ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা রাজনীতিতে খালেদা ॥ তিনদিন কোন্দল মেটাতে একদিন ত্রাণ বিতরণে

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ৩০ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা রাজনীতিতে খালেদা ॥ তিনদিন কোন্দল মেটাতে একদিন ত্রাণ বিতরণে

শংকর কুমার দে ॥ মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে ১৯৭৮ সাল থেকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তার শাসনামলে ৩৮ বছর আগে যে রোহিঙ্গা রাজনীতি শুরু করেন সেই ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গা রাজনীতিতে মাঠে নেমেছে তার স্ত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণের নামে বিএনপির দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে নির্বাচনী প্রচারের জন্য রোহিঙ্গা রাজনীতির মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা দিতে চার দিনের মধ্যে মাত্র একদিন ত্রাণ বিতরণ করবেন বেগম খালেদা জিয়া। বাকি তিন দিন ব্যস্ত থাকবেন বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিকে সামনে রেখে নির্বাচনী প্রচারে। প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে শতাধিক গাড়িবহর নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশে বিলাসবহুল সফরের সময়ে গাড়িবহরে যে হামলার ঘটনা ঘটেছে তার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণের নামে কক্সবাজার যাত্রার উদ্দেশে রওনা হবার পর রাস্তায় তার গাড়িবহরে যে হামলা হয়েছে তার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করছে বিএনপি। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এর জন্য দায়ী করছে বিএনপির দলীয় স্থানীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। পাঁচ বছর আগে ২০১২ সালে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে গিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। এখন রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণের জন্য পাঁচ বছর পর আবার বেগম জিয়ার কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রাকালে দলীয় নেতা-কর্মী, ক্যাডারদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করতে রোহিঙ্গা রাজনীতি সামনে আনা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণের নামে রোহিঙ্গা রাজনীতিকে সামনে আনতে গিয়ে গাড়িবহরে হামলার ঘটনাটির তদন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ১৯৮২ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে অবস্থান করে চট্টগ্রামের বিএনপির দলীয় কোন্দল মিটাতে গিয়ে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন। ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গীদের যোগসাজশ ছিল বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর তখনও তদন্ত হয় গোপনে, যা অদ্যাবধি প্রকাশ পায়নি। এখন আবার বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণের জন্য কক্সবাজার উদ্দেশে রওনা দেয়ার পর পথে গাড়িবহরে হামলার ঘটনাটি ঘটেছে, যাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরকে দায়ী ও দোষারোপ করছে। বেগম জিয়া ফেনী, চট্টগ্রামে অবস্থানকালে বিএনপির স্থানীয় রাজনীতিতে কে নির্বাচনী টিকেট পাবেন আর কে পাবেন না তা নিয়ে শোডাউন দেখানো নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। স্থানীয় রাজনীতিতে দেখা যায়, একজন আওয়ামী লীগ করলে তার আত্মীয়স্বজন আবার বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি করলেও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে ব্যবসা-বাণিজ্য করে টাকা পয়সা কামানোর উদ্দেশে তারা সময়ে সময়ে এক হয়ে যায়। বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে তাতে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হওয়ায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত শুরু করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, গত ২৮ অক্টোবর ৪ দিনের সফরে গিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া শেষ বারের মতো চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন পাঁচ বছর আগে ২০১২ সালে। মূলত রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণের উদ্দেশে যাত্রা করে ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী প্রচারের জন্য দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগানোর চেষ্টা করা হয়। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির পক্ষে স্থানীয় পর্যায়ে জনমত তৈরি করতেই তাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন দলের নীতি নির্ধারকরা। এ ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে তিনি দুর্বল থাকলেও নেতাকর্মীদের আগ্রহ ও আগামী নির্বাচনকেই বিশেষ বিবেচনায় নিয়েছেন খালেদা জিয়া। দলটির একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে তাদের এই ধরনের মনোভাবের কথা জেনেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। খালেদা জিয়ার চার দিনের সফরের সিদ্ধান্তে চট্টগ্রাম বিভাগীয় অঞ্চলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় দলীয় প্রধানকে যাত্রাপথে শুভেচ্ছা জানাতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি ছিল ব্যাপক। গত ২৮ অক্টোবর সকাল দশটায় খালেদা জিয়া গুলশানের বাসভবন ফিরোজা থেকে নয়াপল্টনের উদ্দেশে রওনা হন। তার সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির একটি বিশাল বহর। সকাল সাড়ে ১০ টায় নয়াপল্টন থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হবেন বিএনপি নেত্রী। পথে তার নির্বাচনী জেলা ফেনীর সার্কিট হাউসে দুপুরের খাবার ও নামাজের বিরতি দেন। এরপর সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হন। চট্টগ্রাম নগরীর সার্কিট হাউসে রাত্রিযাপন করেন। পরদিন কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হন তিনি ও তার গাড়িবহর। কক্সবাজার সার্কিট হাউসে যাত্রা বিরতির পর ৩০ অক্টোবর সকাল ১১ টায় কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে যাত্রা করবেন খালেদা জিয়া। বেগম খালেদা জিয়া বালুখালী-১, বালুখালী-২, হাকিমপাড়া ও ময়নারগুনায় রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করবেন। এরপর দুপুর ২ টার দিকে জেলার সার্কিট হাউসে বিশ্রাম নিয়ে রাতে চট্টগ্রামে এসে রাত যাপন করবেন। ৩১ অক্টোবর মঙ্গলবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন বিএনপির চেয়ারপার্সন। পথে ফেনীতে থামবেন। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার রোহিঙ্গাদের ত্রাণের নামে যে নির্বাচনী রাজনীতির সফরসূচীর সংক্ষিপ্ত বিবরণী সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিভাগের বিপুলসংখ্যক জনতা বিএনপি চেয়ারপার্সনকে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুতি নেয়ার কর্মসূচী রেখেছে। দলীয় প্রধানের চট্টগ্রামে দুই রাতের যাত্রাবিরতিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দেন দলের নীতি নির্ধারকরা। দলের নীতি নির্ধারকদের নির্দেশনা অনুযায়ী নেতাকর্মীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দলীয় নেত্রীকে স্বাগত জানাবেন। প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে দলের নেত্রীকে অভিনন্দন জানানোর আগাম কর্মসূচী দেয়া হয়। চার দিনের সফরে মাত্র কয়েক ঘণ্টা রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করবেন খালেদা জিয়া। বাকি সময়টুকু বিশ্রাম, যাত্রাপথ ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাতে কাটবে তার। যেই অঙ্কের টাকার ত্রাণ বিতরণ করা হবে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অঙ্কের টাকা ব্যয় হবে শতাধিক গাড়িবহরের তেল খরচায়, নেতাদের যাতায়াত, খানাপিনা ও বিলাসবহুল যাত্রায়। বিমান, বাস ও ট্রেনে কক্সবাজারের পথ ধরেছেন কয়েক শত নেতাকর্মী। এদিকে, খালেদা জিয়ার চট্টগ্রাম বিভাগের সফরকে কেন্দ্র করে পুরো অঞ্চলেই দলীয় উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে খালেদা জিয়ার শোডাউন রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণের ঘটনাটি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাজনীতির প্রথম শুরুটা করেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রয়াত জিয়াউর রহমান। আর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্ত্রী বিএনপির চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। আর রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার পর জঙ্গীগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত। এরই ধারাবাহিকতার জের এখন টানতে হচ্ছে ১৪ দলীয় জোটের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এখন আবার রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণের নামে রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণের রাজনীতি করতে গিয়ে গাড়িবহরে হামলার ঘটনাটি ঘটিয়ে রাজনীতির ময়দানে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে, যার তদন্তে নেমেছে বলে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার দাবি।
×