ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ইকতিয়ার চৌধুরী

রোম সাতাশ বছর আগে

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২৪ নভেম্বর ২০১৭

রোম সাতাশ বছর আগে

খুব ভোরে আমি ভূমধ্যসাগরের পাড়ে জেনোভাতে জেগে উঠলাম। ডিসেম্বরের সকাল। কম্পার্টমেন্টের বাইরে কুয়াশা। কুয়াশা কাটা ট্রেনের গতি দ্রুত। পঁচিশ-ত্রিশ গজ দূরত্বে সাগরের কিনার দিয়ে ছুটছে ট্রেনটি। সমুদ্রের জল এত নীল আগে কখনও দেখিনি। আজকাল আমি আমার প্রথম সমুদ্র দর্শনের স্মৃতিতে ব্যথা অনুভব করি। সেবার সেই সাগর স্নানে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল একজন নিসর্গ পাগল মেয়ে এলিস ও ওঁর স্বামী । তাঁদের সঙ্গে আরও একটি পরিবার সমুদ্রে যাচ্ছে। আমিও জুটে গেলাম। ঢাকার ফুলবাড়িয়া থেকে আন্তঃজেলা বাসে সাতঘণ্টায় চাটগাঁ পৌঁছাই আমরা। বিকেলে পতেঙ্গায় এক চিলতে সমুদ্র দেখি। ওই প্রথম। এখন আমার মাঝে মাঝে কষ্ট জাগে কেন যে বিশাল অবারিত সাগর দর্শন দিয়ে আমার যাত্রা শুরু হলো না। অবশ্য পতেঙ্গার পরদিন কক্সবাজারে বঙ্গোপসাগর যে বিপুল বিস্ময়ে আমাকে আলোড়িত করে তাতে সমুদ্রের প্রতি আমার দুর্বার আকর্ষণ চিরকালের জন্য স্থায়ী হয়ে যায়। আনবিক শক্তি কমিশনের অতিথিশালা নিবাস ছিল আমাদের। তখন পর্যন্ত সমুদ্রের অত ধারে আজকের মতো থাকার আবাস গড়ে ওঠেনি। যখন রাতে পূর্ণ জোয়ার, আমি আর এলিস রেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে পড়ি। ভেসে আসছে সাগরের কলরোল। মাঝে মাঝে তা উঁচু মাত্রায় উঠে গর্জনে রূপান্তরিত হচ্ছে। জ্যোৎস্নার প্লাবনে স্পষ্ট চারদিক। ছোট ছোট ঘরবাড়ি, অনুচ্চ পাহাড় আর বনভূমি। এলিস আমাকে বলে, ‘আজ রাত পূর্ণিমার, সাগর এখন মাতাল। তার অনুচ্চারিত কথামালা বোঝা যায় না শুধু অনুভব করা যায়।’ প্রতি বছর সমুদ্রে আসে এলিস। ওঁর অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে আমার চেয়ে সমৃদ্ধ। খালি পায়ে আমরা বালির ওপর দিয়ে হেঁটে আসি সমুদ্রের পানে। সামান্য পথ। জলের গর্জন প্রবলতর হয়ে কানে প্রবেশ করে। পাড়ের দৃশ্য আমাকে নির্বাক করে দেয়। দিগন্তজুড়ে বিশাল জলরাশি রুপোলি দেহে ঢেউ ভাঙছে। সেই ঢেউ প্রবলতর হয়ে ফুঁসে পড়ছে সাগর পাড়ে। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে বাতাস। সমুদ্রের বুক ফুলে ফুলে উঠছে। সঙ্গে প্রচণ্ড গর্জন। তাতে হাওয়ার শো শো ধ্বনি মিশে সমগ্র পরিবেশকে করে তুলছে আরও উতলা। সাগরের সশব্দে ফেঁপে ফেঁপে ওঠায় মনে হয় সমুদ্র উঠে আসবে আজ রাতে মাটির পৃথিবীতে। এলিসের খোঁপা ভেঙে যায়। কাঁধের ওপর দিয়ে লম্বালম্বী উড়তে থাকে আঁচল। বুকের শাড়িতে টান পড়ায় দেহের ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমি সাগরের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিই। সাগরকে মনে হয় বেশি মোহময়। এর দু’বছর পর বোম্বেতে আরব সাগরকে ভালো লাগেনি অত। তার মেটে রঙের জল আর মেরিন ড্রাইভ এলাকার ছোট্ট সৈকত জুহুতে মুগ্ধ হতে পারিনি। জুহুর তুলনায় কক্সবাজার বিচ অনেক অনেক ঢালু ও দীর্ঘ। পাতিয়াতে বে অব থাইল্যান্ডের বিচ কক্সবাজার সৈকতের মতো দীর্ঘ ও ঢালু না হওয়া সত্ত্বেও চমৎকার। কারণ পর্যটনের জন্য সেখানকার আয়োজন ভাল। নৈসর্গিক দৃশ্য মনোমুগ্ধকর আর সাগরের জলও নীল। সেগুলোর তুলনায় ভূমধ্যসাগরের পানিকে লাগছে বেশি নীলাভ। দিগন্ত মিশেছে জলে। মনে হচ্ছে