ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শততম দিনেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৪ ডিসেম্বর ২০১৭

শততম দিনেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ হচ্ছে না

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রবিবার পর্যন্ত ১০০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ থামার কোন লক্ষণ নেই। প্রতিদিনই আসছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতিত হওয়া রোহিঙ্গারা। সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, বর্তমানে সর্বোচ্চ দু’লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে উত্তর মংডু রোহিঙ্গা শূন্য হতে খুব বেশি সময় নেবে না। এই শহরের উত্তরাংশে বর্তমানে রয়েছে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য। রোহিঙ্গা ইস্যুটি ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে কারও কাছে আর অজানার বিষয় নয়। বিশ্বের অভিভাবক সংস্থা জাতিসংঘ থেকে শুরু করে খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস পর্যন্ত সকলের কাছে বিশেষ নজর কেড়েছে মগের মুল্লুকের দেশ নামে খ্যাত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী ও উগ্র মগ সন্ত্রাসীরা হত্যা ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও থেকে শুরু করে কি ধরনের অবিশ্বাস্য ও অমানবিক আচরণ করেছে। দশকের পর দশকজুড়ে নিপীড়ন নির্যাতন চলে আসছে রোহিঙ্গাদের ওপর। কিন্তু এবার সে দেশের সেনাবাহিনী যা করেছে তা সর্বসময়ের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। যার কারণে প্রাণ রক্ষায় রোহিঙ্গারা দলে দলে জলে স্থলে যে যেদিকে পারে সে পথে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ গত শনি ও রবিবার দুদিনে আরও চার শতাধিক রোহিঙ্গা সমুদ্র উপকূলবর্তী টেকনাফের হাড়িয়াখালী ও শাহপরীরদ্বীপের জালিয়াপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে। সঙ্গত কারণে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি উঠে এসেছে, আর তা হচ্ছে আর কত রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটলে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে। ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গাধিক্যে কক্সবাজার অঞ্চলে বিশেষ করে উখিয়া টেকনাফে যে বিরূপ পরিবেশের জন্ম দিয়েছে তা থেকে উত্তরণে সহজ ও সহসা কোন পথ আছে কিনা। কেননা অতীতের রেকর্ড বলছে মগের মুল্লুক নামে খ্যাত মিয়ানমার দেশটি রোহিঙ্গা ইস্যুতে ক্রমাগতভাবে মিথ্যাচারেই লিপ্ত রয়েছে। এ মিথ্যাচারে প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হয়েছেন নোবেল বিজয়ী সে দেশের এনলেডি নেত্রী আউং সান সুচি ও সামরিক জান্তা বাহিনী। রোহিঙ্গাদের ক্ষুদ্র একটি অংশকে এরা হাতে নিয়েছে, যাদের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা ‘থাব্যে’ (বেইমান মুনাফেক) নামে আখ্যায়িত করে থাকে। বিশ্বের দেশে দেশে শাসকগোষ্ঠীর হাতে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হওয়ার যেসব রেকর্ড রয়েছে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও ও দেশান্তরি হতে বাধ্য করার এ ঘটনাটি তার মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে শীর্ষস্থানে চলে গেছে। আর এ কারণেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে যেমন আওয়াম উঠেছে তেমনি এর পাশাপাশি নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি মানবতার হাত সম্প্রসারিত করায় বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে প্রশংসা কুড়িযেছে। কিন্তু আর কত মানবতার হাত প্রসারিত করলে রোহিঙ্গা ইস্যুর সুষ্ঠু সমাধান হবে এমন প্রশ্ন আগ্রহী মহলে বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে। পাশাপাশি মানবতা প্রদর্শন করে বাংলাদেশের জন্য আগামীর দিনগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনার বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে। দু’দিনে এসেছে আরও চার শতাধিক ॥ গত তিন মাসের অধিক সময় ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ থেমে নেই। গত দুইদিনে টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অন্তত চার শতাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। গত ২৩ নবেম্বর অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে সমঝোতা স্মারক সম্পাদনের পরও প্রতিদিনই টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। সমঝোতা স্মারক সম্পাদিত হওয়ার পর একদিনের জন্যও থামেনি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। প্রতিদিনই অনুপ্রবেশ ঘটছে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের। আশ্রয় নিচ্ছে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে। এখনও যারা আছে তারা অনেকটা গৃহবন্দী ॥ বাংলাদেশে পালিয়ে না এসে মিয়ানমারের রাখাইনে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গারা নিজ নিজ বসতঘরে অনেকটা গৃহবন্দী অস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে বলে রবিবার ওপারের সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। এছাড়া থেকে যাওয়া এসব রোহিঙ্গাদের ওপর শর্ত আরোপ করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। শর্তসমূহের মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহীগোষ্ঠী আরসা (আল ইয়াকিন) ও আরএসও ক্যাডারদের সংবাদ পাওয়া মাত্রই সন্নিকটস্থ পুলিশ বা সেনা চৌকিতে জানান দেয়া এবং যখনই প্রয়োজন হবে তখনই ডাক দেয়া হবে রোহিঙ্গা পুরুষদের ক্যাম্পে হাজির হতে হবে। মংডুতে রোহিঙ্গাদের জন্য শেড নির্মাণে সামগ্রি মজুদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকায় তিনটি পয়েন্টকে বেছে নিয়ে দেশটির স্থানীয় প্রশাসন। রোহিঙ্গাদের শেড নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি যদি কার্যকর হয় তাহলে পর্যায়ক্রমে তাদের এসব শেডে রাখা হবে। আটক ৫১ ॥ উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে ঘোরাফেরার সময় সন্দেহভাজন ৫১ জনকে আটক ও পরে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে উখিয়া থানা পুলিশ। কুতুপালং ও তৎসংলগ্ন ক্যাম্পে রবিবার রাত ১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে এ ৫১ জনকে আটক করে উখিয়া থানায় নেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয় বলে জানিয়েছে উখিয়া থানার ওসি মোঃ মকসুদুল আলম। নোংরা পরিবেশ ॥ টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থায়ী বাসস্থান, খাবার, চিকিৎসা সেবা, স্যানিটেশন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হলেও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে টয়লেট ব্যবহারে রোহিঙ্গারা অভ্যস্ত না থাকায় সেখানকার পরিবেশ নোংরা অবস্থায় রয়েছে। উখিয়া টেকনাফের বারটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রয়োজনের তুলনায় বহু বেশি রোহিঙ্গার অবস্থান হওয়ায় দিন দিন পরিবেশের অবনতি ঘটছে। সরকার পক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ঘোষিত হলেও সেখানে যাওয়ার পক্ষে রোহিঙ্গাদের কোন আগ্রহ মোটেই নেই। রোহিঙ্গা নারী পাচার ॥ অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর দালাল রোহিঙ্গা নারীদের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে দিচ্ছে। দালালদের মধ্যে পুরনো রোহিঙ্গার সংখ্যাই বেশি বলে জানা গেছে। র‌্যাব সদস্যরা রবিবার অভিযান চালিয়ে ঢাকার ডেমরার সাইনবোর্ড এলাকার একটি বাসা থেকে শিশুসহ তিনজন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার ও মোখলেছুর রহমান ও রাজু মোল্লা নামে দুই দালালকে আটক করেছে। তাদের মালয়েশিয়ায় পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট তৈরির চেষ্টা চলছিল বলে সূত্র জানিয়েছে। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা হচ্ছে- সেতারা বেগম, তাঁর শিশু মেয়ে শফিকা বেগম ও জাহেদা বেগম। আটক দুই দালালকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা এবং উদ্ধার রোহিঙ্গা নারী শিশুকে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এদিকে বালুখালী আশ্রয় ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা নারীকে পাচারের সময় শনিবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুই মৌলবিকে আটক ও সাত মাস করে সাজা দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
×