ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মহাসঙ্কট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা

ক্যাম্পে ঠাঁই নেই, তবু সীমান্ত পেরিয়ে আসছেই রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২১ নভেম্বর ২০১৭

ক্যাম্পে ঠাঁই নেই, তবু সীমান্ত পেরিয়ে আসছেই রোহিঙ্গারা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বহু আগেই। তবুও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বন্ধ হচ্ছে না। এমন কোন রাত-দিন নেই যে রোহিঙ্গারা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অবাধে ঢুকে পড়ছে। বহু বছর আগে থেকে রাখাইন রাজ্যে এ পরিস্থিতির জন্ম হলেও গত ২৫ আগস্ট রাতের পর থেকে সশস্ত্র সেনা অভিযান ও উগ্র মগ সন্ত্রাসীদের হাতে গণহত্যা, ধর্ষণ, বাড়ি-ঘর জ্বালাও-পোড়াওয়ের শিকার হয়ে রোহিঙ্গাদের যে ঢল বাংলাদেশে ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে তা সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছে। ইতোমধ্যেই রাখাইন রাজ্যের এ ঘটনা গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ বলেও বিভিন্ন মহলের স্বীকৃতি পেয়েছে। এরপরেও গোটা রাখাইন রাজ্য থেকে দলে দলে রোহিঙ্গা প্রতিনিয়ত চলেই আসছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার এদের আশ্রয়দানের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর রোহিঙ্গাদের দলে দলে চলে আসার বিষয়টি যে প্রাধান্য পেয়ে গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিভিন্ন মহলের পক্ষে ধারণা করা হয়েছিল এক পর্যায়ে রোহিঙ্গা স্রোত থেমে যাবে। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টিতে লক্ষণীয় যে, এদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ কোনভাবেই থামছে না। এ পরিস্থিতিতে টেকনাফ উখিয়াসহ গোটা কক্সবাজার অঞ্চলের সার্বিক পরিবেশ অস্বাভাবিক পরিস্থিতির দিকে ডুবছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী গত ১৫ নবেম্বর সংসদে বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ নজিরবিহীন সঙ্কটের মুখে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও এ বিপুল জনগোষ্ঠীকে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে রাখা সম্ভব হবে না। এরপরেও রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা যাতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসতে পারে মিয়ানমার প্রশাসন সে সুযোগ অবারিত করে রেখেছে। আর নানামুখী ভয়ভীতি প্রদর্শন তো রয়েছে। নতুন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৭ লাখ পেরিয়ে গেছে। আগে এসেছে ৫ লাখ। সব মিলে এ সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়েছে। আর এখনও রোহিঙ্গা আগমন অব্যাহত রয়েছে। সোমবার পর্যন্ত গত তিন দিনে টেকনাফ উখিয়ার সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ১২ শতাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এ অবস্থায় এ ইস্যুতে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে দাবি উঠেছেÑ রোহিঙ্গা ইস্যুতে আগামীতে কক্সবাজার অঞ্চলে মহাসঙ্কট সৃষ্টিরসমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আর নয়, সীমান্ত সিল করে দেয়ার সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে। এখনও ঢুকছে শত শত রোহিঙ্গা ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে টেকনাফের সমুদ্র উপকূল পয়েন্ট দিয়ে এখনও রাতের আঁধারে শামলাপুর ক্যাম্পে ঢুকে পড়ছে শত শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। সোমবার পর্যন্ত গত তিনদিনে টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অন্তত ১২ শতাধিক রোহিঙ্গার নতুন অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ইতোপূর্বে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শাহপরীর দ্বীপের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করায় প্রশাসনের কড়া নজরদারি রয়েছে সেদিকে। ফলে পশ্চিম সাগর উপকূলের বাহারছড়া বড়ডেইল পয়েন্ট দিয়ে এখন ঢুকছে রোহিঙ্গারা। স্থানীয় সিন্ডিকেট সদস্যদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের আগমনে সহযোগিতা করা হচ্ছে এবং তাও অর্থের বিনিময়ে। সমুদ্র সৈকত উপকূল দিয়ে প্রতিরাতে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের সদস্য সংখ্যাও বাড়ছে। সোমবার ভোররাতে প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা শামলাপুর ক্যাম্পে অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ইতোপূর্বে সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে রোহিঙ্গাবাহী নৌকা ডুবে প্রায় ৩ শতাধিক রোহিঙ্গার প্রাণহানি ঘটে। এরপর জেলা প্রশাসন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সাগর ও নাফ নদীতে ট্রলার-নৌকা চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। টেকনাফের বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, মাছ শিকারের আড়ালে পুরাতন রোহিঙ্গারা ফের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসার পথ সুগম করছে। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে দাবি করে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কাঞ্চন কুমার নাথ জানান, রোহিঙ্গা আনার কাজে জড়িত নৌকার মাঝিমাল্লাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা প্রদান করায় তাদের অপতৎপরতা কিছুটা কমেছে। সোমবার টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, দক্ষিণপাড়া, পশ্চিমপাড়া, টেকনাফের নাইট্যংপাড়া ও সাগর সৈকত পয়েন্ট দিয়ে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা নৌকা, ট্রলার যোগে এবং ৮০ নারী-পুরুষ এবং শিশু ভেলায় ভেসে এপারে অনুপ্রবেশ করেছে। এপারে আসতে মংডু দংখালী সীমান্তে আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছে নতুন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা। টেকনাফ থানা পুলিশ জানান, সোমবার সকাল থেকে শাহপরীর দ্বীপের বিভিন্ন সীমান্ত হয়ে আসা ২৬ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের মানবিক সহায়তা পূর্বক রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ভোররাতে ট্রলারে করে বঙ্গাপসাগর হয়ে আসা দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু এপারে ঢুকে টেকনাফ বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হলে থানা পুলিশ তাদের সেনাবহিনীর ক্যাম্পে প্রেরণ করেছে। সোমবার সকাল ১০টার দিকে নাফ নদী দিয়ে একটি ভেলায় ভেসে ৮০ নারী-পুরুষ ও শিশু নয়াপাড়া সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছে এপারে। তাদের সকলকে উদ্ধার করে মানবিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যদের পক্ষে জানানো হয়েছে। ঠাঁই হচ্ছে না রোহিঙ্গাদের ॥ উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় স্থানীয় জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ৫ লক্ষাধিক। তারা পাহাড়ে জুম চাষ, সামাজিক বনায়ন, নাল জমিতে কৃষি, সাগর ও নাফ নদীতে মৎস্য আহরণ, চিংড়ি চাষ ও বিভিন্ন ব্যবসাবাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এ দুটি উপজেলায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নতুন পুরনো মিলিয়ে বর্তমান প্রায় ১২ লাখ। বন উজাড়, নদীতে নেট চালানো, ছোটখাটো ব্যবসা ও দিনমজুরি সব কাজে ঢুকে পড়েছে রোহিঙ্গারা। আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন অনুসারে ক্যাম্প থেকে বের না হওয়ার নিয়ম থাকলেও সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত টেকনাফ উখিয়ার রাস্তাঘাটে গাড়ি তো দূরের কথা, রোহিঙ্গাদের ঢলের কারণে সহজে হেঁটে চলাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। কর্মজীবী লোকজনদের বিভিন্ন জায়গা রোহিঙ্গারা দখল করে নেয়ায় তাদের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। অনেকের জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। রাখাইনে প্রতিরাতে গুলি ॥ নাফ নদীর সীমানা বেষ্টিত মিয়ানমারের রাখাইনে প্রায় প্রতিরাতে দেশটির সীমান্তরক্ষী দল (বিজিপি) ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে চলছে। রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গ্রুপ আল ইয়াকিন ও আরএসও ক্যাডারদের ভয় দেখাতে তারা নিয়মিত গুলি ছুড়ছে বলে জানা গেছে। মিয়ানমার অভ্যন্তরে গহিন অরণ্যে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সশস্ত্র ক্যাডারদের আস্তানা রয়েছে বলে ধারণা করে দেশটির সরকারী বাহিনী সতর্কতা মূলক গুলি বর্ষণ করে থাকে। নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু বরাবর রাখাইনের তুমব্রু থেকে শুরু করে টেকনাফের হৃলা বরাবর নাকপুরা সীমান্তে (উত্তর মংডু) বিজিপি গত মাসখানেক ধরে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে চলছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বলছে, মিয়ানমার অভ্যন্তরে গুলি বর্ষণ করলে আমাদের করণীয় কিছুই নেই। তবে বিজিবি সীমান্ত এলাকায় নিয়মিত জোরালো টহল চালিয়ে যাচ্ছে।
×