শ্লেট রঙা আকাশ নেমেছে সাগরে। আমি আর সৌমিত্র চাকমা এখন ইতালিতে। সৌমিত্র পররাষ্ট্র সার্ভিসে আমার সহকর্মী। নেপলসগামী আন্তঃইউরোপীয় ট্রেনে রোমা অর্থাৎ রোমের উদ্দেশ্যে ছুটছি। নেপলস ইতালির একটি শহর। বিশ্ব বিখ্যাত আর্জেন্টেনীয় ফুটবলার বুয়েন্সআয়ারের মুক্ত মানব দিয়েগো ম্যারাডোনা ১০নং জার্সি নিয়ে খেলেছেন সেখানকার নেপোলীর হয়ে। ভোর রাতে একবার ঘুম ভেঙেছিল আমার। তখন ট্রেনটি দাঁড়িয়েছিল ফ্রান্স-ইতালী সীমান্তে ইতালীর ছোট্ট একটি স্টেশনে। অনুজ্জ্বল হলুদ আলোয় যতটুকু দেখা যাচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছিল তুষারে চাপা পড়ে আছে সমগ্র এলাকাটি। সেটি বিশেষ সম্ভব টরিনো অঞ্চল। বরফে ছাওয়া এরকম ধবধবে সাদা প্রান্তর আমার অভিজ্ঞতায় প্রথম। প্রচণ্ড শীত। তাপমাত্রা ছয় ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে আট ডিগ্রী সেলসিয়াসের ভেতর। কাস্টমস চেকিং চলায় ট্রেনটি দাঁড়িয়েছিল অলস ভঙ্গিতে। তবে তার হিটিং ব্যবস্থা সচল থাকায় যাত্রীরা ছিলাম সবাই উষ্ণ। গেল বিকেলে প্যারিসের গার দ্য লিও থেকে যাত্রা শুরু করেছি আমরা। প্রথমে আমাদের সহযাত্রী ছিল একটি ফরাসি পরিবার। মা তার দুছেলে নিয়ে পাহাড়ে যাচ্ছে স্কি করতে। মহিলাটি স্কার্ট পরিহিত। দারুণ শীতেও এত সংক্ষিপ্ত পোশাক পরার দুঃসাহস এরা কোথা থেকে যে পান ঈশ্বর মালুম। রাত বারোটার পর তারা নেমে গেলেন। এখন কামরায় আমরা ছাড়া আরও তিনজন। এক ভদ্রলোক আর একজন মহিলা তার তরুণী কন্যাকে নিয়ে ঝিমুচ্ছেন। সবার চোখে মুখে অসম্পূর্ণ ঘুমের চিহ্ন। আমি বাইরে তাকাই। সাগরের বিস্তার ফুরোয় না। দীর্ঘ সময় ধরে ট্রেনটি সমুদ্রের পাড় ধরে ছুটে চলে। অথৈ জলের নীলে ছোট ছোট ঢেউ। নিঃস্তরঙ্গ পানিতে হাওয়ার চাপড়ে যেমন ঢেউ ওঠে কতকটা ওই ধরনের। ঢেউয়ের মাথায় শিশু সূর্য রশ্মির দাপদাপি আমার মনে অনির্বচনীয় আনন্দের জন্ম দেয়। একটি ছোট্ট লোকালয় পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা। প্রাতঃভ্রমণরত আট-দশজন প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তাদেরকে আমার মনে হয় ফজরের প্রার্থনা ষে মসজিদের বাইরে আলাপরত মুসল্লিদের মতো। তাদের ফুসফুস ভূমধ্যসাগরের নির্মল বায়ুতে পূর্ণ। তারা নিশ্চয় নিরোগ দেহ এবং দীর্ঘ জীবন লাভ করবেন। প্রত্যুষেই মহিলাটি কথা ওগরাতে শুরু করেছেন এবং তাকে বেশ আলাপী মনে হচ্ছে। রোমে আমরা কতক্ষণে পৌঁছুব জানার জন্য তাকে জিগ্যেস করি, নুজালো আ রোম আ ক্যালঅর (আমরা ক’টায় রোমে পৌঁছুব)? আমার ফরাসী ভাষা শিক্ষার বয়স দুমাসের সামান্য বেশি। তাই চর্চা চালিয়ে যেতে ইংরেজীর বদলে ফ্রেঞ্চকেই বেছে নিলাম। মহিলা তাকিয়ে হাসলেন, কী যেন জানতে চাইলেন পাশের ভদ্রলোক থেকে। পুরুষটি জবাব দিল, আপ্রে মিদি ( দুপুরের পর)। এরপর আমাদের আলাপ শুরু হলো ইংরেজী আর ভাঙা ভাঙা ফরাসীতে। মহিলা বলল, তোমরা আসছ কোত্থেকে? সৌমিত্র জবাব দেয়, ভিশি। ভিশি ফ্রান্সের একটি ছোট্ট পর্যটন শহর। ছিমছাম। ছবির মতো দেখতে না বলে বলা উচিত ভিশির মতো সুন্দর দৃশ্য ছবিতে দেখা যায়। কাল প্যারিস থেকে যাত্রারম্ভ করলেও আমরা মূলত আসছিলাম ভিশি থেকে। তরুণী মেয়েটি তখন জানতে চায়, এটি কোথায়? ভিশি প্যারিস থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে। ১৯৩৯-১৯৪৫ সময়কালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভে জার্মানি