ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিদিন গড়ে কল আসে চার শ’

নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ব্রহ্মাস্ত্র হেল্পলাইন ‘১০৯’

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ব্রহ্মাস্ত্র হেল্পলাইন ‘১০৯’

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে গঠিত হয়েছে জাতীয় টোল ফ্রি হেল্পলাইন ‘১০৯’। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ দেশের যে কোন স্থান থেকে উল্লিখিত নম্বরের হেল্পলাইনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের পরিবার বা অন্যান্য সবার প্রয়োজনীয় তথ্য, পরামর্শসহ দেশের বিরাজমান সেবা এবং সহায়তা সম্পর্কে জানতে পারবেন। চলতি মাসেই বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় ১৩ বছর বয়সী এক মেয়ে শিশুকে তার বাবা-মা জোরপূর্বক বাল্যবিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে। ঠিক সে সময় তার প্রতিবেশী ফোন করেন জাতীয় হেল্পলাইন নম্বর ১০৯ তে। তথ্যপ্রদানকারীর কাছ থেকে কল সেন্টারের পরামর্শদাতারা জেনে নেন কবে, কখন ও কোথায় বাল্যবিয়েটি ঘটতে যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে যোগাযোগ করা হয় গৌরনদী উপজেলার মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা, ওসি, ইউওনও ও চেয়ারম্যানের সঙ্গে। তারা সবাই একত্রিত হয়ে পৌঁছে যান সঠিক সময়ে। এরপর তাদের প্রচেষ্টায় বন্ধ হলো ওই বাল্যবিয়েটি। শুধু বাল্যবিয়েই নয়, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, বাল্যবিয়ে বন্ধ, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে এ হেল্পলাইন কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। মুঠোর মধ্যে এ সেবা পেতে শুধু ১০৯ নম্বরে ফোন করতে হবে। তবে তৃণমূল পর্যায়ের অনেকেই এ নম্বর সম্পর্কে না জানার অবহিত না হওয়ায় এমনকি জানলেও সচেতনতার অভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন নেত্রীরা। তবে ধীরে হলেও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘১০৯’ হেল্প লাইনের সুফল পেতে শুরু করেছে নির্যাতিত নারী ও শিশুরা। যার স্পষ্টতা মিলেছে বরিশালের তরুণীর বাল্যবিয়ে বন্ধের মাধ্যমে। নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সেবা দিতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলা অধিদপ্তর জাতীয় কল সেন্টার বা হেল্পলাইন চালু করে ২০১২ সালের ১৯ জুন। বর্তমানে এই হেল্পলাইনটিতে ২৪ ঘণ্টায় ৪শ’ কল আসে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল হোসেন হেল্পলাইন প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রম এখন দেশের আনাচে কানেছে পৌঁছেছে। প্রতিদিন ৪শ’ ফোন আসছে কল সেন্টারে। যেখানে বাল্যবিয়ে, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার নারীরা ফোন করে পরামর্শ চাইছেন। অনেক ক্ষেত্রে আমরা পরামর্শ দিয়ে থাকি কিভাবে সে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবেন। আবার বাল্যবিয়ে বা ধর্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা তৎক্ষণাৎ ওই এলাকার বিবরণ জেনে সেখানকার ওসি কিংবা ইউওনও ও চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সহায়তা প্রদান করি।’ তবে গ্রাহক যাতে সমস্যায় না পড়ে সে জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সরকার বলে জানালেন আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্তে ২০১৭ সালের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব বইয়ের পেছনে এই হেল্পলাইন নম্বরটি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাকের বিভিন্ন প্রকাশনায় এই হেল্পলাইন নম্বরটি দেয়া আছে। এমনকি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এই হেল্পলাইনের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। যেখানে আগে একসঙ্গে দশটি লাইনে একসঙ্গে কথা বলা যেত, সেটার সক্ষমতা বাড়িয়ে এখন ৩৫ লাইন একসঙ্গে রিসিভ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে স্বাস্থ্য সহায়তা, কাউন্সিলিং, পুলিশি সহায়তা, আইনী সহায়তা, তথ্য সরবরাহ ও অন্যান্য সব বিষয়ে মোট ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৫৮ গ্রাহককে সেবা প্রদান করা