ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীকে বহিষ্কার, জাপায় স্বস্তি

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থীকে বহিষ্কার, জাপায় স্বস্তি

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ৮ ডিসেম্বর ॥ রংপুর সিটি কর্পোরেশন (রসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে জাতীয় পার্টির বিদ্রোহী প্রার্থী দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাতিজা হুসেইন মকবুল শাহরিয়ার আসিফকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গে অভিযোগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। শুক্রবার জাপার চেয়ারম্যানে প্রেস এ্যান্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভরায় স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় পার্টির দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং পার্টি চেয়ারম্যানের নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত অমান্য করে আসন্ন রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আসিফ শাহরিয়ার মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় তাকে পার্টির প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পদ ও পদবী থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সঙ্গে পার্টির কোন সদস্য আসিফ শাহরিয়ারের পক্ষে নির্বাচনী কাজে অংশগ্রহণ করলে তাকেও জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হবে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারা মোতাবেক এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, যা অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। রংপুর সিটি কর্পোরেশন (রসিক) নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন রংপুর মহানগর জাপা সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদরে ভাতিজা হুসেইন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ। শাহরিয়ার আসিফ রংপুরের গঙ্গাচড়া (রংপুর-১) আসন থেকে এর আগে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রথমবারের মত দলীয় প্রতীকে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। মেয়র পদে মনোনয়ন নেয়ার পর পরই তাকে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করার নির্দেশ সম্বলিত নোটিশ দেন দলীয় চেয়ারম্যান এরশাদ। নোটিশে উল্লেখ করা হয়, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করলে দলের সকল পদ ও পদবী থেকে তাকে বহিষ্কার করা হবে। মনোনয়ন সংগ্রহ করে আসিফ বলেছিলেন, ‘আমি দল থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলাম। কিন্তু, পার্টি আমাকে দেয়নি। স্বতন্ত্র হিসেবে মেয়র নির্বাচন করব।’ বহিষ্কারের খবরে শাহরিয়ার আসিফ বলেন, খবর শুনেছি। এ ব্যাপারে আপাতত কোন মতামত দিচ্ছি দিতে চাচ্ছি না। আসিফকে দল থেকে বহিষ্কার করায় আনন্দ উল্লাস করেছে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা। তারা বলেছেন, নির্বাচনের আগে তাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত জাপা প্রার্থীর জন্য সুফল বয়ে আনবে। কারণ তিনি জাপায় থাকার কারণে জাপার দু’জন প্রার্থী বিবেচনা করা হতো। তাতে জাপার কিছু ভোট ভাগ হওয়ার সম্ভবনা ছিল। তাছাড়া, রংপুরের মানুষ এরশাদকে ভালবাসে। এরশাদকে ভালবেসেই তাঁর মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দেয়। কিন্তু আসিফ জাতীয় পার্টিতে থাকা অবস্থায় এরশাদের ভাতিজা হিসেবে পার্টির কিছু লোকের তার প্রতি দুর্বলতা থাকার আশঙ্কা ছিল। পার্টি থেকে তাকে বহিষ্কার করায় সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হলো। জাপা’র মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির বলেন, আসিফ এ নির্বাচনে কোন ফ্যাক্টর নন। তবে, তাকে বহিষ্কার করায় দলের প্রার্থীর জন্য সুবিধা হয়েছে, দলে স্বস্তি এসেছে। সকল স্তরের নেতা-কর্মীরা এতে খুিশ হয়েছে। এখন তার পক্ষে জাপার কোন নেতা-কর্মী কাজ করবে না। এই নির্বাচন ঘিরে এরশাদের দুর্গ খ্যাত রংপুরে জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। বসে নেই জাতীয় পার্টিও। দলীয় প্রতীকে এই নির্বাচন হওয়ায় লাঙলের ঘাঁটিতে জয় নিশ্চিত করতে কৌশলী প্রচারণা চালাচ্ছেন নৌকা প্রতীকের পক্ষে দলীয় কর্মী-সমর্থকরা। রংপুর সিটিতে ক্ষমতাসীন দলের বিগত দিনের উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরার পাশাপাশি লাঙল প্রতীকে ভোট না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে ভোটারদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে লিফলেট। আপত্তিকর কথাসহ প্রার্থী বা দলের বিরুদ্ধে আক্রমণ করা এই লিফলেটে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় পার্টি মনোনীত মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তার অভিযোগ, লিফলেটে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং প্রার্থী মোস্তফাকে নিয়ে আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছেন। লাঙলে ভোট না দিতে লিফলেট বিতরণ করায় তিনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। কারণ কোন প্রার্থী বা দলের বিরুদ্ধে আক্রমণ করা নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। মোস্তফা বলেন, ব্যক্তিকে আক্রমণ করে ও দলের বিরুদ্ধে কথা বললে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ থেকে সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছি। