ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ইতিহাস উন্মোচন ও রাজনীতির বিষফোঁড়া দমন

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২৬ নভেম্বর ২০১৭

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ইতিহাস উন্মোচন ও রাজনীতির বিষফোঁড়া দমন

দেশের রাজনীতির বিষফোঁড়া আসলে কি বা কারা? এই প্রশ্নের উত্তর জাতির জানা জরুরী। আমি মনে করি, আমাদের ইতিহাস বিকৃতি আর জাতিকে পাকিকরণের গুরু বিএনপি যে লোকসান করিয়েছে জামায়াতও তা পারেনি। মনে রাখতে হবে দেশ স্বাধীনের পর জামায়াত ছিল না। আর এদিকে উচ্চাভিলাষী জিয়াউর রহমান তার স্বার্থে গতায়ু মুসলিম লীগ আর এদের দলে টেনে এনেছিলেন। পুরনো কাসুন্দি থাক। বলছিলাম আমাদের যে নতুন প্রজন্ম তারা আজ আওয়ামী বিএনপির দ্বন্দ্বে ইতিহাস না জানলে আখেরে কার লাভ? এই যে নিয়ত ইতিহাস বিকৃতি এর বাইরে কত প্রমাণ কত নজীর আর কত কত কাহিনী। আমরা কি সেগুলো নবপ্রজন্মের কাছে তুলে ধরছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৬ বছর আগে। এখনও আমাদের ইতিহাস বিকৃতি হানাহানি আর লড়াই শেষ হয়নি। আজকের প্রজন্ম এই লড়াই বা নিজেদের বিকৃতির কালে জানেই না কত গভীর আর মমতায় ভরা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আমরা নিরস্ত্র দুর্বল আর ভীতু নামে পরিচিত এক জাতি। লড়াই করেছিলাম যুদ্ধবাজ উন্মাদ এক সেনা বাহিনীর সঙ্গে। পুরনো ইতিহাস মানে দুটো বিবদমান দলের কাহিনী না। এটা স্বচ্ছ আর জলের মতো পরিষ্কার বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের চাকায় ধাবমান। যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রাণপণ চেষ্টা করে ইতিহাস শুদ্ধ করার কাজ করেছেন বলে আমরা তাঁকে কোথায় সমর্থন দেব সেটা না করে রীতিমতো বিরোধিতা করে চলেছি। তিনি প্রায়ই সংসদে দাঁড়িয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাবার কথা বলেন। আমরা বুঝে নিই এর মমার্থ কি। কি নিষ্ঠুর বাস্তবতা আমাদের। ব্যক্তিজীবনে ধর্মের আচরণের বা নিয়মের সঙ্গে থাকা আমরাই বেনিয়মী একজনকে নেতা বানাতে বদ্ধপরিকর। যিনি নিয়ম মানেন যিনি মূলত ধার্মিক তাঁর কাছে বিশ্বাস জমা রাখার ভেতর নেই আমরা। কেন এই হঠকারী প্রবণতা? কদিন আগে সামাজিক মাধ্যমে শহীদ আলতাফ মাহমুদের সন্তান শাওন মাহমুদ শহীদ আফ্রিদিকে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তাতে তিনি দুঃখ ও রাগ প্রকাশ করে ঝাড়ি দিয়েছিলেন এই খেলোয়াড়কে। যে কিনা অনায়াসে বাংলাদেশকে তার নিজের দেশ বলছে। ভালবেসে কেউ আমাদের দেশকে নিজের দেশ ভাবলে আপত্তির কিছু থাকে না। বরং আমরা আনন্দিত হই। কিন্তু হুমায়ূন আজাদের সেই অমোঘ বাণীর কথা ভুললে চলবে না। যেখানে তিনি বলেছিলেন, সাপ আর পকিস্তানীদের বিশ্বাস করা সমতুল্য। এটা কোন ভাবাবেগের কথা না। এর পেছনে হাজারো যুক্তি আছে। যারা এত বছর পরও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের পরাজয় ও আত্মসমর্পণ মানতে পারে না তাদের আমরা নিজেদের লোক ভাববো কিভাবে। এই সেদিনও ইমারন খান তার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন যুদ্ধাপরাধী বিচার নিয়ে। মূলত তাদের আক্রোশ আওয়ামী লীগের ওপর। যারা পাকিস্তান থেকে এই মাটিকে আলাদা করার সংগ্রাম করেছিল। আজ তাই সময় এসেছে আমাদের ইতিহাস নিয়ে নিজেদের বুকের পাটা শক্ত করে দাঁড়াবার। দুদিন পর বিজয়ের মাস বলে আমরা যখন হৈচৈ করব তখনও দেখবেন মন জয় করা কোন পাকি ক্রিকেটারের জন্য প্ল্যাকার্ড হাতে ছুটছে নারীর দল। এই কারণে আমাদের প্রকৃত ইতিহাস জানা দরকার। যেসব মানুষ যেসব মনীষা আর যেসব কাহিনীর জন্য বাংলাদেশ উজ্জ্বল তার গৌরব চিরজাগরুক সেগুলো মুছে কেউ এগুতে পারবে না। আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ত্যাগী কত মানুষের জীবনকাহিনী অজান্তে হারিয়ে যায়। তারুণ্য জানেই না। এই যে অস্ট্রেলিয়ায় শায়িত ডাচ অজি বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড তার মতো কজন মুক্তিযোদ্ধা আছে আমাদের? যিনি পঁচাত্তরের পর বঙ্গবন্ধু হত্যায় উল্লাস করার কারণে কর্মী ছাঁটাইয়েও পিছপা হননি। এদের কাহিনীর প্রসার হোক। তখন কোথায় ভেসে যাবে ঘোষক আর কোথায় থাকবে অপইতিহাস। শেষ করব অমনই এক বীরের কাহিনী দিয়ে যার কর্ম আর নিবেদনে আমাদের যুদ্ধ জয় সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল। আজ যখন আমরা এত মিডিয়া যোগাযোগের পরও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশ্বের মনোযোগ সেভাবে আকর্ষণ করতে পারি না তখন এঁদের জানা ও চেনা জরুরী বৈকি। যত বীরত্বের কাহিনী বের হয়ে আসবে তত বিএনপি কোণঠাসা হবে। কারণ বীরগাঁথার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গীরাই জড়িয়ে। সেখানে কারও বাঁশীর ফুঁ কাজ করেনি। আজ আমরা এক বিভ্রান্ত প্রজন্মের কাছে জিম্মি। যারা জানে না কিভাবে এদেশের জন্ম হয়েছিল। যারা জানলেও মানে না তারাই দায়ী। কত বিচিত্র মনোরম আর চিত্তস্পর্শী সেসব ঘটনা। এত বছর পরও মনে হবে জীবন্ত। ইতিহাস তো তাই। তার পরতে পরতে থাকা অজানা লোমহর্ষক সব ঘটনা। দেশ বিদেশের অজস্র মানুষ মেধা আর মনীষা যে কারণে আমাদের হয়ে লড়তে চেয়েছিলেন আজ আমরা সে কারণ থেকে দূরে। আমাদের দেশে এখন সাম্প্রদায়িকতা মহামারী। কেউ কিছু বললেই ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। এমন সব ঘটনা ঘটে মনে হবে দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল অকারণে। এই নাগপাশ তৈরির কারিগর বিএনপি। ইতিহাস বিভ্রান্ত এই জাতিকে মাথা তুলে বাঁচতে হলে উন্নয়নের পাশাপাশি চাই সঠিক দিক নির্দেশনা। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, দেশ বিদেশের বীরদের কথা তুলে ধরুন। তাঁদের মহান কাহিনীতে ভেসে যাক জাতীয়তাবাদের চক্রান্ত। জাতীয়তাবাদীদের ভুল ধরিয়ে দিতেও এগুলো কাজ করবে। সে সময় যারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের অবদান আর সমর্থন ছাড়া আমাদের জয় ছিল প্রায় অকল্পনীয়। তখন এমন মিডিয়া বা যোগাযোগ ছিল না। ছিল না মোবাইল কম্পিউটার কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জয়জয়কার। তারপরও সেই সুদূর ফরাসী দেশের এই মানুষটি আমাদের হয়ে লড়তে চেয়েছিলেন। সে দেশের মন্ত্রী ছিলেন তিনি। দশ বছর মন্ত্রী থাকা সত্তর বছর বয়সে পা দেয়া মানুষটি বলেছিলেন, আমাকে একটি ফাইটার বিমান দাও, আমি বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধে করব। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের আগেও তিনি দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিলেন কম্বোডিয়ায়। অনেকে হয়তো জানেন না কম্বোডিয়ার নাম কম্পুডিয়া সে কারণেই। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে অতিথি হয়ে আসেন তিনি। আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তো আমি নিশ্চিত চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির ভিত্তিপ্রস্তর উৎকীর্ণ করেছিলেন এই মহতী মানুষটি। তাঁর যুদ্ধে যাবার ইচ্ছে কতটা আন্তরিক ছিল তার প্রমাণ দেড় শতাধিক ফরাসী যোদ্ধা নিয়ে গঠিত বাহিনী। পরে শক্তিশালী ভারত যুদ্ধে জড়িত হবার কারণে তিনি সে পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন। বাংলাদেশ সফরের সময় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে গিয়ে বেদনার্ত মালরো প্রমাণ করেছিলেন তিনি আমাদের কতটা আপন। বলাবাহুল্য, তাঁর মত মহতী মানুষদের কারণেই ফ্রান্সের মতো দেশ আপন উজ্জ্বলতায় আমাদের গোড়াতেই স্বীকৃতি দিয়েছিল। স্বনামধন্য লেখক বহু পুরস্কার জয়ী আঁদ্রে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণ হিসেবে বলেছিলেন, এর কারণ শুধু এই নয় যে, বাংলাদেশ এখন ‘সবচেয়ে নির্মম গণহত্যার শিকার আর সবচেয়ে হুমকির মুখে থাকা’ এক জনপদ। কারণ এটাও যেÑ ‘আপনারা মহান ভারতীয় সভ্যতার অংশ যা কিনা তিন হাজার বছর পুরনো আধ্যাত্মিকতায় সমৃদ্ধ এক সভ্যতা।’ আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে প্রশ্ন রাখি, আমরা কি তাঁকে আদৌ মনে রেখেছি? মনে রেখেছি সম্প্রতি শততম জন্মবাষির্কীর ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনীকে? যিনি না হলে আমরা এই দেশ আদৌ পেতাম কিনা সন্দেহ জাগে। যে সভ্যতা যে আলোর কথা আদপে মালরোররা বলেছিলেন আজ আমরা তা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। আমাদের মার্জনা করবেন আঁদ্রে। আমরা আপনাদের মনে না রাখলেও এই দেশ মাটি পতাকা ভালবাসা যতদিন আলোকময় থাকবে ততদিন আপনারা বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের ইতিহাসে।
×