ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শেষ হলো রাধারমণ উৎসব

ভাটিবাংলার সহজিয়া সুরে কৃষ্ণ বিরহ, পরমাত্মার সন্ধান

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ১৯ নভেম্বর ২০১৭

ভাটিবাংলার সহজিয়া সুরে কৃষ্ণ বিরহ, পরমাত্মার সন্ধান

মোরসালিন মিজান আগে যদি জানতামরে ভ্রমর, যাইবারে ছাড়িয়া/মাথার কেশও দুই’ভাগ করি/রাখিতাম বান্ধিয়ারে, ভ্রমর কইয়ো গিয়া...। কী আশ্চর্য সুন্দর গানের কথা! মাথার চুলে যে বেনুনী করে মেয়েরা, সে বেনুনী দিয়েই প্রাণনাথকে বেঁধে নিজের কাছে রেখে দেয়ার আকুতি। শুনে আপ্লুত হতে হয়। চমকিত না হয়ে পারা যায় না। একইভাবে শিল্পীরা যখন গায় ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া।/অন্তরে তুষেরই অনল জ্বলে গইয়া গইয়া’, মন বেদনায় ডুবে যায়। না, এক দুটি নয়। এমন প্রায় দেড় হাজার গানের স্রষ্টা রাধারমণ। দেহতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, অনুরাগ, প্রেম, ভজন, ধামাইলসহ নানা ধরনের গান রচনা করেছেন তিনি। ভাটি বাংলার সহজিয়া সাধক সঙ্গীত সাধনা চালিয়েছিলেন সিলেট অঞ্চলে। সেও বহুকাল আগের কথা। আজ তিনি নেই। নেই বটে সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে আছেন। দেশের প্রতি প্রান্তে তিনি! একই কারণে রাজধানী ঢাকায় গুরুত্বের সঙ্গে গাওয়া হয় তার গান। আর বৈষ্ণব বাউলের চর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে রাধারমণ উৎসব। প্রতিবছর শিল্পকলা একাডেমির খোলা চত্বরে বৃহৎ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। তিন দিনব্যাপী মিলনমেলার উদ্বোধন করা হয় গত বৃহস্পতিবার। শনিবার শেষ হয়েছে। শহুরে আয়োজন হলেও, সিলেট অঞ্চলের মাটি সংলগ্ন শিল্পীরা ছিলেন মঞ্চে। হাটে মাঠে ঘুরে বেড়িয়ে রাধারমণের গান করেন যারা, তাদের অংশগ্রহণ উৎসবটিকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। এবারও উৎসবের প্রাণ সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার শিল্পীরা। কখনও একক কণ্ঠে গেয়েছেন তারা, কখনওবা দলীয় পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে এসেছেন। ঢাকার তারকা খ্যাতি সম্পন্ন শিল্পীরাও গেয়েছেন রাধারমণের গান। এর পর আর মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়! তিন দিনই বিপুল সমাগম ছিল শ্রোতার। বিচ্ছেদের চিরচেনা সুরে তারা বুদ হয়ে ছিলেন। গানে গানে পরমাত্মার সন্ধান করেছেন। শুরুটা করে দিয়েছিলেন সুষমা দাশ। একুশে পদকে সম্মানিত প্রবীণ শিল্পী বৃহস্পতিবার উৎসবের উদ্বোধন করার পাশাপাশি গান করেন। তার গাওয়া ‘ও আমার শ্যাম বিনে প্রাণ বাঁচে না’ শুনে রাধারমণের মূলটা যেন পাওয়া হয় শ্রোতার। অকৃত্তিম কণ্ঠ। বংশ পরম্পরায় যে চর্চা তার ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া যায় শিল্পীর কণ্ঠে। প্রথম দিন তিনিই ছিলেন উৎসবের শোভা। পরে ঢাকার ১৮ জন শিল্পী রাধারমণের গান করেন। আকরামুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দিকের কণ্ঠে রাধারমণ, আহা! গেয়েছেন উৎসবের মূল আয়োজক বিশ্বজিৎ রায়ও। এই শিল্পীর নরম দরদী কণ্ঠ যারা শুনেছেন তারা জানেন, কী যতেœ তিনি রাধারমণকে ধারণ করেছেন। তার গাওয়া ‘গৌর নামে চলছে গাড়ি’ ও ‘হরি গুণাগুণ কৃষ্ণ গুণাগুণ’ গান দুটি মুগ্ধ হয়ে শোনেন শ্রোতা। অনিমা মুক্তি গোমেজ, দিল আফরোজ রুবা, দীপ্তি রাজবংশী, চম্পা বণিক, খায়রুল ইসলাম, মুগ্ধ সরকার, শরীফা নাজনীন তৃপ্তি, সালাম, মানিক, মুক্তা প্রমুখের গান শুনেও বেশ লাগে। এদিন রাধারমণ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্রের শিল্পীরা পরিবেশন করেন ‘সজনি তোরা জল আনিতে যাবেনি’ ও ‘সুরধনির কিনারায়’ গান দুটি। মন্দিরা শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীদের কণ্ঠে ছিল বিপুল জনপ্রিয় গান ‘বলগো বলাগো সখি’ ও ‘প্রাণসখিরে ওই শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে’। দ্বিতীয় দিন শুক্রবার সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। উৎসবের অনন্য সংযোজন সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ধামাইল গানের পরিবেশনা। এদিন বিশেষ ধারার এই গান শোনার সুযোগ পান শহুরে শ্রোতা। শনিবার ছিল উৎসবের সমাপনী দিন। এদিন সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও জগন্নাথপুরের শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। শেষ দিনেও বড় আকর্ষণ হয়েছিল ধামাইল গানের পরিবেশনা। নারী শিল্পীরা গোল হয়ে জায়গা পরিবর্তন করতে করতে বিশেষ এই বিয়ের গীত করেন। সব মিলিয়ে অনবদ্য আয়োজন। রাজধানী শহরে শেকড়ের সংস্কৃতি। সহজিয়া সুরে পরমাত্মার সন্ধান। দারুণ উপভোগ করেছেন ঢাকার শ্রোতা। তবে রাজধানী শহরে এ ধরনের আয়োজন সহজ কাজ নয়। চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছে রাধারমণ সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র। কেন্দ্রের মূল সংগঠক বিশ্বজিৎ রায় কাজটি বড় ভালবেসে করেন। এবারের আয়োজন সম্পর্কে তিনি বলেন, রাধারমণের গান ভীষণ জনপ্রিয়। কম বেশি সবাই গেয়ে থাকেন। তবে কথা ও সুর ঠিক রেখে চর্চাটি অব্যাহত রাখার তাগিদ অনুভব করি আমরা। উৎসব মঞ্চ থেকে এবারও সে কথাটি বলার চেষ্টা হয়েছে। রাধারমণের বাকি গানের খোঁজ করা, বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে সরকারী উদ্যোগ ও সহায়াতা কামনা করেন তিনি।
×