ফ্রান্স অধিকার করলে মার্শাল পেঁতা এখানে পুতুল সরকার গঠন করেন। উত্তর ফ্রান্স শিল্প ও খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ হওয়ায় জার্মান নেতা মসিয়্যু হিটলার ওই অঞ্চল নিজের অধিকারে রেখে দক্ষিণের কৃষিনির্ভর এলাকা ছেড়ে দেন অনুগত ফরাসী সরকারকে। সরকার প্রধান মার্শাল পেঁতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন বীর অর্থাৎ ওয়ার ভ্যাটেরান। রোম থেকে আবার ভিশিতেই ফিরব আমরা। ওখানকার হোটেল স্যাম ব্লেজে আমাদের দিনগুলো ভালোই ছিল। কামরার এক কোণে কিচেনের ঘের। সেখানে গ্যাস চুলো আর রান্নার সরঞ্জাম। পানির বেসিন। আমার ঘরে দুজনের রান্না। কখনও পালাক্রমে কখনও একসঙ্গে। ভিশিতে ভালোই মাছ মেলে। কিন্তু কাটা ও ধোওয়ার অনভিজ্ঞতায় তিনমাস হলো তা খাওয়া হচ্ছে না। অল্প বিস্তর গরুর সঙ্গে সবজি ও বিস্বাদ মুরগি চলছে দেদার। বিফের বেশ দাম। সে তুলনায় এবং ঢাকার তুলনায়ও মুরগি খুব সস্তা। সস্তার তিন অবস্থা। কারণ মুরগিগুলোর মাংস খুব নরম। সামান্য জ্বালেই আঁশ খসে যায়। ফিজি কিংবা থাইল্যান্ড থেকে আসা চাল সত্তর আশি টাকা কেজি। সবুজ মরিচ কিনতে কিলো প্রতি আড়াইশ’র মতো লাগে। যে দেশে চিকিৎসা ব্যয়ের প্রায় পুরোটাই সরকারের, ন্যূনতম বেতন প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা এবং বাসস্থান ভাড়ায় ভর্তুকি মেলে সেখানে জিনিসপত্রের এই মূল্য বেশি কিছু নয়। অতএব ভাতে মাছে বাঙালী মুরগি ভাতে ভালো থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রুমে টিভি থাকলেও ফোন নেই। তবে চাইলে দুদিনেই ব্যবস্থা হয়ে যায়। হোটেলের দশ-এগারোটি রুমের দশ-এগারজন নারী পুরুষের জন্যে টয়লেট প্রতি চারজনে একটি হলেও বাথরুম মাত্র একটি। অন্য একটি হোটেলের কথা বলি। ভিশিতে সেদিন আমার প্রথম ভোর। স্নান ঘরের দরজায় তোয়ালেতে বুক এবং উরুসন্ধি ঢাকা এক তরুণীর সঙ্গে গুঁতো লাগে। তরুণীটি এশীয় অবয়ব দেখেই দিল দৌড়। আমার মতো স্নানে আসছিল সেও। বাথরুমে গরম ঠা-া জলের অনুপাত মেশাতে মেশাতে দেখি ওর সাবান, শ্যাম্পু আগেই রেখে গেছে। আমার তাড়া থাকায় সেসব গ্রাহ্য করি না। আর শরীরে আগের দিনের ভ্রমণের ধকল থাকায় বেশ সময় নিয়ে গোসল সারি। ওই বিকেলেই বাথরুমের দরজায় একটি সময় সূচি সাঁটে ওরা। ওরা দুটি ছেলেসহ মোট সাতজন। এসেছে ডেনমার্ক থেকে। মূলত বেড়াতে। ওদের সময়ানুযায়ী হয় আমাকে ভোররাতে না হলে কাজ শুরুর মিনিট পনেরো আগে স্নানে যেতে হয়। পরদিনও আমার সুবিধাজনক সময় অনুসরণে রাগে ওরা সাঁটানো সূচি ছিঁড়ে ফেলে। স্যাম ব্লেজে অবশ্য সেসব কিছু হয়নি। সবাই সেখানে ভাষাশিক্ষা কেন্দ্র ক্যাভিলমের ছাত্রছাত্রী। একসঙ্গে ফরাসী শিখছি। হোটেলটির মালিক এক জোড়া প্রৌঢ় দম্পতি। মহিলাটিই দেখভাল করে। প্যারিস রওনা হবার আগের সন্ধ্যায় আমরা যখন হোটেল ছাড়তে হিসেব চুকোচ্ছিলাম মহিলা তখন খুব দুঃখিত মনে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছিল। আগের দিন সে শুধু আমায় পরিষ্কার চাদর কম্বলই দেয়নি নিজ হাতে বিছানাও করে দিয়েছিল। ওর ধারণা ছিল ভিশির পুরো সময়টাই আমরা স্যাম ব্লেজেই থাকব। কিন্তু সৌমিত্র আর আমি দুকামরার একটি ছোট্ট এপার্টমেন্ট নেব ভেবেছি। স্যাম ব্লেজে প্রতি রুমের ভাড়া প্রায় আট হাজার টাকা। আমরা জানি ষোলো-সতেরো হাজারে একটি বাসা পাওয়া কঠিন নয়। সুতরাং একই খরচে নিজেদের মতো করে থাকব। এরই মধ্যে