালী, চৌকস ও আধুনিক সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখবে বলে পরিকল্পনা কমিশন মনে করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটির প্রস্তাব পাওয়ার পর ইতোমধ্যেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী একনেকে অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২১ সালের মধ্যে কমপ্লেক্সটি নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে ঢাকা সেনানিবাসের পূর্ত অধিদফতরের সেনাসদর ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চীফ ব্রাঞ্চ। সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ২৪ মার্চ চট্টগ্রামে অবস্থিত আর্টিলারি সেন্টার ও স্কুল পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিব ব্যাটারি কমপ্লেক্স নির্মাণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুধাবন করে একটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মুজিব ব্যাটারি কমপ্লেক্সটিতে একাডেমিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি একটি জাদুঘর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রথম গোলন্দাজ ইউনিট মুজিব ব্যাটারির স্মারক ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা হবে। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। জানা গেছে প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে, ভূমি উন্নয়ন ও অফিস ভবন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া আবাসিক ভবন, অন্যান্য ভবন ও অবকাঠামো তৈরি করা হবে। সেই সঙ্গে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ, যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হবে।
×