ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অবশেষে গেইল তান্ডব

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

অবশেষে গেইল তান্ডব

মোঃ মামুন রশীদ ॥ ছক্কার সমার্থক শব্দ গেইল! এটা অনেক আগেই স্বীকৃত হয়ে গেছে বিশ্ব ক্রিকেটে। তবে এবার বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) টি২০ আসরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এ বাঁহাতি ওপেনার ছিলেন শুধুই একটি হতাশার নাম! রান করছিলেন, কিন্তু বিধ্বংসী ক্রিস গেইলকে যেন দেখাই যাচ্ছিল না। যে অগ্নিমূর্তিতে তাকে বিশ্বের ক্রিকেটভক্তরা দেখে অভ্যস্ত সেটা দেখা যায়নি। ব্যাট হাতে বিদ্যুত চমকের মতো ঝলসে উঠে ছক্কার বৃষ্টি ঝরাতে পারেননি। গেইল পারেননি, তাই আর কোন ব্যাটসম্যানের পক্ষে সম্ভব হয়নি তিন অঙ্কের ‘ম্যাজিক ফিগারে’ পৌঁছানো। বাংলাদেশের ক্রিকেটভক্তরা গত ১৮ নবেম্বর থেকে যতবারই গেইলের ঝড় দেখতে এসেছেন প্রতিবারই আক্ষেপ নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। তবে অপেক্ষার প্রহর কেটেছে শুক্রবার এলিমিনেটর ম্যাচে। রংপুর রাইডার্সের জন্য ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছেন তিনি, হাঁকিয়েছেন দুর্ধর্ষ এক শতক। মাত্র ৪৫ বলে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বিপিএলের ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে থামেননি, অপরাজিত ছিলেন ৫১ বলে ১২৬ রানে! এটি বিপিএলে কোন ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। ৬ চার ও ১৪ ছক্কা হাঁকিয়েছেন। কারও ব্যক্তিগত ইনিংসে এটিই সবচেয়ে বেশি ছক্কা হাঁকানোরও রেকর্ড বিপিএলে। বিপিএলের লীগপর্বে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস ছিল এবার জিম্বাবুইয়ের সিকান্দার রাজার। ৯৫ রানের একটি ইনিংস উপহার দিয়েছেন চট্টগ্রামে সিলেট সিক্সার্সের বিরুদ্ধে ২৪ নবেম্বর। চিটাগং ভাইকিংসের হয়ে ওই ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। এছাড়া আর কোন ব্যাটসম্যান ৯০ রানই করতে পারেননি। অথচ সবার প্রত্যাশাই ছিল এবার গেইল দীর্ঘ সময় বিপিএল খেলার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেশ কয়েকটি দানবীয় ইনিংস খেলবেন। সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি এ ক্যারিবীয় ওপেনার। যেন মোক্ষম সময়ের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। শুক্রবার খুলনা টাইটান্সের বিরুদ্ধে ফাইনালের রেসে টিকে থাকার লড়াই রংপুরের। হারলেই বিদায় নিতে হবে টুর্নামেন্ট থেকে। সেই ম্যাচে ১৬৮ রানের টার্গেট রংপুরের সামনে। স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন এনে এদিন গেইলের সঙ্গে ইনিংস উদ্বোধন করতে নামেন সোহাগ গাজী! এর আগে ২০১২ ও ২০১৩ বিপিএলে গেইল-গাজী দ্বৈরথ ছিল বিশ্ব ক্রিকেটে আলোচনার বিষয়বস্তু। সেই দুটি আসরেই গেইলের প্রতিপক্ষ ছিলেন ডানহাতি অফস্পিনার গাজী এবং তিনি বল হাতে নামলেই কুপোকাত হয়েছেন গেইল। তাই এ ক্যারিবীয় দানবকেও বারবার ‘গাজী, গাজী’ নামটি শুনে ত্যক্ত হতে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এবার তাকেই সতীর্থ হিসেবে পেয়ে যেন স্বস্তিতেই ছিলেন গেইল। আর এদিন ব্যাটিং সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যেন বন্ধত্বটা আরও গাঢ় হয়েছে। তবে একপ্রান্তে যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন দর্শকের ভূমিকাতেই ছিলেন গাজী। প্রথম থেকেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন গেইল। তার সঙ্গী গাজী