ভিশির কাছে আমাদের ঋণ জমেছে অনেক। সেখানে ভাষাতো শিখছিই সবে, কেউ কেউ শ্যাম্পেন আর সাদা সূরার পার্থক্যও। ক্যাসিনোর রাত, ডিসকোথেক বা স্যাটারডে নাইট ফিভারের উত্তাপ স্নায়ুতে প্রথম ধারণের অভিজ্ঞতা ভিশিতেই। সর্বোপরি আমার প্রিয় শহর ঢাকার তুমুল আড্ডা আর প্রিয়জনের সাহচর্য ছেড়ে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করে যাবার শক্তি একফোঁটা শিশিরের মতো টলটলে শহর ভিশিই জুগিয়ে যাচ্ছে। তরুণীটির প্রশ্নের জবাব দেন তার স্বদেশীয় পুরুষটি- ভিশি ফ্রান্সে, মিনারেল ওয়াটারের জন্য বিখ্যাত। প্রচুর পর্যটক যায় সেখানে। বয়স্করা যান সেখানকার জলে সজীব হতে। ভিশির প্রসিদ্ধি ইউরোপের অন্যান্য দেশেও বিস্তৃত এই তথ্য আমার জানা ছিল না। সৌমিত্র আর আমি মুখ চাওয়া চাওয়ি করি। একটু পর বলি, ভুজালে জ্যুসকা উ (তোমরা কতদূর যাবে)? এর জবাবে সহযাত্রীরা জানায় তাদের গন্তব্য রোম ছাড়িয়ে নেপলস। রাতের অগাঢ় ঘুম আর ট্রেনের ঝাঁকুনি তন্দ্রা নিয়ে আসতে চায়। সাগর পাড় থেকে দূরে সরে এসেছি আমরা। পিসার পর থেকে ট্রেন চলছে টিলা জাতীয় অসমান প্রান্তরের মাঝ দিয়ে। নিসর্গ হারিয়ে ফেলেছে তার সবুজ। শুধু পাইন বৃক্ষ তার পত্রপল্লব নিয়ে শীতকে পাত্তা না দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সদম্ভে। রোমে আমাদের ট্রেন ভিড়ল দুটোর পর। শহরটি অপরিচ্ছন্ন। শুধু তাই নয় তার অধিবাসীদের বেশভূষাও মলিন। প্যারিস যদি হয় কোন বিত্তবান শহুরে নাগরিকের বসবার ঘর তবে রোম কোন সামন্ত পরিবারের বৈঠকখানা। লোকজনের কথাবার্তা রুক্ষ্ম ধরনের আর চোখে কেমন যেন অবিশ্বাস। স্টেশন থেকে বেরিয়েই আমরা হোটেল খুঁজছিলাম। দেখি সরকার অনুমোদিত এক এজেন্ট বোর্ডে হোটেলের লম্বা তালিকা টানিয়ে পর্যটকদের কব্জা করার পাঁয়তারারত। তাকেই বলি সস্তায় কাছাকাছি কোন হোটেল পাওয়া যাবে? সে উল্টো জানতে চায়, তোমাদের বাজেট কত? সৌমিত্রের জ্যাকেটের ভেতর পকেটে তখন কয়েক লাখ লিরা। যদিও ইতালীয় মুদ্রা লিরার মূল্যমান খুব কম তবুও পকেটে সাতলাখ লিরার অবস্থান আমাদেরকে গরম রেখেছে। কিন্তু আমরা তার ধার দিয়ে গেলাম না। বললাম, সস্তা কিন্তু একই সঙ্গে ভাল হোটেল চাই আমাদের। আমি জানি তোমরা হোটেলে থাকবে না, লোকটি জবাব দেয়। তার এই মন্তব্য আমাদের মেজাজ খিঁচড়ে দেয়। এমনিতেই আমাদের দেহে দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল। কাল বিকেলে দুই নেপালী কূটনীতিবিদ মসিয়্যু গিমেরী আর প্রকাশ সুবেদী প্যারিসে ‘শুভ ভ্রমণ’ জানানোর পর থেকে ছুটছি। আমাদের বন্ধু হচ্ছে সুবেদী। সে পানে খুব সাবলীল, স্মৃতি শক্তিও অদ্ভুত। গিমেরীর নেশা অবিরাম ধূমপান। ফরাসীতে আমাদের তুলনায় সে চোস্ত। তাই গার দ্য লিওতে টিকেট কাটাতে আর ফ্রাঙ্ককে লিরা করতে ওকে আনা। স্টেশনেই মুদ্রা বিনিময়ের জন্য রয়েছে অনেক কাউন্টার। ফরাসীদের ইংরেজীর প্রতি সহজাত উন্মাষিকতার কারণে গিমেরীর সাহায্য আমাদের প্রয়োজন ছিল। অপরিচিত পরিবেশ মানুষকে এমনিতেই সাবধানী করে। এরপর প্লাটফরমে বিচরণশীলদের চলন মনে করিয়ে দিল মতলববাজদের খপ্পরে পড়ার চেয়ে ভায়া আস্তোলিও বার্তোলিনিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে চলে যাওয়াই ভালো। ট্যাক্সি নিলাম আমরা। রোম ঘুরে যাওয়া এক ভদ্রলোক একবার আমায় বলেছিলেন যদি প্রাচীন এবং বিশাল ভবনমালা তোমার মন কাড়ে তবেই না রোমে যেতে পার। ট্যাক্সির