ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হলে নিরাপত্তা হুমকিতে বাংলাদেশ ও ভারত

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৭ ডিসেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হলে নিরাপত্তা হুমকিতে বাংলাদেশ ও ভারত

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশই নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। সে কারণে রোহিঙ্গা সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানে ভারতের কাছে সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়াও রোহিঙ্গা সঙ্কট দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য আঞ্চলিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বুধবার রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিশেষজ্ঞরা এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশকে ভারতের কূটনৈতিক স্বীকৃতির ৪৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে ‘বাংলাদেশ ও ভারত মৈত্রী এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, বৃটিশ মানবাধিকার নেতা জুলিয়ান ফ্রান্সিস, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আবদুর রশীদ, ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক মানস ঘোষ ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ খান, বীর বিক্রম। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রেক্ষিতে বিশ্বের প্রতিটি দেশই তাদের জাতীয় স্বার্থ অনুসরণ করেই নিজ নিজ অবস্থান নিয়েছে। তবে বিশ্বের সকলেই আমাদের পাশে রয়েছে। আমি বলতে চাই, রোহিঙ্গা সঙ্কট মিয়ানমারই সৃষ্টি করেছে। এই সঙ্কটের সমাধানও মিয়ানমারেই। তবে এই সঙ্কট আমাদেরকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের নাগরিকরা রাখাইনে ফিরে যাবেন। তবে সেখানে ঘর-বাড়ি কিছু নেই। থাকবে কোথায়। তাই ভারত ও চীনের কাছে আমরা প্রস্তাব করেছি, রাখাইনে তারা যেন আবাসস্থল তৈরিতে সহযোগিতা করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধন তৈরি হয়েছে। এই বন্ধন দিনে দিনে আরও জোরালো হয়েছে। আগামীতেও দুই দেশের বন্ধন আরও জোরালো হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন। বিশেষ অতিথি ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, রাখাইনের সমস্যা শুধু বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটা একটি আঞ্চলিক সমস্যা। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক এসেছেন। তবে ভারত বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশেরই প্রতিবেশী। আমরা এই সমস্যা আমলে নিয়েছি। সমাধানেরও চেষ্টা করছি। আমাদের ফরেন অফিস থেকেও বিষয়টি দেখভাল করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন অনেক গভীর। দুই দেশের মধ্যেই যোগাযোগ বাড়ছে। বিশেষ করে রেলপথ যোগাযোগ বেড়েছে। ভিসা সহজীকরণ করা হয়েছে। সে কারণে এখন চলতি বছরে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ ভারতে গেছেন। একই সঙ্গে আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতাও বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছি। তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে বিবিআইএন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বাংলাদেশের উচিত হবে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিকভাবে এবং ভারত, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখা। বিশেষ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের কাছে আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন এবং সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সার্বিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করি। কারণ অসহায় রোহিঙ্গাদের পাকি-জামায়াতীদের হাতে ছেড়ে দিলে তা দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য জন্য হুমকির কারণ হবে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব রয়েছে। তবে বন্ধুত্বের জন্য অনেক সময় ছাড় দিতে হয়। সে কারণে হয়তো রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে মিয়ানমার নীতিতে ভারত এখন খানিকটা পরিবর্তন আনছে। কিন্তু সেই পরিবর্তন দৃশ্যমান না হলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রভাব পড়বে। তবে এখনও দৃশ্যত সবই ঠিক আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আবদুর রশীদ বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য এই সঙ্কট বড় একটি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এই সঙ্কট মোকাবেলায় উভয় দেশকেই এগিয়ে আসতে হবে। তিনি রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় আরও জোরালো ভূমিকা নেয়ার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানান। জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছিল। এখন রোহিঙ্গা সঙ্কটেও বাংলাদেশের পাশে ভারতের দাঁড়ানো উচিত। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের প্রতি চাপ দেয়ার জন্য ভারতের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক মানস ঘোষ বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মৈত্রীর বন্ধন শুরু হয়। সে সময় ইন্দিরা গান্ধী বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেলে থাকায় তাজউদ্দীন আহমদও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে তাজউদ্দীন আহমদের বিশেষ ভূমিকার বিষয়টি আমরা এখন অনেকটাই বিস্মৃত হয়েছি। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় ভারত। দেশটির স্বীকৃতি দিবসের ৪৬ বছর পূর্তিতে এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
×