ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষিকার শ্লীলতাহানিকারী সেই প্রধান শিক্ষকের কান্ড-

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২৭ নভেম্বর ২০১৭

শিক্ষিকার শ্লীলতাহানিকারী সেই প্রধান শিক্ষকের কান্ড-

বিভাষ বাড়ৈ ॥ শিক্ষিকার শ্লীলতাহানির মামলায় আসামি খিলগাঁও গবর্নমেন্ট স্টাফ কোয়ার্টার হাইস্কুলের সেই প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে এবার শিক্ষা অধিদফতরের স্বাক্ষর জাল করে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষিকার শ্লীলতাহানির মামলায় গ্রেফতারের পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নির্দেশে সাময়িক বরখাস্ত হলেও জামিন নিয়ে মাউশি অধিদফতরের ভুয়া প্যাড বানিয়ে সহকারী পরিচালক দুর্গা রানী সিকদারের স্বাক্ষর জাল করে সে চিঠি পাঠিয়েছেন বিদ্যালয়ে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের কাছে পাঠানো চিঠিতে অধিদফতরের পক্ষ থেকে বরখাস্ত সেই শিক্ষককে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে বলার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে। জালিয়াতির ঘটনা ইতোমধ্যেই নজরে এসেছে অধিদফতরের। মহারিচালক অধ্যাপক ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেছেন, জালিয়াতি প্রমাণ হলে রক্ষা নাই। আইন অনুসারে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব আমরা। যার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে সেই সহকারী পরিচালক বলছেন, আমার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। এমন কোন চিঠি আমরা দেইনি। লিখিতভাবে ওই স্কুল আমাদের কাছে জানিয়েছে। এখন আইন অনুসারে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দু’এক দিনের মধ্যেই ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন আইন শাখার কর্মকর্তারা। এর আগে গত ১৫ জুন প্রতিষ্ঠানেরই এক শিক্ষিকার শ্লীলতাহানির মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর খিলগাঁও গভর্নমেন্ট স্টাফ কোয়ার্টার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ প্রকাশের পর নানা অপকর্মে জড়িত এ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতিসহ কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য মাউশি মহাপরিচালক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এরপরও নিজস্ব তদন্তে অপরাধের প্রমাণ পাওয়ার পর মাউশি তার বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আদেশ জারি করে। একই সঙ্গে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আদেশের কপিও পাঠায় মাউশি। মাউশির সহকারী পরিচালক দুর্গা রানী শিকদার স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, ঢাকা মহনগরীর খিলগাঁও থানাধীন খিলগাঁও গভঃ স্টাফ কোয়ার্টার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সরদার মোঃ হেলাল উদ্দিন কর্তৃক খন্ড-কালীন এক শিক্ষিকার শ্লীলতাহানির অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ অবস্থায় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। তবে এই মামলায় কিছুদিন পর আদালত থেকে জামিন পান সে শিক্ষক হেলাল উদ্দিন। জামিন পেয়েই তিনি নানা কৌশলে বিদ্যালয়ে যোগদানের পাঁয়তারা করতে থাকেন। দু’একজন নেতার মাধ্যমে বিদ্যালয়ে চাপ সৃষ্টি ও অধিদফতরে আসা যাওয়া শুরু করেন। তবে অধিদফতর থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, আইন অনুসারে তার এখন মামলায় খালাস না পাওয়া পর্যন্ত স্বপদে ফেরার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় অধিদফতরের প্যাড বানিয়ে ভুয়া আদেশ জারি করে বিদ্যালয়ে যোগদানের অপকৌশল নেয় বলে মনে করছেন মাউশি কর্মকর্তারা। এজন্য সে যার স্বাক্ষরে সাসপেন্ড হয়েছিলেন সেই সহকারী পরিচালক (মাধ্য-২) দুর্গা রানী সিকদারের স্বাক্ষর জাল করে নিজেই জারি করেন সরকারী আদেশ। মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক), ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার, ওই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রাবেয়া