ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

ছোটগল্পের দায়বদ্ধতা

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৩ নভেম্বর ২০১৭

ছোটগল্পের দায়বদ্ধতা

মানুষ প্রচুর গল্প বলতে এবং শুনতে চায়। সে উপন্যাস, নাটক কিংবা ছোটগল্প, যা-ই হোক না কেন? তাই যে গল্পে মানুষের কথা থাকে, জীবনের কথা থাকে; সে গল্পই পাঠকের মনকে নাড়া দেয়। জীবন ঘনিষ্ঠ গল্পই যুগে যুগে পঠিত হতে থাকে। ফলে লেখকরা সাধারণ মানুষের কথা বলতে চান; সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চান। চায়ের দোকানে, কলেজের মাঠে কিংবা কোন আড্ডায় সবাই গল্প শুনতে বেশি পছন্দ করে। এছাড়া গল্পেই কথাগুলো গুছিয়ে সুন্দরভাবে বলা যায়। তাই যারা ছোটগল্প লিখছেন; তারা দ্রুত পাঠকমহলে পরিচিত হতে পারেন। তবে উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, সাহিত্য সমালোচনাও লিখেও রাতারাতি পরিচিতি পাওয়া সম্ভব। সেটা নির্ভর করে লেখার মানের ওপর। যেহেতু ছোটগল্প প্রসঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি, তাই আর অন্য শাখায় বিস্তারিত যাওয়ার সুযোগ নেই। আমি মনে করি, গল্পের বৈশিষ্ট্য গল্পকারকেই নির্ধারণ করতে হয়। তাই আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার গল্পের বৈশিষ্ট্য হবে- মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাহাকার, ভালবাসার সঙ্গে অপূর্ণতা, সমস্যা সৃষ্টি কিন্তু সমাধান না-ও হতে পারে। অলৌকিকতার আশ্রয় নিতে আমার একদম ভাললাগে না। কারণ আমি ‘ত্রাণকর্তা’ নই। তাই গল্পে কাউকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারব না। জীবনের করুণ বাস্তবতাই আমার গল্পের উপজীব্য। এছাড়া একেবারে সাদাসিধা বক্তব্য থাকবে। কোন দর্শন, তত্ত্ব, ইঙ্গিত, গম্ভীর আবহ আমার পছন্দ নয়। এত গেল আমার কথা। অন্যের কথা বলতে গেলে যেমন- আমরা চায়ের দোকানে কোন একজনের গল্প শুনছি। সবাই চুপ। গল্পকার এমনভাবে বলে যাচ্ছেন- যেন সবার চোখের সামনেই ঘটছে ঘটনাটি। অথচ তিনি আমাদের মতো নিয়মিত লেখক নন; তবুও মানুষ তার গল্প শুনছে। আর গল্পটি শেষ হলেও শ্রোতারা বাড়ি যাওয়া অবধি সেই গল্পটি নিয়েই ভাবতে থাকেন। এমনকি হঠাৎ হঠাৎ সেই গল্পটি মনে পড়ে যায়। গল্পটি ছড়িয়ে পড়ে একজন থেকে অন্যজনে। আমিও চাই, আমাদের গল্পের বৈশিষ্ট্য এমন হোক। তবে পাঠক যা চায়, তা হয়তো পরিপূর্ণভাবে দেয়া সম্ভব নয়। আর সব পাঠকের রুচিও এক নয়। সবাইকে হয়তো সব লেখক ধরতে পারবেন না। তবুও আমাদের একটি টার্গেট পিপল চাই। তা লেখককেই নির্ধারণ করতে হবে। কারণ এ পর্যন্ত প্রকাশিত গল্পগুলোর পাঠকপ্রিয়তা দেখে মনে হচ্ছে- পাঠক সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ভাষার গল্প চান। তবে গল্প লেখার আগেই পাঠকের শ্রেণী বিভাগটা করে নিতে হয়। গল্পটি আমি কাদের জন্য লিখছি। যে জীবনে মদের স্বাদ পাননি, তাকে মদের গল্প শোনালে মজা নাও পেতে পারেন। তাই পাঠক চান জীবনঘনিষ্ঠ গল্প। চান প্রশান্তি কিংবা বুকভর্তি হাহাকার। অথবা মিলনের বন্যায় ভেসে যেতে। তবে মনে রাখতে হবে যে, লেখকদের মধ্যে সবাই ‘সব্যসাচী’ নন। অনেকেই সাহিত্যের একাধিক শাখায় কাজ করছেন। আবার কেউ কেউ শুধু একটি শাখাতেই স্থির হয়ে আছেন। যারা একটি শাখায় স্থির হয়ে আছেন; তাদের হিসেব ভিন্ন। তবে একজন ‘কবি’ যখন গল্প লিখবেন; তখন তার গল্পে অবশ্যই কবিতার প্রভাব থাকবে এবং থাকতে বাধ্য। কারণ তিনি ইচ্ছা করলেও এ প্রভাব এড়াতে পারবেন না। তার গল্পের বর্ণনায়, সংলাপে, উপমায়, চরিত্র বা গল্পের নামকরণে কাব্যময়তা প্রকাশ পাবেই। সংলাপে কবিতার পঙ্ক্তি আসবে। নায়ক-নায়িকার হাতে কবিতার বই উঠে আসবে। এমনকি নায়িকা কলেজে যাওয়ার সময় ব্যাগে বা হাতে প্রিয় কবির কবিতার বই নিয়ে যাবেন। আরও কত প্রভাব তো রয়েছেই। সেগুলো আমরা নিজেরাই খুঁজে নিতে পারি। এ ধরনের গল্পের জন্য লেখক একশ্রেণীর পাঠক পেয়ে যাবেন নিশ্চিত। কারও কারও পছন্দ যৌনতাকেন্দ্রিক গল্প। মানব জীবনে যৌনতা আবশ্যক একটি বিষয়। প্রাণি জগতের অপরিহার্য অংশ। ব্যক্তি জীবনে যেমন যৌনতাকে অস্বীকার করা যায় না; ঠিক তেমনি কখনও কখনও গল্পেও যৌনতাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে বিবরণটা কেমন হবে; সেটাই বিবেচ্য। রগরগে বর্ণনা বা অনিবার্যতা ছাড়া যৌনাঙ্গের নাম উচ্চারণও বাঞ্ছনীয় নয়। যেমন- একটি খারাপ চরিত্র একটি মেয়েকে ধর্ষণ করছে, সেখানে আমরা মেয়েটিকে কিভাবে ধর্ষণ করা হচ্ছে- তার বর্ণনা করতে পারি না। সুকৌশলে বিষয়টি তুলে আনতে পারি। কিংবা নায়িকার সৌন্দর্য বর্ণনায় অযথাই তার ঠোঁট, স্তন, নাভি, কোমর, নিতম্ব, যৌনাঙ্গ তুলে না এনে উপমা প্রয়োগের মাধ্যমে বা উপযুক্ত শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা যায়। মনে রাখতে হবে- যৌনতা অশ্লীলতা নয়। তবে বাড়াবাড়িতে তা অশ্লীল হয়ে ওঠে। তাহলে কোন শ্রেণীর ছোটগল্প সবচেয়ে বেশি পাঠক সমাদৃত হয়? এমন ভাবতে গেলে ধাঁধায় পড়তে হবে। প্রথমে ভাবতে হবে- আপনার পাঠক কারা? অর্থাৎ আমাদের দেশের শিক্ষার হার কেমন? মানুষের মাথাপিছু আয় কত? মানুষের মধ্যে উদারতার হার কতটুকু? ধর্মীয় গোড়ামি রয়েছে কেমন? রাজনৈতিক অস্থিরতার মাত্রা কেমন? এসব উত্তর ঠিকঠাক পেয়ে গেলে গল্পের শ্রেণীও খুঁজে পাওয়া যাবে। পাঠক সমাদৃত গল্পের মধ্যে বলা যায়- মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গল্প বেশি জনপ্রিয় হয়। কারণ আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা বেশি এবং তারা সমাজ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি সচেতন। তারা সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য বই পড়েন। সঠিক পথের সন্ধান