ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রেজা নূর

আমির খানের ‘দঙ্গল’-এর চীন বিজয়

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৩১ অক্টোবর ২০১৭

আমির খানের ‘দঙ্গল’-এর চীন বিজয়

আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ব্যাপারে ভারত ও চীনের মধ্যে চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চীন যদিও সন্দেহাতীতভাবেই বহুদূর এগিয়ে গেছে তথাপি সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান চীনের চাইতে বেশ খানিকটা এগিয়ে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সম্প্রতি ভারতের বিখ্যাত অভিনেতা আমির খান অভিনীত ছবি ‘দঙ্গল’ চীনে বাজিমাত করে দেয়ায় বিশেষজ্ঞদের এই ধারণা যে অনেকটা সঠিক তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই ছবিটি একটি সত্য কাহিনী নিয়ে নির্মিত এবং এতে ইদানীংকালের হলিউড ব্লকবাস্টার ছবির সেই আকাশচুম্বী জাঁকজমক, ঠাঁট-বাট, ঢক্কানিনাদ, স্পেশাল ইফেক্ট আর চোখ ধাঁধানো জমকালো কোন দৃশ্য নেই যাতে কিনা বর্তমান সময়ের দর্শক ও তাদের চক্ষু-কর্ণ অভ্যস্ত। পক্ষান্তরে, ‘দঙ্গল’-এর রয়েছে সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী একটি কাহিনী। আর এই কাহিনী এতটাই প্রাণস্পর্শী ও মনোলোভা যে, চীনা দর্শকদের তা হৃদয় ছুঁয়ে গেছে অনায়াসেই। প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা ব্যাপ্তিকালের ছবিটি চীনে এখন ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে, যা কিনা ছিল অবিশ্বাস্য! গত গ্রীষ্মে চীনের বক্স অফিসে এই প্রথম কোন ভারতীয় ছবি আলোড়ন তুলল। এ ছবিতে না ছিল হলিউডি ছবির চাকচিক্য, না ছিল কোন চীনা অভিনেতা-অভিনেত্রী। তথাপিও ভারতীয় সংস্কৃতির সুবাসমাখা ছবিটি যে চীনাদের মনপ্রাণ ভরে দিল এতে করে ভারতীয় সংস্কৃতির গভীর দ্যোতনা ও ব্যঞ্জনারই হয়েছে জয়-জয়কার। ‘দঙ্গল’ মাত্র দুই মাসে চীনে প্রায় ২০ কোটি ডলারের ব্যবসা করেছে। আর এটি চীনের সর্বকালের চলচ্চিত্র ব্যবসার ক্ষেত্রে ২০টি সর্বোচ্চ ব্যবসা-সফল ছবির একটি হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। ‘দঙ্গল’-এ উঠে এসেছে একজন কুস্তিগীরের (আমির খান) স্বপ্ন পূরণের কাহিনী। কি নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও দৃঢ়তার সঙ্গে সে তার দুই কন্যাসন্তানকে বিশ্বমানের কুস্তিগীরে রূপান্তরিত করল সেই চমৎকার সত্য গল্পটির অসাধারণ রূপায়ণ হচ্ছে ‘দঙ্গল’। প্রায় শেষ দৃশ্যে ওই কন্যারা বিজয়িনীর বেশে যখন পদক গ্রহণ করে আর পেছনে ভারতের জাতীয় পতাকাটি পত্পত্ করে উড়তে থাকে এবং এরই সঙ্গে ভারতের জাতীয় সঙ্গীতটি ভেসে আসে, তখন সারা চীনজুড়েই প্রেক্ষাগৃহগুলোতে উপস্থিত দর্শকদের উল্লসিত ও আনন্দধ্বনিতে ফেটে পড়তে দেখা গেছে। চীন দেশে এ অবধি হলিউডি ঢঙের ছবিরই রমরমা ব্যবসা চলে আসছে। প্রযোজকরা সে ধরনের ছবিতেই সেখানে বিপুল অর্থ লগ্নি করে থাকে। কিন্তু ‘দঙ্গল’-এর বিপুল সাফল্য চীনা প্রযোজকদের ছবি নির্মাণ বিষয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে উৎসাহী করে তুলেছে। এক্ষেত্রে চীনা চলচ্চিত্র নির্মাতা কোম্পানিগুলো হলিউডি ছবি নিয়ে মাতামাতির স্থলে বলিউডি ছবির জন্য জায়গা করে দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক বিশেষ প্রতিবেদনে এসব কথা উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে যে, চীনা চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীদের এই আগ্রহ ও উদ্যোগ স্বাভাবিকভাবেই ভারতের জন্য খানিক অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈকি! কেননা, চীন ও ভারত সুদীর্ঘকাল ধরে আঞ্চলিক প্রভাব এবং নেতৃত্ব নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে বলতে গেলে যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে। গত গ্রীষ্মে হিমালয় পর্বত সংলগ্ন দূরবর্তী একটি গিরিখাতের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা বিষয়ে তাদের সৈন্যরা পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। কে না জানে যে, এরূপ স্থল