ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যাপ্টেন কোহলি- দ্য সেঞ্চুরিম্যান

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৯ নভেম্বর ২০১৭

ক্যাপ্টেন কোহলি- দ্য সেঞ্চুরিম্যান

প্রশ্নটা আগেই উঠেছে, বিরাট কোহলি কি মানুষ না অন্য কিছু! আশ্চর্যের মাত্রা ছাড়িয়ে সেটি এখন রীতিমতো গবেষণার বিষয়। শচীন টেন্ডুলকর, রিকি পন্টিং, কুমার সাঙ্গাকারা, না কোহলি? কে সেরা তিনি যখন খেলা ছাড়বেন তখনই উত্তর মিলবে। তবে প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ওয়ান্ডার বয়’। ব্যাট হাতে, নেতৃত্বে গড়ে চলেছেন রেকর্ডের পর রেকর্ড। এবার নাগপুর টেস্টের প্রথম ইনিংসে উপহার দিলেন ২১৩ রানের মনোমুগ্ধকর ইনিংস। এর মধ্য দিয়ে ‘ভারত অধিনায়ক’ হিসেবে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি (১২), সর্বোপরি টেস্ট ইতিহাসে ‘অধিনায়ক হিসেবে’ এক বছরে (ক্যালেন্ডার ইয়ার ২০১৭) সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির (১০টি) নতুন রেকর্ড গড়েছেন কোহলি। এমনকি টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে ব্রায়ান লারার সমান ৫টি ডাবল সেঞ্চুরিতেও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন তুখোড় এই উইলোবাজ! গত মার্চে হায়দরাবাদে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম কোন অধিনায়ক হিসেবে টানা চার টেস্ট সিরিজে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছিলেন কোহলি। এরপর দুটি সিরিজ ঠিক ব্যাটে-বলে হয়নি। রবিবার নাগপুরে তৃতীয় দিনে শ্রীলঙ্কান বোলারদের বাজে বোলিংয়ের সর্বোচ্চ ফায়দা তুেেল পেয়ে গেলেন নিজের পঞ্চম ডাবল সেঞ্চুরি। ২৬৭ বলে ১৭ চার ও ২ ছক্কায় তুলেছেন ২১৩ রান। প্রায় ওয়ানডে গতিতে ছোটা এ ইনিংসেই ব্রায়ান লারাকে ছুঁয়েছেন। টেস্টে এতদিন ‘অধিনায়ক হিসেবে’ সর্বোচ্চ পাঁচটি ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড ছিল ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তির। চার ডাবলে এতদিন ডন ব্র্যাডম্যান, মাইকেল ক্লার্ক, গ্রায়েম স্মিথদের মতো দুর্দান্ত সব অধিনায়কের পাশে ছিলেন। দুর্দান্ত-অবিশ্বাস্য কোহলি এদিন তাঁদেরও ছাড়িয়ে গেছেন কোহলি। উইন্ডিজ গ্রেটকে ছাড়িয়ে রেকর্ডটা পুরেপুরি নিজের করে নিতে আর মাত্র একটি ডাবল সেঞ্চুরি চাই। যেভাবে উড়ছেন তাতে সহসা যে কোন দিনই সেটি হয়ে যাবে! অবশ্য ম্যাচে ডাবলের আগে সেঞ্চুরি করেই রেকর্ড গড়েছেন আরও গোটা কয়েক। অধিনায়ক হিসেবে ১৬ বার পঞ্চাশ পেরিয়েছেন, এর ১২টিই সেঞ্চুরি। ৭৫ শতাংশ ম্যাচেই সেঞ্চুরি, ক্যারিয়ারে কমপক্ষে ১০টি সেঞ্চুরি করেছেন এমন অধিনায়কদের মাঝে এত ভাল ‘কনভারশন রেট’ (ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে রূপ দেয়া) আর কারও নেই। আর ভারতের অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে ১২ সেঞ্চুরি নেই আর কারও। অথচ মহেন্দ্র সিং ধোনির হাত থেকে সাদা পোশাকের দায়িত্ব পেয়েছেন তিন বছরও হয়নি! আর এ সেঞ্চুরিটি এ বছর (২০১৭) সব ফরম্যাট মিলিয়ে কোহলির ১০ম। এক বছরে এর আগে সর্বোচ্চ নয়টি সেঞ্চুরি ছিল রিকি পন্টিং (২০০৫ ও ২০০৬) ও গ্রায়েম স্মিথের (২০০৫)। সে রেকর্ড এখন শুধুই কোহলির। বয়স মাত্র ২৯। অথচ অধিনায়ক-ব্যাটসম্যান হিসেবে সুনীল গাভাস্কার, মোহাম্মদ আজহার উদ্দীনের মতো লিজেন্ডকে ছাড়িয়ে গেছেন। ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে ১১ সেঞ্চুরি নিয়ে এতদিন সবার ওপরে ছিলেন লিটল মাস্টার গাভাস্কার। সেখানে এখন কেবলই কোহলির নাম। ৭, ৫, ৫ ও ৫টি করে টেস্ট সেঞ্চুরিতে এই তালিকায় পেছনে চার সাবেক সুপারস্টার শচীন, মনসুর আলি খান পাতৌদি, সৌরভ গাঙ্গুলি ও ধোনি। এভাবে চলতে থাকলে কোহলির রেকর্ড-পরিসংখ্যান বিশ্লেষনের জন্য সত্যি সত্যি গবেষণাগার তৈরি করতে হবে! পারলে বিরাট কোহলিই পারবে। কথাটা এই সেদিন বললেন শোয়েব আখতার। শচীন টেন্ডুলকরের ১০০ সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে শোয়েব যখন এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন কোহলির, সঙ্গে পাদটীকাও জুড়ে দিচ্ছেন এই বলে, এখনই নাকি টেন্ডুলকার-পন্টিংদের সঙ্গে তুলনা করার সময় আসেনি। কিন্তু যদি করাই হয়, কী ফলাফল আসে? কোহলির সঙ্গে আধুনিক ক্রিকেটের তিন গ্রেট ব্যাটসম্যান টেন্ডুলকর, পন্টিং, সাঙ্গাকারার তুলনা করার মূল সমস্যাটা হলো, শেষ তিনজনের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। ফলে পরিসংখ্যানেও তুলনাটা যথার্থ হবে না। কিন্তু একভাবে তুলনা করাই যায়। কোহলির ক্যারিয়ারের ঠিক এই মুহূর্তে বাকি তিনজন কে কোথায় ছিলেন? কোহলির ক্যারিয়ারে ৫০তম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি পূর্ণ হলো। বাকিরা ৫০তম সেঞ্চুরি পূর্ণ করার সময় কে কোথায় ছিলেন, সেটি দেখে নেয়া যাক: কোহলি ৫০তম সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছেন ৩১৮ ম্যাচে বা ৩৪৮ ইনিংসে। এত কম ইনিংস বা ম্যাচে আর কেউ ৫০তম সেঞ্চুরি পূর্ণ করতে পারেননি। বয়সের দিক দিয়ে কেবল টেন্ডুলকার এগিয়ে আছেন। সেটি টেন্ডুলকার ১৬ বছর বয়সে ক্যারিয়ার শুরু“করেছিলেন বলে, আর কোহলির ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ২১ বছর বয়সে। ৫০তম সেঞ্চুরি পেতে টেন্ডুলকারকে খেলতে হয়েছে কোহলির চেয়ে ২৪ ইনিংস বেশি। পন্টিংকে ৭১ আর সাঙ্গাকে ২৪০ ইনিংস বেশি খেলতে হয়েছে ৫০ নম্বর আন্তর্জাতিক শতরানটি পেতে। তিনজনই বেশি ইনিংস খেলেছেন