লাভের জন্য গল্প পড়েন। গল্পের চরিত্রের সঙ্গে নিজের জীবনের মিল খোঁজেন। গল্পের চরিত্রের সফলতায় উজ্জীবিত হন এবং ব্যর্থতায় বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এছাড়া রোমান্টিক গল্পের পাঠক তো রয়েছেই। তবে তা অবশ্যই বিয়োগান্তক হওয়া চাই। রোমিও-জুলিয়েট, লাইলি-মজনু, দেবদাস-পার্বতী, অপু-হৈমন্তি, রুপাই-সাজুরা আমাদের সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। অর্থাৎ বলা যায়, পাঠক বাস্তবসম্মত জীবনের গল্প শুনতে পছন্দ করেন। কমেডির একটি গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও সেটি অনেক সময় দ্বিতীয়বার আর হাতে ওঠার মতো ঘটনার জন্ম দিতে পারে না। একটি সার্থক গল্পের জন্য প্রথমেই দরকার নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কিত জ্ঞান। কোনটি শিল্প আর কোনটি শিল্প নয়; সে বোধও থাকাটা জরুরি। তাই তো সাহিত্য বোদ্ধাদের কাছে সব গল্পই গল্প হয়ে ওঠে না। কোন কোন গল্প শুধু বর্ণনাই হয়ে ওঠে। তার নান্দনিক বোধ বা শৈল্পিক সত্তা পাঠকের চোখে ধরা পড়ে না। অবচেতন মনে কোন গল্প বলে গেলে, তা পাঠকের বোধগম্য না-ও হতে পারে। কারণ কাহিনী সবাই বলতে পারে। গল্প বলাটা আরও কঠিন। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার হুবহু বর্ণনা দিলেই সেটি গল্প হয়ে যায় না। তাই এর জন্য কিছু কৌশল বা নিয়মের প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, আমাদের পূর্ববর্তী লেখকদের অনুসরণ করা যেতে পারে। একটি ঘটনা বর্ণনা করতে গেলে কিভাবে শ্রোতাকে ধরে রাখতে হবে, সে বিষয়ে গল্পকারকেই ভাবতে হবে। অযথা বকবক শোনার মতো সময় কারও হাতেই নেই। তাই স্থান-কাল-পাত্র-পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে একটি আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করে ক্রমান্বয়ে পাঠককে টেনে নিয়ে যাওয়াই সার্থক গল্পের বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের ‘ছোটগল্প’ বিষয়ক থিউরি অবশ্যই প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে আপনি গল্প কীভাবে বলবেন? তা নিজেই নির্ধারণ করুন। সুতরাং যা-ই করুন; যে কোন একটি পন্থায় এগিয়ে যান। শৃঙ্খলা বজায় রেখে সামনে এগিয়ে যান; তাহলে পাঠকও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠবেন না। সত্যি বলতে গেলে, কোন কাজেই নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ সবসময় ফলপ্রসূ হয় না। আর গল্পে তা সম্ভবও নয়। তবুও আমাদের পূর্বসূরি যারা লিখে গেছেন, তারা আমাদের দেখা বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন। দেশের সার্বভৌমত্ব, সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থার পরিসংখ্যানের ছবি এঁকেছেন। আমরা তাদের কাছ থেকে ধারণা নিতে পারি। আমাদের দেশে এমন অনেক