জানালায় চোখ রেখে আমি মেলাতে চাইলাম তার সত্যতাটুকু। রোমে আপাতত আমাদের প্রধান আকর্ষণ প্রাচীন রোমক সা¤্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র কলোসিয়াম এবং খ্রিস্টধর্মের হৃদপিণ্ড ভ্যাটিকানে বড়দিনের উৎসব। সন্ধ্যায় নৈশ ভোজে আমরা একটি ধাক্কা খেলাম। ঘণ্টা দুয়েক হলো হাঁটছি কোন রেঁস্তোরা পাচ্ছি না। রাস্তাঘাট সন্ধ্যায়ই জনশূন্য, অন্ধকারাচ্ছন্ন। বড়দিন আসন্ন। রোম কি ঈদুল ফিতরে ঢাকার নাগরিকদের গ্রামে শেকড় খোঁজার মতো পরিস্থিতির শিকার। প্যারিসের বুকজুড়ে জমকালো সব রেস্তোরাঁ। রোমকে তো কাঙাল মনে হচ্ছে। সুবেদী প্যারিসে তার প্রথম রাতে বিদেশী ছাত্রদের সাময়িক আবাস ফিয়াপের রিসেপসনে জানতে চেয়েছিল, মসিয়্যু আশপাশে কি রেস্তোরাঁ আছে? অভ্যর্থনার লোকটি অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। উত্তর দিল, ডাইনে যান, পেছন ফিরুন, বামে হাঁটুন বা সামনে এগোন সবখানেই রেস্তোরাঁ। প্রতি গলিতে দুহাত পরপর রেস্তোরাঁ পাবেন। এটি প্যারিস মসিয়্যু। সে তুলনায় রোমের অবস্থা বেশ করুণ। অবশেষে একটি জমকালো রেস্তোরাঁয় খেলাম আমরা। বলাই বাহুল্য পকেট থেকে বেরিয়ে গেল প্রায় সত্তর হাজার লিরা। আহা বিখ্যাত স্পাগাতি পড়ে আছে টেবিলে কিন্তু অনভ্যাসে গতি করা যাচ্ছে না তার। ডেজার্ট বলতে গেলে স্পর্শই করিনি আমরা। এ সমস্ত দেশে এ এক অসুবিধে। সাধারণত ন্যূনতম তিন পদের ফরমায়েশ বাধ্যতামূলক। শুরুর জন্যে সালাড, স্যুপজাতীয় খাবার। প্রধান মেনুতে মাছ, মাংস ও কার্বোহাইড্রেট পদের কিছু। মাছ থাকলে সাদা মদ আর মাংস হলে রক্তবর্ণ পানীয়। ডেজার্ট নানা রকম হতে পারে। ফলমূল, আইসক্রিম কিংবা সোকোলা (চকলেট)। দূতাবাসের অদূরে হোটেল পারিওলিতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের। আমরা দূতাবাসে পৌঁছে দেখি সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় তার বিশাল দরজাটি নিথর হয়ে আছে। বেল টিপলে দরজা সংলগ্ন রিসিভারে একটি কণ্ঠ ভেসে এলো। পরিচয় জানতে চাওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান অবেলায় কাজ করছিলেন। তিনি তাঁর সহকারীকে আমাদের থাকার জায়গা করে দিতে বলায় সব ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। রোমকে কেন্দ্র করে আমরা যাব উত্তর সাগর তীরবর্তী স্বপ্নের শহর ভেনিস, কবি দান্তে, ভাস্কর মিশেল্যাঞ্জো এবং চতুর ম্যাকিয়াভেলির জন্মভূমি ফ্লোরেন্স। ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯০। রোমের আবহাওয়া সেদিন ভাল নয়। আকাশ বোঁজা। বৃষ্টি হবে সম্ভবত। ভোরে হোটেলের নিচতলায় যখন আমরা প্রাতঃরাশ নিচ্ছি তখনই মুষলধারায় হয়ে গেছে একবার। আবারও হতে পারে তার পূর্বাভাস প্রকৃতিতে। আবহাওয়া বিচ্ছিরি তবুও পর্যটকের কমতি নেই ভ্যাটিকানে। ভ্যাটিকান মিউজিয়াম এবং আর্ট গ্যালারি বন্ধ। বন্ধ সিসটিন চ্যাপেল, যেখানে রয়েছে মিশেল্যাঞ্জোর ভুবনবিখ্যাত সব পেইন্টিংস, তবুও মানুষ আসছে ক্রমাগত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এরা আসছে উন্মাতাল হাওয়ার মতো। ঘরকে যে করতে পারে পর সেই কেবল দেখতে পায় জীবনের অপর পিঠ। ভিশিতে আমার স্টুডিও’র (হোটেল) পাশেই একটি প্রাচীন বাড়ি। পাথরের। বাড়িটির মালিক একজন কবি। বহুকাল আগে সাগরে স্নানে নেমে নিখোঁজ। সেখানে বাসা বেঁধেছে একঝাঁক কবুতর। আমরা যাকে বলি জালালী কবুতর। ভ্যাটিকানেও দেখছি জালালীর