ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মঞ্চের আলোয় মহাজীবন ইতিহাসের কাছে ফেরা

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৯ নভেম্বর ২০১৭

মঞ্চের আলোয় মহাজীবন ইতিহাসের কাছে ফেরা

মোরসালিন মিজান ॥ ইউনিভার্সেল থিয়েটার দল হিসেবে ছোট। অন্য অনেক দলের তুলনায় ছোট বৈকি। তবে বেশ বড় আয়োজন নিয়েই সামনে এসেছে। নিজস্ব চর্চার পাশাপাশি এবার সপ্তাহব্যাপী নাট্যোৎসবের আয়োজন করেছে তারা। মাত্র ৭টি দল। সমানসংখ্যক প্রযোজনা। এরপরও ‘ইতিহাসের মহানায়কেরা’ শীর্ষক আয়োজনটিকে বড় আয়োজনই বলতে হবে। বিষয় বিবেচনায় বড়। শিল্পকলা একাডেমিতে গত শনিবার উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে এখনও চলছে প্রদর্শনী। উদ্বোধনী দিন এবং পরের কয়েকদিন উৎসবস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আড়ম্বরহীন পরিবেশ। বিরাট সমাগম ঘটেনি। হৈ হুল্লোড় নেই তেমন। সীমিত সাধ্যে যতটা সম্ভব সাজিয়ে নেয়া হয়েছে অঙ্গনটিকে। তবে কীর্তিমানদের প্রতিকৃতিগুলোর দিকে তাকাতেই মন কেমন নরম হয়ে যায়। ভরে ওঠে। মহামানবদের ঘটনাবহুল জীবন ও দর্শন নিয়েই গোটা আয়োজন। গভীর বোধসম্পন্ন দর্শক চমৎকার উপভোগ করছেন। আয়োজক দলটির ইতিহাস চেতনা সম্পর্কে আগেই ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। বিশেষ করে ‘মহাত্মা’ নাটকে নিজেদের চিন্তার উদ্ভাসন ঘটিয়ে ছিলেন তারা। সে ধারাবাহিতায় এবার যুক্ত হলো একই ধারার অন্য নাটকগুলোর সঙ্গে। ঢাকার, ঢাকার বাইরের ৬টি এবং ভারতের ১টি দলকে সঙ্গে নিয়ে ‘ইতিহাসের মহানায়কেরা’ শীর্ষক নাট্যোৎসব। শিরোনামই উৎসবের বৈশিষ্ট্যটি গড়ে দিয়েছে। বিষয় বিবেচনা নিলে আর সব আয়োজনের সঙ্গে এটিকে গুলিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। ভিন্ন ভিন্ন সময়ের কালের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বদের, কীর্তিমানদের জীবন দর্শন সংগ্রাম ও স্বপ্নকে ধারণ করেছে উৎসব। উৎসবে স্বতন্ত্র নাট্যভাষা ও ভাবনা থেকে সংগঠিত হওয়ার প্রয়াস লক্ষ্যণীয়। বিভিন্ন দলের একই ধারার কাজগুলোকে একত্রিত করে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে। উৎসব নাম দিয়ে নিজেদের ধারে কাছে যারা, তাদের নাটক দেখ। দেখাও। এই যে রীতি, স্থূল ভাবনা, আয়োজকরা তার থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন বলে মনে হয়। ভাংতে পেরেছেন কিছুটা হলেও। উদ্বোধনী দিন শনিবার মঞ্চস্থ হয় পালাকার প্রযোজনা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্র’ অবলম্বনে নাটকটি রচনা করেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। নির্দেশনা দিয়েছেন আতাউর রহমান। এখানে সময়কাল ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৫ সাল। রবীন্দ্রনাথের জীবন-সাধনা পর্বের উপস্থাপনা। এ সময় কবিগুরু আজকের বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। তাঁর সৃষ্টিকর্মে বিশেষ করে ‘ছিন্নপত্রে’ যে দেখা, যে অভিজ্ঞতার বয়ান, নাটকে তা তুলে ধরা হয়। দ্বিতীয় দিন রবিবার মঞ্চস্থ হয় থিয়েটারের ৪১তম প্রযোজনা ‘বারামখানা।’ রচনা করেন পান্থ শাহরিয়ার। নিদের্শনায় ত্রপা মজুমদার। নাটকে লালনের মানবতাবাদী দর্শন একটু বড় পরিসরে দেখানোর চেষ্টা হয়। লালনের জীবনের গল্প যেমন পাওয়া যায়, তেমনি সমকালীন লালনচর্চার নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয় নাটকে। তৃতীয় দিন সোমবার উৎসবে তুলে ধরা হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। এই ইতিহাসের মহানায়ক সূর্য সেনকে আশ্রয় করে এগিয়ে চলে কাহিনী। চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি রেপার্টরি প্রযোজনা বেশ উপভোগ করেন দর্শক। নাটকটি রচনা করেন শোভনময় ভট্টাচার্য। নির্দেশনা মোসলেম উদ্দিন সিকদার। মঙ্গলবার মঞ্চের আলোয় উদ্ভাসিত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এদিন ঐতিহাসিক নাট্য আখ্যান ‘মুজিব মানেই মুক্তি’ নিয়ে মঞ্চে আসে লোকনাট্য দল। প্রযোজনাটিতে একেবারে কিশোর বয়সী মুজিবকে পাওয়া যায়। পরে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আসে ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণ এবং মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ঘটনাবলিও স্থান পায় নাটকে। নাটকটি রচনা করেন লিয়াকত আলী লাকী। নির্দেশনাও ছিল তার। বুধবার ছিল আয়োজক ইউনিভার্সেল থিয়েটারের নাটক। সঙ্গত কারণেই ‘মহাত্মা’ নিয়ে মঞ্চে ছিলেন দলের সদস্যরা। অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা মহাত্মা গান্ধীর নোয়াখালী সফর নাটকের মূল পটভূমি হয়ে আসে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সেইকালে দাঁড়িয়ে নাট্যকর্মীরা সমকালের কথাই যেন বলে যান। মানুষে মানুষে সম্প্রীতির আহ্বান জানান তারা। নাটকটি রচনা ও পরিচালনা করেন মাজহারুল হক পিন্টু। উৎসবের ষষ্ঠ দিন আজ বৃহস্পতিবার মঞ্চস্থ হবে আরণ্যক নাট্যদলের ‘এবং বিদ্যাসাগর।’ নাটকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মহানায়ক হয়ে আসবেন সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর। সেইসঙ্গে কলকাতাকেন্দ্রিক নাগরিক সামাজ সংস্কৃতি ও রাজনীতির চিত্র তুলে ধরা হবে। নাটকটি রচনা করেছেন মান্নান হীরা। নির্দেশনা দিয়েছেন মামুনুর রশীদ। আগামীকাল শুক্রবার উৎসবের সমাপনী দিন। এদিন পর্দা নামবে উৎসবের। শেষ দিন মঞ্চে থাকবে ভারতের দল কল্যাণী নাট্য ভাবনা। ‘শ্রমণ’ প্রযোজনার মাধ্যমে মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবন ও দর্শন ফুটিয়ে তোলার কথা রয়েছে। নাটকটি রচনা করেছেন নিরূপ মিত্র। নির্দেশনায় রয়েছেন তাপস চক্রবর্তী। নাটকের পাশাপাশি এদিন সকাল ১০টায় আয়োজন করা হবে বিশেষ সেমিনারের। একাডেমির সেমিনার কক্ষে মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন বিপ্লব বালা। আলোচনা করবেন ড. ইনামুল হক, মালিক খসরু ও আরিফ হায়দার। সেমিনারের জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বদের জীবন ও দর্শন নির্ভর নাটকের বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। সব মিলিয়ে সফল একটি পরিসমাপ্তির অপেক্ষা এখন। উৎসব নিয়ে কথা হচ্ছিল ইউনিভার্সেল থিয়েটারের সভাপতি আজিজুল পারভেজের সঙ্গে। ইতিহাস নির্ভরতা কেন? কোন চিন্তা থেকে? জানতে চাইলে নিভৃতচারী নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মী বললেন, বর্তমান ও অনাগত ভবিষ্যতের প্রয়োজনেই আমাদের অতীতে ফিরে যেতে হয়। আমরা মহামানবদের জীবনীনির্ভর একাধিক নাটক মঞ্চে এনেছি। প্রশংসিতও হয়েছি। সে ধারাবাহিকতা থেকেই অন্যান্য দলের একই ধারার নাটক নিয়ে উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা। যে সে উৎসব না করে ইতিহাসের উপাদানে সমৃদ্ধ হতেই এমন প্রয়াস বলে জানান তিনি। এমন আয়োজন আরও হোক। ইতিহাসের আলোয় দূর হোক বিকৃতি। মহাজীবনের স্পর্শে স্বার্থক হোক আমাদের জন্ম।
×