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এবং নির্বাচন কমিশন আন্তরিক হলেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি বলেও অভিযোগ করেন জাপার এই প্রার্থী। এসময় তিনি আওয়ামী লীগের প্রচার করা ওই লিফলেটের ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসার দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এই লিফলেটের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা বলছেন, তারা এ রকম কোন লিফলেট বিতরণ করেননি। তবে, কেউ যদি এ রকম লিফলেট বিতরণ করে থাকে তার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নয়। কারণ আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঝন্টুকে বিতর্কিত করতে এ রকম অপপ্রচার চালানো হতে পারে। তারা বলেন, যেহেতু নির্বাচন কমিশনের ভিজিলেন্স টিম কাজ করছে সেহেতু তারাই খুঁজে বের করবেন এ ধরনের লিফলেট কারা প্রচার করছেন। ঝন্টুর জনপ্রিয়তা নষ্ট করার জন্য এটা ষড়যন্ত্র হতে পারে। এদিকে, নগরীর ২১, ২২, ২৭, ৩২ ও ৩৩ নং ওয়ার্ডে বেশ কয়েকজন ভোটারের হাতে ওই লিফলেট দেখা গেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নৌকা প্রতীকের ছোট হ্যান্ডবিলের সঙ্গে ওই লিফলেটও দিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। সংগ্রহ করা ওই লিফলেটটিতে রংপুরের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদক্ষেপ ও আন্তরিকতার কথা তুলে ধরার পাশাপাশি জাতীয় পার্টিকে ভোট দেয়ায় বিগত দিনে রংপুর উন্নয়ন বঞ্চিত ছিল বলা হয়েছে। ২৭ বছরে জাতীয় পার্টির কোন নেতা রংপুরের উন্নয়নে এগিয়ে আসেনি। তারা শুধু রংপুরের সহজ-সরল মানুষগুলোর ভোটে নির্বাচিত হয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে ভোট দেয়ায় সারাদেশের মানুষ রংপুরবাসীকে বোকা ভেবেছে। ভেবেছে মফিজ। আমরা আর এই ভুল করব না। ভুল মার্কায় ভোট দিব না। এরকম আরও অনেক লেখা রয়েছে। লিফলেটের নিচের অংশে লেখা রয়েছে নৌকা প্রতীকে ভোট প্রার্থনায় রংপুরের সর্বস্তরের উন্নয়নকামী মানুষের পক্ষ থেকে প্রচারিত। লিফলেটটিতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার এবং মেয়র প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু ও নৌকা প্রতীকের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। ফেসবুক ও বেশ কিছু ওয়েব সাইটে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে ওই লিফলেট। এ ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসার সুভাষ চন্দ্র সরকার বলেন, অভিযোগটি শুনেছি, কিন্তু কোন লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আগামী ২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশ নির্বাচনে মেয়র পদে ৭ জন, ৩৩টি ওয়ার্ডে সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬৫ জন ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২১১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। রংপুর সিটি কর্পোরেশনে ওয়ার্ড আছে ৩৩টি। সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১১টি। তিন লাখ ৯৩ হাজার ৯৯৪ জন ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৫৬ পুরুষ এবং ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৩৮ জন নারী। গত ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্র ১৯৩টি, ভোটকক্ষ ১ হাজার ১১১২টি। ৩ হাজার ৬৫২ জন নির্বাচন কর্মকর্তা এ নির্বাচনে কাজ করবে। পাঁচ বছর আগে রংপুর সিটির ভোটার ছিল ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৭৪২। গত ৪ ডিসেম্বর সোমবার দুপুরে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এ মোট ৭ জন মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু পেয়েছেন দলীয় প্রতীক নৌকা, জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা পেয়েছেন দলীয় প্রতীক লাঙল, বিএনপি প্রার্থী কাওছার জামান বাবলা পেয়েছেন দলীয় প্রতীক ধানের শীষ, জাপা’র বিদ্রোহী নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হোসেইন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ পেয়েছেন হাতি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের গোলাম মোস্তফা পেয়েছেন হাতপাখা, বাসদের আব্দুল কুদ্দুস পেয়েছেন মই ও এনপিপি’র সেলিম আক্তার পেয়েছেন আম মার্কা। এছাড়া, সংরক্ষিত কাউন্সিল ৬৫ জন ও সাধারণ কাউন্সিলর ২১১ জন পদ প্রার্থীকেও প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
×