প্রচণ্ড উপস্থিতি। তাদের বিষ্টায় একাকার ভ্যাটিকানের বিশাল থামযুক্ত করিডর। বড়দিনের মাত্র কয়েক ঘণ্টা দেরি কিন্তু খ্রিস্টমাস ট্রিটি এখনও উৎসবের সাজ পায়নি। সেটি আকারে বিশাল। চার্চের বাইরের ঘেরা প্রাঙ্গণে পতিত অবস্থায় আছে। সৌমিত্র প্রচুর ছবি তুলছে। তাতে মনে হচ্ছে ‘স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যাবে কিন্তু ছবি থাকবে উজ্জ্বল’ এই নীতিতে বিশ্বাসী সে। ক্যামেরাটি আমরা প্যারিসে ধার করেছি ডা. খলিলুর রহমানের থেকে। খলিল পেশায় কূটনীতিবিদ। পড়াশোনা করছে সেখানে। থাকছে সিতে ইউনিভারসিতেয়ার-এ। আমরা যেদিন রোম এলাম ওইদিন সকালে ও লন্ডন গেল। ৩১ ডিসেম্বর আবার আমাদের দেখা হবে। হ্যাপি নিউইয়ার-১৯৯১ করব আমরা প্যারিসে। ওই আসরে আরও থাকবে সহিদ-সহিদুল ইসলাম। পেশায় আমাদের গোত্রীয়। সহিদ এখন ছুটি কাটাচ্ছে আলপসে। স্কি করে। সেখান থেকে জেনেভায় যাবার পরিকল্পনা রয়েছে ওর। সহিদের কাছে কয়েক হাজার ফ্রাঙ্ক ধার করেছি আমি। সহিদ হচ্ছে প্রাণবন্ত তরুণ। আমরা যখন ঢাকা থেকে প্যারিস এলাম সেবার একদিন খলিল আর সে মাছিতে বিদেশী ছাত্রদের ডরমিটরিতে নিয়ে যায় আমাদের। উদ্দেশ্য ডিসকোÑথেকে উইক এন্ডের নাচ দেখা। ডরমিটরিতে আফ্রিকানদের সংখ্যাই বেশি। বহুতল ভবনের নিচতলায় এক ফালি নাচের জায়গা। তার কোনে কফি, পানীয়র কাউন্টার। আমরা সেখানে পৌঁছি রাত বারোটা নাগাদ। ছাত্রছাত্রীদের তখন শনিবার রাতের উন্মাদনা উদ্দাম থেকে উদ্দামতর হচ্ছে। খলিল সামান্য নাচে। সহিদ বিলিয়ার্ড খেলা আরম্ভ করে। নতুনদের তেমন কিছু করার থাকে না। আমরা সব কিছুতেই শুধু চোখ রেখে চলি। তিনটেয় যখন শেষ হয়ে যায় শেষ নাচের বাদন আমরা পদযুগল ভরসা করে রাস্তায় বেরিয়ে আসি। অনেক আগেই সাড়ে বারোটায় পাতাল রেল মেট্রো বন্ধ হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে আছে প্যারিস আর তার ভদ্র নাগরিকেরা। কিংবা ওই যে পাঁচতলা প্রাচীন ফ্ল্যাট, তার কোনো কুঠরিতে ওঠানামা করছে দুটো নবীন দেহ। ফাঁকা রাস্তা, আমরা দ্রুত হেঁটে চলি। মাঝে মাঝে সা সা করে ছুটে যাওয়া দু-একটি গাড়ির আরোহী কৌতূহলে তাকায়। একটি টেলিফোনে যেখানে যে কোনো মুহূর্তে ট্যাক্সি ডেকে নেওয়া যায় সেখানে নগরীতে এ দৃশ্য সত্যিই বিরল। সহিদ আর আমি অনুচ্চ থেকে ছাড়া গলায় রবীন্দ্রনাথের গান শুরু করি। জানা গানগুলো শেষ হয়ে যায়। (২০ পৃষ্ঠার পর) পথের বিস্তার ফুরোয় না। আমরা পাঁচ মিশেলীতে চলে যাই। পাঁচ মিশেলীরও সমাপ্তি ঘটে। দূরত্ব বাড়ছে কী কমছে বুঝতে পারি না। পথতো কেউই চিনি না। রাস্তার দিক নির্দেশনায় সহিদের নেতৃত্বে এগুচ্ছি। এবার আংশিক জানা গানগুলো গাইতে থাকি আমরা। শেষে দু-এক লাইন করে। এভাবে দীর্ঘ পথ অতিক্রমের পরও গন্তব্য সিতে ইউনিভার্সিতেয়ার নাগালের বাইরেই থাকে। খলিল, সহিদের মাছির বন্ধুরা দূরত্ব সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। ক্রমাগত হাঁটায় আমার পায়ের তালু, গোড়ালীতে ফোস্কা পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত বেলা উঠি উঠি সময়ে সিতেতে পৌঁছি আমরা। অন্যদের সঙ্গে গা ঠোকাঠুকি করতে করতে চার্চে প্রবেশ করি সৌমিত্র আর আমি। বিশাল ভারী থামের মাথায় ছাদ। কক্ষের উচ্চতা ঢাকার তিনতলা ভবনের সমান হবে হয়তো। দেওয়ালে, ছাদে পুরোন আমলের বিশাল বিশাল পেইন্টিংস। দেবদূতরা আকাশ থেকে অর্থাৎ স্বর্গ থেকে উড়ে আসছে। ভিশিতে প্রতিদিন আমার ঘুম ভাঙে হোটেলের লাগোয়া গির্জার ঘণ্টা ধ্বনি শুনে। কিন্তু আমি কখনও প্রার্থনা দেখিনি। তবে আমার ধারণা মসজিদের তুলনায় গির্জায় প্রার্থনার ব্যাপারটি সহজ। বাধ্যবাধকতা কম বলেই মনে হচ্ছে। সর্ব ক্ষেত্রে জুতো খোলার বালাই নেই। সারি করে চেয়ার সাজানো। সেখানে জাকিয়ে বসে শুধু ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকা। চার্চসংলগ্ন একটি মিউজিয়াম। সেখানে ঢুকতে টিকেট কাটলাম আমরা। ভ্যাটিকান পোপের শাসনাধীন একটি রাষ্ট্র। পোলিশ বংশোদ্ভূত দ্বিতীয় জন পল এখন পোপ হিসেবে আসীন। ভ্যাটিকান রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পেলেও জাতিসংঘের সদস্য নয়। এটি পৃথিবীর সবচে ক্ষুদ্রতম দেশ। আয়তন ১০৯ একর। অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় সাতশ। একবার আমাদের এক প্রথম সারির নায়িকার স্থূল শরীর দেখে জনৈক বন্ধু খেদোক্তি করেছিল- বোম্বের জর্দার মডেলও আমাদেরগুলোর চেয়ে শানানো। খাবারের সন্ধানে গিয়ে তিনজন নানকে দেখে কথাটার আবারও মানে পেলাম। নানগুলোর সাদা লম্বা স্কার্টের ওপর কালো কোট। গলায় সোনার চেন। তাতে লকেট হিসেবে ক্রূশ। মাথায় স্কার্ফ। পিঠে ঝুলছে ফোল্ডিং ছাতা। হাঁটছে সমান তালে। শরীরে যে ছন্দ তাতে চিরকালের পুরুষ হৃদয় আলোড়িত হতেই পারে। কিন্তু সে ভাবনাতো পাপ। পাশ্চাত্যের সকল নগরের মতো রোমও নানা ছুতো খুঁজছে আপনার পকেট খালি করতে। রেস্তোরাঁয় স্যান্ডউইচ চাইলে প্রশ্ন এলো, তোমরা কি বসে খাবে? কেন? টেবিল চেয়ার ব্যবহার করলে তার জন্যে অতিরিক্ত বিল করব আমরা। আমি আর সৌমিত্র দাঁড়িয়ে খেলাম। রোমের প্রধান আকর্ষণ প্রাচীন রোমান সা¤্রাজ্যের কলোসিয়াম এবং আশপাশ এলাকার ধ্বংস প্রাপ্ত নিদর্শন। কলোসিয়াম শত কুঠুরীবিশিষ্ট গোলাকার দুর্গ বিশেষ। পঁচাত্তর থেকে আশি খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময়ে এটি নির্মিত হয়েছিল। ভেতরটা খুব হিজিবিজি। খেই হারিয়ে যেতে চায়। প্রতি বছর লাখ লাখ নারী পুরুষের সমাবেশ ঘটে এখানে। তাঁরা বিলীয়মান ধ্বংসাবশেষে চোখ রেখে রোমানদের জৌলুস প্রত্যক্ষ করতে যেয়ে তাদের নিষ্ঠুরতাকে স্মরণ করে। মে থেকে আগস্ট ইউরোপে যখন গ্রীষ্ম তখন রোম পর্যটকে ভরে যায়। আমরা এসেছি শীতে। বৃক্ষপত্রহীন রোমকে লাগছে ধূসর। তবুও ভালো লাগার কমতি নেই। আমরা শুধু কলোসিয়াম এলাকায়ই দুদিন কাটালাম। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে প্রথম দিন ভিজলাম শৈশবের মতো। দেখার আগ্রহ এবং সময় কম থাকায় বৃষ্টি উপেক্ষিত হলো। দিনের শেষে আবিষ্কৃত হলো দুভাবে ঠকেছি আমি। গড়ানো বিকেলে যখন এক মরোক্কান দশ হাজার লিরায় একটি তাইওয়ানী ছাতা গছিয়ে দিতে সক্ষম হলো ততক্ষণে ঠা-া বুকে বসে গেছে আর ওই রাতেই জানা গেল আমার জ্যাকেটটির কলারের খোপের প্যারাসুট কাপড়ে মাথা ঢাকার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তার বহু আগেই মরোক্কান ভাই ব্যবসা করে নিয়েছে। দ্বিতীয় দিন ছোট্ট একটি ঘটনা ছাড়া আমাদের চমৎকার কাটে। আবহাওয়া ভালো থাকায় প্রচুর পর্যটকের সমাবেশ দিনটিকে করে তোলে প্রাণবন্ত। ডিলাক্স মোটর কোচে এরা এসেছে গাইডেট ট্যুরে। এদের বেশির ভাগই জাপানী। সর্বত্রই এখন জাপানি আগ্রাসন। অর্থের এক ধরনের উত্তাপ থাকে। সে উত্তাপ, কেউ না চাইলেও বদলে দেয় আচরণ। কিংবা কেউ অর্থবান হলে অন্যরাই লেগে যায় তার আচরণ পাল্টে দিতে। যেমন