ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সোমবার লাখো মানুষের জন্য মেজবানির প্রস্তুতি

মহিউদ্দিনের মৃত্যুতে চট্টগ্রামবাসীর কান্না যেন থামছেই না

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

মহিউদ্দিনের মৃত্যুতে চট্টগ্রামবাসীর কান্না যেন থামছেই না

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ সর্বজন শ্রদ্ধেয় বর্ষীয়ান রাজনীতিক মহানগর আওয়ামী লীগের কা-ারি হ্যাটট্রিক বিজয়ী মেয়র সদ্য প্রয়াত আলহাজ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে শোকে মুহ্যমান বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। গত শুক্রবার ভোর রাতে তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জানাজা ও দাফন অনুষ্ঠানে যে জনস্রোত সৃষ্টি হয় তা এ শহরের ইতিহাসে রেকর্ড গড়েছে। নগরীর ষোলশহর মেয়র গলিস্থ মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসভবন কেন্দ্রিক জনমানুষের ¯্রােত শনিবারও অব্যাহত ছিল। তিনি নেই। অথচ, তার ভক্ত অনুরক্ত শুভানুধ্যায়ী, দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ দলে দলে তার বাসভবনমুখী রয়েছে। কবর জিয়ারতে লাইন পড়েছে। মেয়র গলির মসজিদ সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে পিতা-মাতার পাশেই মহিউদ্দিন চৌধুরীকে শুক্রবার সন্ধ্যায় দাফন করা হয়েছে। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ও সাধারণ মানুষের কাছে মহিউদ্দিন চৌধুরী এমনিতেই আলোচনার পাদপিঠে ছিলেন। মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে আলোচনার পরিধি ব্যাপকভাবে বি¯ৃÍতি লাভ করে আছে। সকলের মুখে একই আওয়াজ মহিউদ্দিনের মত নেতা আর হবে না। আসলেই তিনি ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক চরিত্রের অধিকারী। মানুষকে খাওয়ানোর জন্য যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ তার বাস ভবন সংলগ্ন বহুতল বিশিষ্ট ভবনটিতে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার পর্যন্ত অতিথি আপ্যায়ন পর্ব অব্যাহত রয়েছে। রান্না করা খাবার আসছে বাহির থেকে। দলে দলে মানুষ তা গ্রহণ করছে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের মানুষের জন্য যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তারই ফলশ্রুতিতে সর্বস্তরের শুভাকাক্সক্ষীদের কাছ থেকে যে সাড়া মিলছে তা মূলত ব্যাপক আন্তরিকতারই বহিঃপ্রকাশ। তার মৃত্যুতে শোকাস্তব্ধ চট্টগ্রামবাসীর কান্না যেন থামছে না। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের রাজনীতির এক যাদুকরে পরিণত হয়েছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ৭৪ পদার্পনের পর তার জীবনাসান ঘটেছে। কিন্তু চট্টগ্রামের জনমানুষের স্বার্থে, আন্দোলন, সংগ্রাম ও মিছিলে অগ্রভাগে থেকে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তা নিয়ে হতে পারে বড় ধরনের কাব্য রচনা। চট্টগ্রামের স্বার্থে তার ভূমিকা ছিল দুর্দমনীয়। মৃত্যুর আগে তিনি তা প্রমাণ করে গেছেন। আর মৃত্যুর পর সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গেঁথে থাকা ভালবাসার বিস্ফোরণই ঘটেছে রীতিমত। সমাজের সকলস্তরে এখন শুধু মহিউদ্দিনকে নিয়ে গল্পই আলোচিত হচ্ছে। চট্টগ্রামে দল মত নির্বিশেষে তার গ্রহণযোগ্যতা এত বেশি ছিল যে, তা তার মৃত্যুর পর একেবারে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এ নগরীর ও বাহিরের লাখ লাখ মানুষ কোন না কোন সময় তার সংস্পর্শে গেছেন। আলাপ আলোচনায় তার কথাবার্তার ঢং ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নাখোশ হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা বিরল। হাজারো বকাঝকা ও গালমন্দ খেয়ে আবারও তার সান্নিধ্যে যেতে উন্মুখ থাকতেন দলীয় পর্যায় থেকে সাধারণ মানুষ। শুধু তাই নয়, প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত কর্মকর্তা বা কর্মচারিদের সংখ্যাও অযুত। যারা তাদের প্রয়োজনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাহায্য সহযোগিতার জন্য মুক্তমনে তার সান্নিধ্যে যেতেন। তিনি মানুষের সহযোগিতা নিতেন। বিপরীতে মানুষকে সহযোগিতা দিতেন। তাকে নিয়ে সত্য ঘটনার বহু গল্প রচিত হতে পারে। এরপরও এ জাতীয় গল্পের শেষ হবার নয়। চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে তাকে নিয়ে কোন না কোন স্মৃতি রোমন্থিত হতে থাকবেই। রূঢ়ভাষী ছিলেন ধান্ধাবাজদের ক্ষেত্রে। কিন্তু সততার সঙ্গে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে জড়িত তাদের প্রতি তার বিনয় ছিল অবারিত। তাইতো মহিউদ্দিন চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে সেরাদের মধ্যেও সেরা। চট্টগ্রামে প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগে যারা কাজ করে গেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে যারা জড়িয়েছিলেন, রাজনীতির কারণে যারা তার সংস্পর্শে গিয়েছিলেন, সাংবাদিকতার কারণে যে সব সংবাদ কর্মী তার সংস্পর্শে গেছেন তারা সকলেই একবাক্যে মহিউদ্দিনের সান্নিধ্যে থাকার বিষয়টি তাদের জন্য অম্লমধুর হয়েই থাকবে। বিস্ময়কর ক্যারিশম্যাটিক চরিত্রের অধিকারী এ বর্ষীয়ান রাজনীতিকের প্রতি চট্টগ্রামবাসীর ভালবাসার যে অভিব্যক্তি তা তিনি মৃত্যুর আগেও প্রমাণ করে গেছেন। আর মৃত্যুর পর তা প্রত্যক্ষ করল গোটা দেশ। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শকে ভালবেসে আমৃত্যু সেই আদর্শেই অবিচল থেকে এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তিনি চলে গেছেন। চট্টগ্রামকে নিয়ে তার স্বপ্ন যেন অফুরান। বহু স্বপ্ন তিনি পূরণ করে গেছেন। চট্টগ্রামকে প্রকৃত অর্থে একটি সুন্দর নগরী গড়ার প্রত্যয়ে আরও বহু স্বপ্ন রচিত ছিল তার মনে। চিন্তা করতেন নিজে। বাস্তবায়ন করতে চট্টগ্রামবাসীর সহযোগিতা নিতেন। চট্টগ্রামবাসী তার কাজ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালে তা তিনি পুনর্বিবেচনা করতেও ছিলেন পারঙ্গম। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি জমির ওপর দৃষ্টিনন্দন একটি প্রকল্প প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথে তিনি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তা থেকে সরে যেতেও দ্বিধাবোধ করেননি। ওই ঘটনা নিয়ে আলোচনা সমালোচনার কমতি ছিল না। এ জন্য তাকে সমালোচনার ভাগিদার হতে হয়েছে বৈকি। কিন্তু অদম্য মহিউদ্দিন প্রশাসনিক কোন ক্ষমতায় না থেকেও এগিয়েছেন, শুধু এগিয়েছেন। নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি, শিক্ষার উন্নয়ন, সমাজের অনগ্রসর শ্রেণী ও পেশার জনমানুষের স্বার্থে তিনি তার বাস্তব জীবনের পুরো ভাগটিই প্রাণোচ্ছ্বাসে ব্যয় করে গেছেন। তার সফল কার্যক্রমগুলো সাক্ষ্য ইতোমধ্যে দিয়েছে এবং আগামী দিনগুলোতেও দিতে থাকবে। তাইতো তিনি চট্টগ্রামবাসীর হৃদয়ের মণিকোঠায় থাকবেন চিরস্মরণীয়। চট্টগ্রামবাসীর সহযোগিতায় তিনি ছিলেন বলীয়ান। বলীয়ানের কর্মযজ্ঞে তিনি পরিণত হয়েছেন মহীয়ান। লাখো মানুষের জন্য মেজবানের প্রস্তুতি ॥ মহিউদ্দিন চৌধুরী মেজবানকে খুবই পছন্দ করতেন। এই মেজবানের বিস্তৃতি তিনি সুদূর টুঙ্গীপাড়া পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। প্রতিবছর ১৫ আগস্ট টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতার মাজারে মহিউদ্দিন চৌধুরীর উদ্যোগে মেজবানের বড় আয়োজন চলে আসছে বছরের পর বছর। আগামীতে এ ধরনের মেজবানের আয়োজনে তার উপস্থিতি হয়ত থাকবে না। কিন্তু টুঙ্গীপাড়ার মানুষ মহিউদ্দিনের ‘আয়োজনের মেজবানকে’ হয়ত ভুলতে পারবে না। আগামী ১৮ ডিসেম্বর মহিউদ্দিনের জন্য মেজবানের প্রস্তুতি নিচ্ছে তার পরিবার। ইতোমধ্যেই নগরীর ১২টি কনভেনশন হল বুকিং করা হয়েছে। ১শ গরু জবাই ও লাখো মানুষকে খাওয়ানোর টার্গেট করা হয়েছে। তার পরিবারের পক্ষ থেকেই এত বড় মেজবান আয়োজনের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চশমাহিলের তার বাস ভবনে মহিলাদের জন্য মেজবানের খাওয়ার পরিবেশন করা হবে। এছাড়া নগরীর কিং অব চিটাগাং, রীমা কমিউনিটি সেন্টার, কে স্কয়ার, গোল্ডেট টার্চ, কিশলয়, সুইচ পার্ক, স্মরণিকা, এন মোহাম্মদ কনভেন সেন্টার, কে. ভি কনভেন সেন্টার, ভিআইপি কনভেনশন সেন্টার ও সাগরিকা কনভেনশন সেন্টারে নগরবাসীর জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আগ্রহী ধনী, দরিদ্র, অসহায় বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের মাঝে বিলানো হবে মহিউদ্দিনের অতিপ্রিয় মেজবানির খাবার।
×