ইনিংসের তৃতীয় ওভারে যখন মাত্র ১ রানে সাজঘরে ফেরেন তখন গেইল রীতিমতো উড়ছেন ১০ বলে ২২ রান তুলে। এসব দেখেই দর্শকরা বলাবলি করছিলেন আজই গেইলের দিন, আজই তিনি সেঞ্চুরি হাঁকাবেন। এমনটা দর্শকরা বলতেই পারেন, কারণ চলতি বিপিএলে আগের ম্যাচগুলোতে তাকে শুরু থেকেই এভাবে ঝলসে উঠতে দেখা যায়নি। উঠন্তি মূলা পত্তনেই চেনা যায় সেই চেনা চেহারায় গেইলকে দেখাটা একেবারেই সুখকর হয়নি খুলনার বোলারদের জন্য। একপ্রান্তে ক্রিজে দাঁড়িয়ে থেকে চিরাচরিত স্বভাবে অবলীলায় এবং দারুণ স্বাচ্ছন্দ্যে বলগুলোকে উড়িয়ে মাঠ ছাড়া করেছেন গেইল। ফিল্ডাররা এবং নন-স্ট্রাইকিংয়ে থাকা গেইলের সঙ্গী ব্যাটসম্যানরা পর্যন্ত দর্শক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছেন তার ব্যাটিং তা-ব। ছক্কার বিস্ফোরণে কেঁপে কেঁপে উঠেছে পুরো মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম সোল্লাস হর্ষধ্বনিতে। গেইলকে থামানো যায়নি। ২৩ বলেই ফিফটি হাঁকান তিনি। আগের ৮ ম্যাচেও দুটি ফিফটি হাঁকিয়েছেন গেইল, কিন্তু ছক্কার রাজা কারও মনে দাগ কাটার পরিবর্তে বিরক্তিই ছড়িয়েছেন উত্তাপহীন ব্যাটিংয়ে। একদিনেই সব আক্ষেপ পুষিয়ে দেয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়েই যেন নেমেছিলেন এদিন। তাকে ঠেকাতে খুলনার অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ নিজেসহ সবমিলিয়ে ৭ বোলারকে কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু সবাইকে নি¤œমানের বোলারে পরিণত করে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন গেইল। পেসার আবু জায়েদ রাহীকে ২টি, মাহমুদউল্লাহকে ৩টি, জাফরা আর্চারকে ১টি, লেগস্পিনার মোহাম্মদ ইরফানকে ৩টি, ক্রেইগ ব্রেথওয়েটকে ২টি, আফিফ হোসেনকে ১টি করে ছক্কা হাঁকিয়ে ৪৫ বলেই সেঞ্চুরি পূর্ণ করা গেইল তার সাইক্লোন চালিয়ে যান। এর আগে বিপিএলের দ্রুততম সেঞ্চুরি ছিল ৪৪ বলে। গেইল সেটি করেছিলেন ২০১২ বিপিএলে ১০ ফেব্রুয়ারি মিরপুরে খুলনা রয়্যালসের বিরুদ্ধে বরিশাল বার্নার্সের হয়ে। এবার সেটিকে অল্পের জন্য ছাড়াতে পারেননি, কিন্তু বিপিএলের দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরিটি করেছেন। এটি টি২০ ক্যারিয়ারে গেইলের ১৯তম সেঞ্চুরি এবং বিপিএলে নিজের চতুর্থ। সবমিলিয়ে বিপিএলে ১০টি সেঞ্চুরি দেখা গেছে। তবে এবার এটিই প্রথম সেঞ্চুরি। নাজমুল হোসেন শান্ত বোলিং করতে আসেন ১৬তম ওভারে। তার প্রথম দুই বলেই ছক্কা হাঁকিয়ে শেষ পর্যন্ত ৫১ বলে ৬ চার ও ১৪ ছক্কায় ১২৬ রানে অপরাজিত থাকেন গেইল। এটি বিপিএলের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। গত আসরে সাব্বির রহমান রুম্মান ১৩ নবেম্বর মিরপুরে বরিশাল বুলসের বিরুদ্ধে ৬১ বলে ৯ চার, ৯ ছক্কায় ১২২ রান করেছিলেন রাজশাহী কিংসের হয়ে। তবে এক ইনিংসে এত বেশি ছক্কা কেউ হাঁকাননি। গেইলের ১৪ ছক্কাই সর্বাধিক। ২০১৩ সালে গেইলই ১২ ছক্কা হাঁকিয়ে সবার ওপরে ছিলেন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের হয়ে খুলনা রয়্যালসের বিরুদ্ধে ৫১ বলে ১১৪ রান করার দিনে। এবার নিজেকেই ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। তবে ৭১ রানের সময় একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছিলেন ইরফান। ক্যাচটি অবশ্য হাতছাড়া করেন ফিল্ডার, তবে সেটি নো বল ছিল। পরের বলেও ক্যাচ আউট হয়ে যান কিন্তু ফ্রি-হিটের কল্যাণে রক্ষা। এছাড়া আর কোন সুযোগই দেননি গেইল। দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে প্রতিপক্ষ ৭ বোলারকে।
×