আন্তর্জাতিক ভাষা না হলেও ইউরোপ, আমেরিকায় জাপানী ভাষায় পর্যটন নির্দেশিকার ছড়াছড়ি এখন। পর্যটন সংস্থার চাকরিতে জাপানী ভাষা জানা আজকের দিনে অতিরিক্ত যোগ্যতা। এশীয়দের মধ্যে জাপানী ও কোরীয়দের পয়সা হওয়ায় বেশ সমীহ পাচ্ছে তারা। স্যুভেনির দরদাম করছিলাম। দাম জিগ্যেস করায় জানতে চাইল, কোত্থেকে এসেছ? বাংলাদেশ শুনে দুঃখিত হলো কিনা বোঝা গেল না। তবে উজ্জ্বল হলো না দৃষ্টি। এদিকে সৌমিত্র তখন তার জাপানী অবয়ব নিয়ে দরদামে প্রচণ্ড তোলপাড় চালিয়ে যাচ্ছে। একজন সেলসম্যান অনবরত ওর পিছে। তবে এ সমস্ত ক্ষেত্রে কাফফারার ঝুঁকি কম নয়। রোমে পর্যটকদের অর্থ ও জিনিসপত্র ছিনতাই কিংবা চুরি অহরহ না হলেও অস্বাভাবিক নয়। এদিক থেকে প্যারিস অনেক নিরাপদ। ইতালীয়দের মতো অত ছ্যাচ্চর প্রকৃতির নয় ফরাসীরা। বিদেশীদের আশপাশে যেসব ইতালীয় ঘুরঘুর করছে আমার কেবলি মনে হচ্ছে ওদের চোখে কুতকুত করছে শয়তানী। কলোসিয়াম অঞ্চল অনেকটুকু এলাকা নিয়ে। একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ক্ষুদ্র নগরীর এমন অনেক স্থান থাকে যা খুবই নির্জন। টিবের নদীর পাড়ে এরকম একটি জায়গায় আক্রান্ত হলাম আমরা। সৌমিত্রের ছবি নিচ্ছি আমি। সহসা এক যুবক দ্রুত গতিতে এগিয়ে এল এবং খপ করে ধরে ফেলল আমার হাত। বলল, আমি পুলিশ, তোমার পাসপোর্ট দাও। বিদেশে পাসপোর্ট হচ্ছে রক্ষা কবচ। কিছুটা হতচকিত হলেও ভাবি পাসপোর্ট তো কাউকে দেওয়া যায় না। যুবকটি ততক্ষণে আমার জ্যাকেট টানছে। টানতে টানতে সে একটি মলিন কার্ড বের করে বলে, এই যে আমার আইডেন্টিটি কার্ড, থানায় যেতে হবে তোমাদের। লোকটির আচরণ বেপরোয়া, স্থির নয়। সন্দেহ হলো পাসপোর্টটি ছিনিয়ে সে আমাদের সর্বস্বান্ত করবে। সৌমিত্র ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে আর আমিও চেপে ধরেছি তার হাত। বললাম, থানা আমার চেনা। তুমি আমাদের সঙ্গে চলো। দুজনের সঙ্গে আর সুবিধে করতে পারবে না ভেবে ঝটকায় লোকটি হাত ছাড়িয়ে নেয়। তাকে অনুসরণ করতে বলে হাঁটতে থাকে দ্রুত। অচেনা নগর। কে যাবে একজন রাহাজানিকারীর পিছু নিতে। আমরা নির্জনতা ছেড়ে লোকালয়ে ফিরে আসতে থাকি। সৌমিত্রকে জিগ্যেস করি, আমরা কি এখন ফিরে যাব? এখানে আবার আসার নিশ্চয়তা তো নেই আরও কিছুক্ষণ তাই থাকতে চাই, সৌমিত্রের জবাব। নিশ্চয় আসবেন। না হলে ত্রিবেদী সেন্টারে, মূর্তির সামনে পয়সা ফেলা তো বৃথা হয়ে যাবে। সৌমিত্রের মতো সকল পর্যটকই সেখানে পেছনে ফিরে চাঁদোয়ার ওপর কয়েন ছোড়ে। সবারই বিশ্বাস এ করে আবার একদিন রোমে ফিরে আসবে তারা। আগেই বলেছি নানা বাহানায় পয়সা ধরতে রোম বিছিয়ে রেখেছে তার জাল। এই ব্যবস্থাটি মন্দ নয়। শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষের মধ্যেই সংস্কার কম বেশি ক্রিয়াশীল। আমার ইচ্ছে সৌমিত্রের মতোই। তাই বলি, আবার আসা হলে হবে তবে চাইলে এখন আরও কিছুক্ষণ বসা যায়। তাহলে আর কী। পিজা আর বিয়ারে দিনটি আবার শুরু করা যাক। সৌমিত্রকে সমর্থন জুগিয়ে বললাম, খেতে খেতে অনেকটা সময় বসতে চাই। একটা জায়গায় ঘণ্টা কয়েক না কাটালে তার সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায় না। আমরা ইতিহাসবেত্তা নই, প্রতœতাত্ত্বিক কম্মও আমাদের নয়, আমরা নিতান্তই সাধারণ মানুষ; চোখের দেখায় মন জুড়ানো ছাড়া আমাদের কী আছে বলুন? পিজা আর বিয়ারে দিনটি নতুন করে শুরু হলো আমাদের।
×