বেগমের কাছে পাঠানো আদেশের বিষয় হিসাবে বলা হয়, ‘ প্রধান শিক্ষক পদে দায়িত্ব পালন প্রসঙ্গে’। বলা হয়, প্রধান শিক্ষক শিক্ষক খিলগাঁও গভঃ স্টাফ কোয়ার্টার হাই স্কুলের আবেদনের প্রেক্ষিতে জানা যায়, ম্যানেজিং কমিটি কর্তৃক অসদাচরণের দায়ে ১৫/০৬/২০১৭ তারিখ সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তকালীন তারিখ হতে ৬০ দিন অতিবাহিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে রুজু করা মামলায় আদালত জামিন প্রদান করায় উক্ত বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে দায়িত্ব পালনে কোন বাধা নেই। এ অবস্থায় হেলাল উদ্দিনকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে দায়িত্ব প্রদান করতে সভাপতিকে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। তবে অধিদফতরের সহকারী পরিচালক দুর্গা রানী সিকদার জনকণ্ঠকে বলেন, পুরো জালিয়াতি করা হয়েছে। আমরা তাকে যোগদান করতে দিতে কোন আদেশ দেইনি। যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তা আমরা হাতে পেয়েছি। স্কুল কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে আমাদের দিয়েছে। আমাদের চিঠি নয় সেটা। আমার স্বাক্ষরও জাল করা হয়েছে। এখন কি পদক্ষেপ নেবেন? এমন প্রশ্নে কর্মকর্তা বলেন, আইন শাখায় আমরা পাঠিয়েছি। দ্রুত আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কি আইনী ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে? এমন প্রশ্নে আইন শাখার কর্মকর্তারা বলেছেন, যেহেতু জালিয়াতি মাউশির সঙ্গে সেহেতু এখন মহাপরিচালক স্যার চাইলেই আমরা প্রতারকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারি। এমন চিন্তাভাবনাই চলছে। অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রাবেয়া বেগম বলছিলেন, চিঠি পেয়েই আমাদের সন্দেহ হয় যে এটা মাউশির নয়। চিঠি পাঠানো হয় ডাকযোগে। সাময়িক বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক আসেননি। মাউসিকে জানিয়েছি। এখনও আমাদের প্রতি কোন নির্দেশ আসেনি। অন্যদিকে সভাপতি আলমগীর চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ আমরা চিঠি পেয়েছি। চিঠি হেলাল উদ্দিনই পাঠিয়েছেন। তবে তিনি আমাকে বলেছেন পাঠাননি। তিনি নাকি জানেন না। এখন প্রকৃত ঘটনা অস্বীকার করবেন তিনি। তাহলে এখন কি ব্যবস্থা নেবেন? এমন প্রশ্নে সভাপতি বলেন, তার বিরুদ্ধে মামলা আছে। তাকে বরখাস্ত করেছে মাউশি। আমাদের কিছু করার নেই। তাকে আমরা যোগ দিতে বলতেও পারিনা। মাউশি বলেছে তারা চিঠি পাঠায়নি। এখন জালিয়াতি করলে মাউশি যে ব্যবস্থা নেবে আমরা সে অনুসারে চলব। তবে আমাদের পক্ষ থেকেও কিছু করার আছে কিনা তা দেখার জন্য দ্রুতই গবর্নিং বডির সভা ডাকা হবে। এদিকে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি কথা বলার। তার সেলফোনে কল করা হলে অপর প্রান্ত থেকে একজন পরিচয় জানতে চান। পরিচয় বলা হলে বলা হয়, তিনি বাসার বাইরে। এরপর যোগাযোগের ব্যবস্থা জানতে চাইলে বলা হয়, বাসায় আসলে জানাবেন। এরপরই সেলফোন বন্ধ করে দেয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, এ বরখাস্ত প্রধান শিক্ষকের সকল অনিয়মের মদদদাতা হচ্ছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের এপিএস পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা অপকর্ম করে যাচ্ছেন। পরিচালনা পরিষদের কেউ না হলেও তার মাধ্যমেই শিক্ষকদের হয়রানিসহ নানা অপরাধ করেছেন প্রধান শিক্ষক। তার অপকর্মে অতিষ্ঠ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাও। এছাড়াও খিলগাঁও এলাকার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে নিয়োগ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টাকার বিনিময়ে সহায়ক বই পাঠ্য করাসহ নানা অনিয়মে এ ব্যক্তি। ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মহিলা শিক্ষক থেকে শুরু করে ছাত্রীদেরও যৌন হয়রানির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে ওই ব্যক্তি বিতর্কিত ওই শিক্ষককে মদদ দিচ্ছেন।
×