ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আইনজ্ঞদের অভিমত

খালেদা জিয়া আদালতে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন, যা নজিরবিহীন

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

খালেদা জিয়া আদালতে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন, যা নজিরবিহীন

আরাফাত মুন্না ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে খালেদা জিয়া আদালত কক্ষকেই রাজনৈতিক জনসভায় পরিণত করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞরা। তারা বলেন, আইনের বাইরে গিয়ে খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নজিরবিহীন। এতিমদের টাকা আত্মসাতের এই মামলায় নিজের পক্ষে সাত কর্মদিবস বক্তব্য দিয়েছেন খালেদা জিয়া। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর বারবার বাধার পরেও পুরো বক্তব্যের অধিকাংশ সময় জুড়েই রাজনৈতিক বক্তব্য দেন তিনি। দীর্ঘ বক্তব্যে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। এছাড়া নিজের ও তার স্বামী জিয়াউর রহমানের ইতিহাসও তুলে ধরেন আদালতে। এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপ-পরিচালক হারুন আর রশীদ। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামালউদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। মামলার বিচার শুরুর প্রথম থেকেই বারবার শুনানিতে অনুপস্থিত থেকেছেন খালেদা জিয়া। অনুপস্থিতির কারণে একাধিকবার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছে আদালত। নানা অজুহাতে অসংখ্যবার উচ্চ আদালতেও গিয়েছেন। তার এসব কর্মকা-কে বিচার বিলম্বিত করার অপচেষ্টা বলেই মনে করেন অনেকে। এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রথম দিন ১৯ অক্টোবর খালেদা জিয়া দাবি করেন, এতিমদের জন্য আসা একটি টাকাও তছরুপ বা অপচয় করা হয়নি, তা ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে। ২৬ অক্টোবর তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে এ মামলা ভুয়া, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ও দিন বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও অনিয়ম, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির মামলা হয়েছিল। কিন্তু তাকে সৌভাগ্য যে আমার মতো তাকে আদালতে ঘুরতে হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, তিন যুগ আগে তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন ‘দেশ ও জাতির ডাকে সাড়া দিয়ে’। ক্ষমতার মসনদে বসার লোভ তখন তার মধ্যে ‘ছিল না’। তিনি বলেন, ‘আমরা গণপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন করতে চাই। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বদলে শান্তি-সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চাই এ দেশে। আমাদের বিরুদ্ধে সব মামলাই ভুয়া। আমার কী অপরাধ যে আমাকে এ রকম আদালতে ঘুরতে হচ্ছে?’ খালেদা জিয়া দাবি করেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। তিনি বলেন, ‘আমাকে চার দশকের স্মৃতিবিজড়িত বাসা থেকে উৎখাত করা হয়েছে। তবে তিনি এটা উল্লেখ করেন নি যে, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর তাকে কথিত বাড়িটি থেকে অপসারণ করা হয়। তার কথিত বাড়ির স্থানটি এখন সেনাবাহিনী অফিসারদের বাসভবন। সেদিন খালেদা আরও দাবি করেন, ‘বর্তমান সরকার জনগণের ভোটে ‘নির্বাচিত সরকার নয়’, কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সিংহভাগ ভোটারই ভোট দেননি।’ ২ নবেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থন করে তৃতীয় দিনে খালেদা বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে তাকে সরাতে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার নীলনক্সা বাস্তবায়ন করছে ক্ষমতাসীনরা। আর ১১ নবেম্বর বলেন, বাংলাদেশে বিচারকরা স্বাধীনভাবে আইন মেনে বিচার করতে পারেন কিনা, এ মামলার রায়েই তার প্রমাণ আসবে। দেশে বিচার ব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতিতে ন্যায়বিচার পাবেন কিনা- তা নিয়ে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন ১৬ নবেম্বর। সর্বশেষ ২৩ নবেম্বর তিনি এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের দুদকে নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ওইদিনই জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও খালেদার আত্মপক্ষ সমর্থন শুরু হয়। এ মামলায় প্রথম দিনের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি নিজেকে ‘সম্পূর্ণ নির্দোষ’ দাবি করেন। মঙ্গলবার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থন শেষ হলে দুইপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানির জন্য ১৯, ২০ ও ২১ ডিসেম্বর দিন রেখেছেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোঃ আখতারুজ্জামান। এর মধ্য দিয়ে দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নয় বছর আগে দুদকের দায়ের করা এ মামলা বিচারের শেষ পর্যায়ে উপনীত হলো। যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ হলেই মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসবে। আদালতে খালেদা জিয়ার দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রচলিত আইনের অধীনেই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুসারে আসামিকে প্রশ্ন করা হলে আসামি উত্তর দেয়ার সুযোগ থাকে কেবল তার বিরুদ্ধে আসা সাক্ষ্যগুলোর জবাব দেয়নি। এর বাইরে অন্য কোন বিষয় অবতারণার আইনগত কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এর পরেও খালেদা জিয়া দীর্ঘ সময় ধরে আদালতে রাজনৈতিক বক্তব্য রেখে কার্যত আদালত কক্ষকে তার রাজনৈতিক জনসভার আদলে বিবেচনা করেছেন, যা নজিরবিহীন এবং কোনভাবেই আইনসঙ্গত নয়। শ ম রেজাউল বলেন, দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে তার এ ধরনের বক্তব্য প্রদান কার্যত বিচার ব্যবস্থার বিধিবিধানকে লঙ্ঘন করাই শুধু নয়, শত শত বছরের রেওয়াজকেও উপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিচারক এ ধরনের বক্তব্য কেন গ্রহণ করলেন এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে বিচার বিভ্রাট করার জন্য আদালত কক্ষে অবাঞ্ছিত বক্তব্য রাখা বিচার বিভাগীয় রীতিনীতি পরিপন্থী আচরণ করা, বিচারকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা, নানা অজুহাতে বহুবার হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগে মামলা দায়ের বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত বিলম্বিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি আরও বলেন, এসব কারণেই হয়তো বিচারক, সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে খালেদা জিয়ার অযৌক্তিক অপ্রাসঙ্গিক ও অনাকাক্সিক্ষত বক্তব্য শোনেন। তবে তার ওই বক্তব্য কোনভাবেই বিচার প্রক্রিয়ার ওপর বিবেচনার অবকাশ নেই বলেও মনে করেন এই আইন বিশেষজ্ঞ। এ বিষয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল জনকণ্ঠকে বলেন, এই মামলার প্রধান আসামি আত্মপক্ষ সমর্থন করে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছেন। প্রতিনিয়তই তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে গেছেন। আমি বারবার বাধা দিয়েছি। তিনি বলেন, মামলা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাইরে কোন কিছু আদালতে উপস্থাপনের কোন নিয়ম না থাকলেও খালেদা জিয়া সেটাই করেছেন। তবে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক বক্তব্য দিলেও বিচারের ক্ষেত্রে বিচারকের এসব বিষয় আমলে নেয়ার সুযোগ নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ বিষয়ে আইনজীবী ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ জনকণ্ঠকে বলেন, আদালত একটি বিচারালয়। তার একটি নিজস্ব শৃঙ্খলাও রয়েছে। খালেদা জিয়া আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে সেই শৃঙ্খলাও ভঙ্গ করেছেন। তিনি বলেন, আদালতই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার আইনের বাইরে কোন কিছু বিবেচনায় নেয়ার সুযোগ নেই। মামলার মেরিট কি সেটাই তার বিবেচ্য বিষয়। আইন সবার জন্যই সমান। সে ক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও আইনের আওতায়ই থাকবেন। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই বলেও মনে করেন এই আইনজীবী।
×