বলে ৫০তম সেঞ্চুরির সময় তিনজনের রান সে তুলনাতেই বেশি হয়েছে কোহলির চেয়ে। ৫০তম সেঞ্চুরিতে দাঁড়িয়ে বাকি তিনজনের রান কোহলির চেয়ে বেশি হলেও এটি তার জন্য পিছিয়ে থাকার কোনো চিহ্ন নয়; বরং এগিয়ে থাকারই প্রমাণ। কোহলির ৫০ সেঞ্চুরির ১৮টি টেস্টে। আসলে ওয়ানডের তুলনায় টেস্টে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তেমন সাফল্য পাচ্ছিলেন না। কিন্তু দ্রুতই কোহলি টেস্টেও অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটতে শুরু করেন। টেন্ডুলকারের প্রথম ৫০ সেঞ্চুরির আধাআধি টেস্ট-ওয়ানডেতে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ওয়ানডেতে দুটি সেঞ্চুরি বেশি করেছিলেন। টেস্টে ছিল ২৪ সেঞ্চুরি। কিন্তু পন্টিং ও সাঙ্গা দুজনই ৫০তম সেঞ্চুরির সময় টেস্টেই বেশিরভাগ সেঞ্চুরি তুলেছিলেন। পন্টিংয়ের টেস্ট সেঞ্চুরি তখন ছিল ৩০টি, সাঙ্গার ৩৩। এখান থেকে মনে হতে পারে, কোহলি হয়ত এখানে এই তিনজনের চেয়ে পিছিয়ে। কিন্তু ইনিংস সংখ্যার দিকে তাকালে বুঝবেন, কোহলি টেস্টে তিনজনের থেকে পিছিয়ে আছেন এমন বলার সুযোগ নেই। বরং বাকি তিনজনের সমান ইনিংস খেললে কোহলির টেস্ট সেঞ্চুরির সংখ্যা এই তিনজনের চেয়েও যে সে সময় বেশি থাকবে না, কে নিশ্চিত করে বলতে পারে? একইভাবে রানটাও ইনিংসের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে নিশ্চয়ই। সাঙ্গাকারা ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তেও ছিলেন আরও উজ্জ্বল। পন্টিং যদিও কিছুটা ম্লান হয়ে পড়েছিলেন। তিন গ্রেটের তুলনায় কোহলি কতটা দ্রুতগতিতে ছুটছেন, তা সবচেয়ে ভাল বোঝা যায় আসলে ওয়ানডেতে। ৫০তম সেঞ্চুরির সময় টেন্ডুলকার ও পন্টিং দু-জনেরই ওয়ানডেতে রান ছিল ৯ হাজারের ঘরে। কোহলিরও তা-ই। অথচ টেন্ডুলকর ও পন্টিং যেখানে যথাক্রমে ২৪৭ ও ২৪৫ ইনিংসে এই কীর্তি ছুঁয়েছিলেন, কোহলির লেগেছে মাত্র ১৯৪ ইনিংস। সাঙ্গার সঙ্গে এখানে ব্যবধান তো আরও বেশি। ৩৪১ ইনিংস লেগেছিল লঙ্কান কিংবদন্তির! কোহলির গ্রাফটা নিশ্চিতভাবেই তাই তিনজনের চেয়ে বেশ ওপরে দিয়েই এগোচ্ছে। কিন্তু তিনজনই তাদের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে একই রকম দাপট দিয়ে খেলেছেন। সাঙ্গা তো ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় আরও বেশি উজ্জ্বল ছিলেন। ওয়ানডেতে সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে অবসরে গেছেন। আর টেস্টে অবসর নেয়ার পরও ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অবিশ্বাস্য সব কীর্তি গড়ে লঙ্কান সমর্থকদের আক্ষেপ বাড়িয়েছেন। কোহলি আরও ৬-৭ বছর খেলবেন নিশ্চয়ই। বাকিটা পথ তিনি কত দূরে যান, সেটাই শেষে ঠিক করে দেবে ইতিহাসে তাঁর স্থান।
×