লেখক রয়েছেন; যাদের আমরা অনুসরণ করতে পারি। আমাদের বোধ বা বিবেক যেন পর ধন লোভে মত্ত না হয়। কারণ আমার দেশে যত গল্পকার রয়েছেন; তাদের সবার লেখা তো আমি পড়ে শেষ করতে পারব না। তাহলে কেন নিজের পা-িত্য জাহির করতে গিয়ে মোপাসাঁ, গোর্কি, মার্কেজ, মুরাকামি বলে বলে মুখে ফেনা তুলব? তাদের প্রেক্ষাপট আর আমার প্রেক্ষাপট কি এক? একই যদি না হয়, তাহলে আমার গল্প পাঠক গ্রহণ করবেন কিভাবে? কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজের ধারায় লিখে যেতে হবে। তাতে গল্প হোক বা না হোক। সার্থকতা এই- পাঠক বলবে, আপনার গল্পটি ভাল লেগেছে। তাতে পরবর্তী গল্প লেখায় উৎসাহ পাবেন। তা না হলে সাহিত্যের অনিষ্ট করার কোন অধিকার আমাদের নেই। ছলচাতুরী করে পাঠকপ্রিয় হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা থাকতে নেই। কারণ আমরা যে সমাজের মানুষ; সে সমাজের ঘটনাই আমাদের গল্পের উপজীব্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে ভিন্ন একটি ধারা সৃষ্টির চিন্তা করছি। একই গল্প ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে দেখতে চাই- পাঠক সেটা গ্রহণ করে কিনা। তবে আমি কথকের ভূমিকায় থাকতে ভালবাসি বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তাই ভাবছি, পরবর্তী গল্পগুলো আমিই বলব। পাঠক শুধু শুনবে। বায়োগ্রাফিক্যাল স্টোরি লাইন নির্মাণ করার ইচ্ছা আছে। পাঠক ভাববে সব ঘটনাই আমার জীবনের। আসলে এর একটি ঘটনাও আমার জীবন সংশ্লিষ্ট নয়। আমরা গল্প লিখছি মানুষকে আনন্দ দিতে। পিছিয়ে পড়া মানুষকে শিক্ষা দিতে। অবহেলিত মানুষকে জাগাতে। এর যেটিই হোক না কেন, আমরা যে উদ্দেশ্যে লিখছি সেটা যেন সফল হয়। কারণ আনন্দ দিয়েও মানুষের কল্যাণ করা যায়। মানুষকে বিভিন্নভাবে উৎসাহ দেয়া যায়। আমাদের গল্প পড়ে যদি কেউ উপকৃত হন; তবে তা মানুষের কল্যাণের জন্যই লেখা। আবার আমাদের গল্প পড়ে যদি সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়; তাহলে তার জন্যও আমরাই দায়ী। আমি মনে করি, লেখক নিজে যদি জীবন সম্পর্কে উদাসীন হন, পরিবার বিমুখ হন, রাষ্ট্রবিরোধী হন- তবে সেই লেখক কখনও কারও উপকারে আসতে পারেন না। কারও কল্যাণ করতে হলে আগে কল্যাণ সম্পর্কে ধারণাটা তো তার থাকতে হবে। আর তা না হলে তিনি পাঠক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। নিজে নিজেই হতাশ হয়ে পড়বেন। তখন তার লেখাগুলো দিস্তায় দিস্তায় কাগজের আবর্জনা বলে মনে হবে। সুতরাং আমরা গল্প লিখব মানুষের কল্যাণে। আমরা সমাজটাকে যেভাবে চাই- ঠিক সেভাবে গল্পের ভেতরে প্রকাশের চেষ্টা করব। অসঙ্গতিগুলোকে হাইলাইটস করার চেয়ে সমাধানের বিষয়গুলো মোটাদাগে উপস্থাপনের চেষ্টা করব। তাহলেই মানুষের কল্যাণে আমাদের ছোটগল্প ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
×