সীমান্তে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেশ দুটির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। অসামরিক বিভিন্ন ক্ষেত্র, যেমনÑ ব্যবসা-বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ইত্যাদি নিয়েও চলে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ‘দঙ্গল’ এর সাফল্য চীনাদের মনে এই দ্বিধার জন্ম দিয়েছে যে, সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বোধ করি ভারতের তুলনায় তারা পিছিয়ে পড়েছে! পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক জিয়াং জিংকুই বলেনÑ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে চীনের ব্যাপকভিত্তিক উন্নয়ন ঘটেছে। তবে সফট পাওয়ার বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভারতের উন্নয়ন-উন্নতির মাত্রা চীনের তুলনায় বেশি। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে ভারত অনেক ভাল করছে বলে তিনি মনে করেন। তার মতে ভারতের অর্থনীতি ততটা উন্নত না হলেও তারা নিজেদের সংস্কৃতি এবং অন্যান্য বিষয় যেমন বৌদ্ধ-ঐতিহ্য, যোগসাধনা ইত্যাদির ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। উল্লেখ্য, ভারত সম্পর্কে চীনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়ে থাকে। আর এক্ষেত্রে সরকারী বার্তা সংস্থা সিনহুয়া ও সরকারী টিভি ইত্যাদি সর্বদাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। চীনের এত বিপুল জনসংখ্যা সত্ত্বেও দেশটি কেন সেখানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন চায় না তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চীনা মিডিয়া ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনমান, জীবন-ব্যবস্থার হতাশাব্যঞ্জক বিষয়াবলীকেই বা চিত্রটিই তুলে ধরে কেবল। চীনে অনেকেই ভারতকে ‘আ-সান’ বলে অভিহিত করে থাকে, যা এক ধরনের অবমাননাকর শব্দ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে ও বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে সাংহাইয়ের ব্রিটিশ বসতিতে নিয়োজিত শিখ প্রহরীদের ‘আ-সান’ বলা হতো। চীনা মিডিয়া ভারতের জাতপাত ও সেখানকার সমাজে নারীদের দুর্গতিপূর্ণ অবস্থানের বিষয়গুলোকেই ফলাও করে প্রচার করে থাকে। কখনও কখনও এসব মিডিয়ার প্রচার-প্রচারণা, ভাষা ও ভঙ্গির মধ্যে ব্যাপক জাতি-বিদ্বেষ প্রতিফলিত হয়। ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অবমূল্যায়ন ও তাদের প্রতি অবমাননাকর ভিডিও ক্লিপ প্রদর্শনীও করা হয়ে থাকে কখনও কখনও ওই মিডিয়ায়। এই জাতীয় প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে চীনা জনগোষ্ঠীর মনে ভারত সম্পর্কে এমন ভাবনা প্রোথিত করা অনেকটা সম্ভব হয়েছে যে, একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের অভ্যুদয় ঘটেছে বটে; কিন্তু উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখনও চীনের চাইতে যারপরনাই পিছিয়ে রয়েছে ভারত। এক চীনা জরিপে দেখা যায়, চীনের মাত্র ২৬ শতাংশ মানুষ ভারত সম্পর্কে খানিক উচ্চ ধারণা পোষণ করে থাকে। অবশ্য ২০০৬ সালেও এই সংখ্যা ছিল শতকরা ৩৩। মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারই বর্তমানে এই সংখ্যার হ্রাস যে ঘটিয়েছে তা তো বলাইবাহুল্য! ভারত সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা উঠলেই ভারতকে ‘অরাজকতাপূর্ণ’ একটি দেশ বলে উল্লেখ করতে দেখা যায় চীনা মহলে। উপরন্তু, চীনাদের মধ্যে এই ধারণাও বদ্ধমূল যে, ভারত একটি নোংরা ও অনিরাপদ দেশ। তাই চীনা পর্যটকরা ভারতে যেতেই চায় না। এক্ষেত্রে তাদের পছন্দের স্থান শ্রীলঙ্কা বা নেপাল। চীন ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের বয়স দুই সহ¯্রাধিক বছরেরও বেশি। এই দীর্ঘ সময় পরিক্রমণের বেদীমূলে দুই দেশের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহ্যগত বিষয়গুলোই অধিক ক্রিয়াশীল থেকেছে। উভয় দেশই অনেক বছর ধরে বন্ধুত্ব অধিক সুদৃঢ় করার প্রয়াসী বটে; কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা কি প্রভাব সৃষ্টি করে সে বিষয়টিসহ অন্য অনেক ব্যাপারেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয়। যেমনÑ চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের গভীর সম্পর্ক এবং চীন-ভারতের মধ্যকার ভূখ-গত বিবাদ ইত্যাদি নিয়ে ভারতের বহু মানুষই উদ্বিগ্ন। ভারতে সর্বস্তরেই সাধারণ ধারণাটি এই যে, ‘চীনকে বিশ্বাস করা যায় না।’ নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভাবকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়টিকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার প্রদান করছে। বৌদ্ধ ধর্মের জন্মস্থান এবং যোগ-সাধনার তীর্থভূমি হিসেবে ভারতকে তুলে ধরে বিশ্বে ভারতের আধ্যাত্মিক গুরুত্বকেও মেলে ধরছে ওই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। ভারতীয় শিল্পী-সাহিত্যিকরা সারা বিশ্বে, এমনকি চীনা পাঠকদের কাছ থেকেও স্বীকৃতি ও সুখ্যাতি লাভ করে চলেছেন। বলিউডও এ বিষয়ে বিশ্বব্যাপী বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ‘স্লামডগ মিলিওনিয়ার’ কিংবা সাম্প্রতিককালের ‘লায়ন’ ছবির ন্যায় বলিউডি ছবি বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফলে ভারতীয় অভিনেতা-অভিনেত্রী ও ভারতীয় গল্প-কাহিনী সুনাম কুড়াচ্ছে সর্বত্র। অন্যদিকে চীনও তার সাংস্কৃতিক ধারার বিকাশ ঘটাবার ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। তাদের এই সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রসার ঘটাবার জন্য অন্যতম যে প্রকল্পটিকে তারা বাস্তবায়ন করতে চলেছে তা হলোÑ তাদের এক ট্রিলিয়ন ডলারের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্পটি। এটি বাস্তবায়ন হলে চীনা সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ও পসার ঘটবে বলেই চীনা নেতৃত্বের বিশ্বাস। এদিকে, সিনহুয়া ও চীনা সেন্ট্রাল টেলিভিশন চীনা দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক খবরাখবর পরিবেশনের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী এদের কর্মকা- ছড়িয়ে দেয়ার আয়োজন করেছে। চীনের কোন কোন সাংস্কৃতিক উদ্যোগ আবার ব্যাপক সমালোচনারও সম্মুখীন হয়েছে বলে জানা যায়। যেমনÑ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসগুলোতে কনফুসীয় ইনস্টিটিউট স্থাপনের উদ্যোগ। অন্যদিকে দেখা যায়, চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে বিপুল অর্থ লগ্নি করেও চীনা চলচ্চিত্র বিশ্বব্যাপী তেমন কোন আকর্ষণই সৃষ্টি করতে পারেনি আজও। চীনের সাম্প্রতিককালে নির্মিত ‘গ্রেটওয়াল’ চলচ্চিত্রটি বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন তুলবে এমনটা ধারণা করা হলেও চীনের বাইরে বেশিরভাগ দেশেই তা ফ্লপ করেছে। এজন্য কেউ কেউ চীনের চলচ্চিত্র শিল্পের কম বয়সকেই দায়ী করেছে (অর্থাৎ, এই শিল্পটি খুব বেশি দিনের পুরনো নয় সেখানে)। কিন্তু এ কথা আদতে ধোপে টেকে না। প্রধানত ব্যবসায়ী বুদ্ধির প্রাবল্য ও মুনাফা লাভের আকাক্সক্ষায় দর্শকদের বেশি বেশি আনন্দ দেয়ার জন্য নির্মিত এসব ছবির মান এবং গল্প স্বাভাবিকভাবেই খুবই অনাকর্ষণীয় হয় বিধায় তা দর্শক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে। চলচ্চিত্রের মান, নির্মাণশৈলী, অভিনয় এবং গল্পের বুনটই হচ্ছে এর সাফল্যের চাবিকাঠি। চীনারা ভারতের ‘দঙ্গল’ ছবিটির মাঝে এসব বিষয়ই বিশেষভাবে খুঁজে পেয়েছে আর তাই ছবিটি তাদের হৃদয়কে এত নাড়া দিয়েছে। চীনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট গু ওয়ান চেং বলেছেন, চীনে এই শিল্প বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার থাকে কেবল অর্থ বা বিত্তবানদের হাতে। ফলে এ ধরনের লোকদের কাছে ভাল গল্পের কোন কদর নেই। আর তাই এরা মেগাস্টার আর স্পেশাল ইফেক্টের ছবির পেছনেই অর্থ লগ্নি করতে আগ্রহী থাকে। পক্ষান্তরে, বলিউডের ব্যাপারটি আলাদা। সেখানেও বিগ বাজেটের ছবি হয়। তবে নির্মাণশৈলীর সবদিক নির্মাতারা বিশেষ বিবেচনায় নিতে কখনই ভুল করেন না। আর এ কারণেই বলিউড এত সাফল্য লাভ করে চলেছে বলে মনে করেন গু ওয়ান। লেখক : সাংবাদিক
×