ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষজ্ঞদের অভিমত

পোপের ঢাকা সফর রোহিঙ্গা সঙ্কটে ভূমিকা রাখবে

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৪ ডিসেম্বর ২০১৭

পোপের ঢাকা সফর রোহিঙ্গা সঙ্কটে ভূমিকা রাখবে

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ খ্রীস্টান ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আরও চাপ বাড়বে। এছাড়া তার এই সফরের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কটকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরও গুরুত্ব দেবে বলে জানিয়েছেন কূটনীতি বিশেষজ্ঞরা। এদিকে পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, মিয়ানমার সফরে তিনি রোহিঙ্গা শব্দটি এড়িয়ে গেলেও আলোচনার পথ বন্ধ করে না দিয়ে দেশটির সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে তিনি আসল বার্তাটি ঠিকই পৌঁছে দিতে পেরেছেন। গত বৃহস্পতি থেকে শনিবার ভ্যাটিকানের পোপ ফ্রান্সিস ঢাকা সফর করেন। তিনি এমন এক সময়ে ঢাকায় আসেন, যে সময় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলা করছে। এছাড়া পোপ ফ্রান্সিস প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকেই বাংলাদেশে আসেন। সে কারণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পোপের সফরে সময় রোহিঙ্গা সঙ্কটকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। বিভিন্ন বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়েই পোপকে ঢাকার বার্তা দেয়া হয়েছে। ঢাকা সফরের প্রথমদিনই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে এই শরণার্থী সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশের পাশে থাকতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান পোপ ফ্রান্সিস। বঙ্গভবনে এক অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে তিনি এই আহ্বান জানান। সেসময় রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে সোচ্চার হতে পোপ ফ্রান্সিরের প্রতি আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, পোপ ফ্রান্সিস ঢাকায় এসে প্রথমদিন রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণ না করলেও রোহিঙ্গাদের পাশে থাকার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তবে সফরের দ্বিতীয় দিন রোহিঙ্গাদের একটি ছোট গ্রুপের সঙ্গে তিনি আলাপ করেন। সে সময় রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করে তাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন। এর মধ্যে দিয়েই পোপ মিয়ানমারসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে এই সঙ্কট সমাধানে বার্তা দিয়েছেন। ফলে মিয়ানমারের ওপর আরও চাপ বাড়বে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. ওয়ালিউর রহমান বলেন, পোপ ফ্রান্সিসের ঢাকা সফর অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পোপের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আরও চাপ বাড়বে। রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি সই হয়েছে। এই চুক্তি বাস্তবায়নেও পোপের সফর বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলেও তিনি প্রত্যাশা করেন। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির পোপের ঢাকা সফরের প্রেক্ষিতে বলেছেন, পোপ একজন বিশ্ব ব্যক্তিত্ব। তিনি যেখানে যান, সেখানে তার সঙ্গে বিশ্ব মিডিয়াও সফর করে। এই কূটনীতিকের ভাষ্য, প্রথমে মিয়ানমার, পরে বাংলাদেশ সফরের সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় ছিল, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি কী বলেন। পোপের যথেষ্ট নৈতিক কর্তৃত্ব আছে। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। তার মতে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করে পোপ বাংলাদেশের হাতকে শক্তিশালী করেছেন। এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশেষ করে তাদের নাগরিকত্ব ও দুঃখ-দুর্দশার চিত্র পোপের মাধ্যমে সারা বিশ্ব দেখেছে বলেও মনে করেন তিনি। তিন দিনের ঢাকা সফর শেষে শনিবার রোমের পথে বাংলাদেশ ছাড়ার পর উড়োজাহাজে তিনি সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের কাছে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ না করার ব্যাখ্যা দেন। মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর বিষয়টি দৃঢ়তার সঙ্গেই তুলে ধরেছেন বলে ইঙ্গিত দেন রোমান ক্যাথলিকদের এই সর্বোচ্চ ধর্মগুরু। