ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

তাজিক তীরন্দাজ মেহরনার সুনীল স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৯ নভেম্বর ২০১৭

তাজিক তীরন্দাজ মেহরনার সুনীল স্বপ্ন

রুমেল খান ॥ নিশানা আন্দাজ করে তীর ছোড়েন তীরন্দাজ। এটাই তার একমাত্র কাজ। আর সেই কাজটি করতেই বাংলাদেশে পা রেখেছেন তাজিককন্যা মেহরনা। পুরো নাম মেহরনা আভাজোভা। বয়সটা যার সুইট সিক্সটিন। ষোড়শী আভাজোভার রূপের আভায় যেন বিমুগ্ধ ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের আরচারি গ্রাউন্ডের সবাই। যেমন লাজুক, তেমন হাসিখুশিও। ইন্টারভিউয়ের জন্য আবদার করাতে প্রথমে লজ্জাই পেয়ে গেলেন। মিষ্টি হাসি হেসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে বললেন, ‘মাই ইংলিশ ইজ নট গুড। ভেরি ব্যাড ইংলিশ।’ এই বাক্যটিই যে তিনি চমৎকার ইংরেজীতে বলেছেন এবং ‘ব্যাড ইংলিশেই’ যে কাজ চলবে, সেটা অনেক সাধ্য-সাধনা করে বোঝানো গেল! ঢাকায় চলমান এশিয়ান আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে অবশ্য ভাল ফল করতে পারেননি তাজিকিস্তানের দুশানবের নিবাসী মেহরনা। তাই বলে বিষণœ নন তিনি। বরং উৎফুল্ল একাধিক কারণে। প্রথমত দেশের বাইরে সিনিয়র পর্যায়ে এই প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পেরেছেন এবং এখানে এসে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছেন যা তাকে আগামীর পথ চলায় জ¦ালানি দেবে। মা-বাবা দু’জনেই আইনজীবী। দু’জনের উপার্জন মন্দ নয়। তবে মুসলিম এই দম্পত্তির মেয়েটি কি না আইনজীবী না হয়ে বনে গেল তীরন্দাজ! সেটা কিভাবে সম্ভব হলো? স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০০১ সালে পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখা মেহরনা, ‘মূলত আমার মা (গুলরনা কারিমোভা) আরচারি খেলার ভীষণ ভক্ত। তিনি আরচার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। তাই তিনি নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছেন আমাকে দিয়ে। যদিও শুরুতে আমি আরচারি কি জিনিস কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু মা যখন সবকিছু দেখিয়ে দিলেন তখন আমি বেশ মজা পেয়ে গেলাম। গভীর আগ্রহ জন্মাল খেলাটির প্রতি। এভাবেই বেছে নিলাম তীর-ধনুকের খেলা আরচারি। যদিও খুব বেশিদিন হয়নি খেলাটি শুরু করেছি। মাত্র আড়াই বছর ধরে (২০১৫) খেলাটি খেলছি। আমি এখনও শিখছি। পুরোপুরি পেশাদার এখনও হইনি।’ মায়ের কথা বললেন, বাবা কি চান? ‘না, বাবাও (ইলখুম আভাজোভ) আমাকে অনুপ্রেরণা জোগান। তবে মায়ের আগ্রহই বেশি।’ বর্তমানে আরচারিতে তাজিকিস্তানের কারেন্ট চ্যাম্পিয়ন (রিকার্ভে, ২০১৬ সালে) মেহরনার কোন ভাই নেই। একমাত্র ছোট বোন মরিয়ম আভাজোভা। সে অবশ্য কোন খেলাই খেলে না। তবে গভীর আগ্রহ নিয়ে বড় বোনের আরচারির সরঞ্জাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ‘হয়তো আগামীতে মরিয়মও আরচারিতে আসবে।’ মেহরনার ভাষ্য। মেহরনার আরচারির ইভেন্ট হচ্ছে রিকার্ভ। তার প্রথম ও বর্তমান কোচ ফিরুজা যুবাদোভাভা। তিনিও ঢাকায় এসেছেন মেহরনার সঙ্গে। উল্লেখ্য, ফিরুজাও একজন আরচার। তিনিও খেলছেন এই আসরে। তার বয়স ৫০, যা এই আসরে সবচেয়ে বেশি বয়সী আরচারের রেকর্ড। দুশানবের রিপাবলিকান স্কুলের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মেহরনার তীরবাজিতে আন্তর্জাতিক অভিষেক ২০১৬ সালে। ২০১৬ সালে কাজাখস্তানে ১৮ মিটার রিকার্ভে (জুনিয়র) শুরুটা ছিল হতাশ জাগানিয়া। ২০১৭ সালে কিরগিজিস্তানে ৬০ মিটারে (জুনিয়র) অবশ্য প্রথম সাফল্যের মুখ দেখেন তিনি। লাভ করেন তাম্রপদক। এই দুটিই ছিল আন্তঃরুশীয় শূটিং প্রতিযোগিতা। আরচারি নিয়ে ভবিষ্যত লক্ষ্য কী? ‘স্বপ্ন পূরণ করাটা খুবই কঠিন। তবুও আমি চেষ্টা করে যাব। অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতাই আমার একমাত্র স্বপ্ন।’ আত্মপ্রত্যয়ী কণ্ঠ মেহরনার। মজার ব্যাপার হচ্ছেÑ তার আদর্শ আরচার হচ্ছেন কিছু রুশ আরচার, যাদের একজনের নামও অনেক চেষ্টা করে বলতে পারলেন না তিনি! বাংলাদেশে এই প্রথম এলেন। কেমন লাগছে সবকিছু? ‘হুম, দেশটি খুবই সুন্দর। মানুষগুলো মিশুক ও বন্ধুত্বপরায়ণ। আবহাওয়া চমৎকার। খাবার মজার। তবে ট্রাফিক জ্যাম অসহ্য!’ মেহরনার বিশ্লেষণ। তাজিকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল খেলা। তবে মেহরনা কখনও এ খেলাটি খেলেননি। তবে ফুটবল ও বক্সিং খেলা খুব পছন্দ করেন তিনি। শখ বই পড়া এবং এমব্রয়ডারির কাজ করা। প্রিয় কণ্ঠশিল্পী রাশিয়ার ইগর ক্রিদ। প্রিয় অভিনয় শিল্পী যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাড পিট। মাতৃভাষা রুশ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজী এবং জার্মান ভাষাতেও কথা বলতে পারঙ্গম। বাংলাদেশে এতদূর একা একা খেলতে এসেছেন, ভয় লাগছে না? মা-বাবা টেনশন করছেন না? ‘মোটেও না। বাবা-মা মোটেও উদ্বিগ্ন নন, বরং তারা দারুণ উৎসাহী। ফোনে তো রোজই খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।’ তাজিক তীরন্দাজকন্যা মেহরনা আগামী দিনগুলোতে কতটা সফল হবেন সেটা সময়ই বলে দেবে।
×