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকায় রোহিঙ্গাদের তিনটি পরিবারের কাছ থেকে তাদের দুর্দশার কথা শুনতে শুনতে চোখ ভিজে আসার কথাও তিনি সাংবাদিকদের বলেন। তিনি জানান, সেই অশ্রু তিনি লুকাতে চেয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানেই পোপ এশিয়া সফরে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, ঈশ্বরের উপস্থিতি রোহিঙ্গাদের মধ্যেও বিরাজ করছে। রোমের পথে পোপ সাংবাদিকদের বলেন, আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হলো, বার্তাটি ঠিকভাবে পৌঁছে দেয়া, একবারে একটি বিষয়ে কথা বলা এবং অন্যপক্ষের জবাব শোনা। আমি যদি বক্তৃতায় ওই শব্দটি ব্যবহার করতাম, তারা হয়ত আলোচনার পথ আমার মুখের ওপরই বন্ধ করে দিত। প্রকাশ্যে বক্তৃতায় আমি পরিস্থিতিটা তুলে ধরেছি, অধিকারের বিষয়গুলো সামনে এনেছি। বলেছি, নাগরিকত্বের অধিকার থেকে কাউকেই বঞ্চিত করা উচিত নয়। এটা করতে হয়েছে, যাতে একান্ত বৈঠকে আমি আরও কিছু বলতে পারি। বিভিন্ন সময়ে শরণার্থীদের অধিকারের প্রশ্নে এবং তাদের দুর্দশা লাঘবে সরব হওয়া পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গাদের বিষয়েও তার দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরবেন বলে অধিকার সংগঠনগুলোর প্রত্যাশা ছিল। মিয়ানমারে দেয়া ভাষণে পোপ সম্প্রীতির ডাক দিয়ে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীকে সম্মান দেখানোর আহ্বান জানালেও রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ না করায় বিষয়টি সংবাদের শিরোনাম হয়। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ মিয়ানমারের রোমান ক্যাথলিক চার্চ সফরের আগেই পোপকে অনুরোধ জানিয়েছিল, তিনি যেন তার বক্তৃতায় রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার না করেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, পোপের মুখ থেকে ওই শব্দটি এলে মিয়ানমারের খ্রিস্টান ও অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর নতুন করে সহিংসতা শুরু হতে পারে। গত ২৮ নবেম্বর ইয়াঙ্গুনে পৌঁছানোর পরপরই মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাত হয় পোপ ফ্রান্সিসের। ওই বৈঠক বৃহস্পতিবার হওয়ার কথা থাকলেও সেনাবাহিনী শেষ মুহূর্তে বৈঠকের সময় এগিয়ে আনে। ফলে পোপ বেসামরিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বসার আগেই তাকে সেনাবাহিনীর মনোভাব জানিয়ে দেয়ার সুযোগ হয় তাদের। ওই বৈঠকের বিষয়ে পোপ সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার ভাল আলোচনা হয়েছে এবং সত্য প্রকাশে সমঝোতার কোন সুযোগ নেই। সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন কি না-এ প্রশ্নে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, যে বার্তা আমি দিতে চেয়েছি সেজন্য প্রয়োজনীয় শব্দই আমি ব্যবহার করেছি। যখন বুঝলাম, আমার বার্তা তাদের কাছে পৌঁছেছে, তখন আমার যা যা বলার ছিল সবকিছুই বলার সাহস পেলাম। এরপর ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে এক সাংবাদিককে সেই লাতিন প্রবাদটি পোপ বলেন, যার অর্থ- বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচির সমালোচনা করে আসছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তবে পোপ বিষয়টি সেভাবে দেখছেন না। গত ২৮ নবেম্বর সুচির সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে মিয়ানমার রাজনৈতিকভাবে বিকাশের পর্যায়ে রয়েছে। সুতরাং সেই চোখ দিয়েই বিষয়গুলো দেখতে হবে। রাষ্ট্রগঠনের কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারকে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই এগোতে হবে। উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতি থেকে শনিবার পর্যন্ত ঢাকা সফর করেন পোপ ফ্রান্সিস। ঢাকা সফরের সময় রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পোপ।
×