হয়েছে জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯ এর মাধ্যমে। এছাড়া চলতি বছরের বিগত নয় মাসে এ ধরনের সহায়তা গ্রহণ করেছেন ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৪২ গ্রাহক। যা বিগত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। হেল্পলাইন সার্ভিসের বিষয়ে বিস্তারিত জানান মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদফতরের গবেষক কর্মকর্তা শায়লা ইয়াসমিন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা তাৎক্ষণিক সেবা ফোনেই দিয়ে থাকি। কোন নির্যাতিতা নারী ‘১০৯’ নম্বরে ফোন করলেই তার সমস্যা শুনে আমরা পরামর্শ দিই। সেটা আইনী সহযোগিতা হতে পারে, কাউন্সিলিং হতে পারে, উদ্ধার হতে পারে। তিনি বলেন, এই হেল্পলাইনটি ২০১২ সালের ১৯ জুন চালু হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টোল ফ্রি করেন ২০১৪ সালের ৮ মার্চ। তখন থেকে ২৪ ঘণ্টাই চালু রয়েছে এই হেল্পলাইনটি। এখন থেকে যে সার্ভিসগুলো দেয়া হয়, তার মধ্যে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের আমরা সহায়তা করছি বা নির্যাতন ঘটতে গেলে আমরা সহায়তা করছি। এছাড়া বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে, ইভটিজিং প্রতিরোধে সহায়তা, পুলিশি সহায়তা, আইনী সহায়তা, মেডিক্যাল সাপোর্ট এবং কাউন্সেলিং দেয়া হচ্ছে, গৃহপরিচারিকা নির্যাতন বা উদ্ধারে সহায়তা দেয়া হচ্ছে এই হেল্পলাইন থেকে।’ নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সহযোগিতায় ইস্কাটনের মহিলাবিষয়ক অধিদফরের ৮ম তলায় চালু রয়েছে এই কলসেন্টারটি। কলসেন্টারে রয়েছে ৩৫ হেলপ ডেস্ক। একসঙ্গে ৩০ জনকে সরাসরি সহযোগিতা দিতে সক্ষম এই হেল্পসেন্টারটি। একই সঙ্গে ৫০ জন এই কলসেন্টারের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে ফ্রি কল করে কথা বলা যায় এই নম্বরে। দেশের সবকটি মোবাইল কোম্পানি এবং টেলিফোন নম্বর দিয়ে এই নম্বরে ফোন করা যায়। ফোনালাপ গোপন রেখে হেলপলাইনে অভিযোগ শোনার পর, বিভিন্ন সমস্যার প্রয়োজনীয় সমাধান দিয়ে থাকেন সেবা প্রদানকারীরা। সহজে মনে রাখার লক্ষ্যে পরিবর্তন হচ্ছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল উইমেন হেল্পলাইন সেন্টারের শর্টকোড নম্বরটি। চলতি বছরের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারী ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী পাঁচ ডিজিটের ১০৯২১ থেকে তা পরিবর্তিত হয়ে তিন ডিজিটের ১০৯ এ রূপান্তরের ঘোষণা দেন। তবে হেল্পলাইনের সার্ভিস নিয়ে অভিযোগ করে রাজধানীর এক নারী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘হেল্পলাইন নম্বরটিতে ফোন করলে ৪৫ সেকেন্ড পর কথা বলার সুযোগ হয় গ্রাহকের। এই সময়টা ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ড পর করলে ভাল হয়। এই ধীর গতিসম্পন্ন কলে অনেকে বিরক্ত হন। যেমন আমি হয়েছিলাম।’ তবে এ বিষয়টি স্বাভাবিক বিষয় বলে জানান মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদফরের গবেষক কর্মকর্তা শায়লা ইয়াসমিন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এই ৪০ সেকেন্ড সময় নেয়া হয় মূলত গ্রাহকের সুবিধার জন্য। এ সময়টিতে কলসেন্টার থেকে বলা হয়, আপনার কলটি কর্মকর্তাদের কাছে ট্রান্সফার করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে রেফারেন্স হিসেবে আপনার কথোপকথন রেকর্ড করা হচ্ছে’। এরপর তারা সরাসরি উপস্থিত কর্মকর্তার সঙ্গে সহজেই কথা বলতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকরা অভিযোগ করে বলেন কেন তাদের কথা রেকর্ড করা হয়নি। সেজন্যই গ্রাহকের কথাগুলো রেকর্ড করার বিষয়টি আগেই জানিয়ে দেয়া হয়।’ সরকারের সর্বশেষ জরিপমতে, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হেল্পলাইন নম্বর ১০৯ সম্পর্কে জানেন মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১২ সালের জুন মাসে সরকার এ সেবা চালু করে। নির্যাতনের শিকার বা নির্যাতনের আশঙ্কায় থাকা যে কেউ এ নম্বরে ফোন করে সহায়তা নিতে পারেন। চলতি বছরের ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ৬১ পাঠ্যবইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় নম্বরটি দেয়া হয়। তবে ১ মার্চ থেকে হেল্পলাইন নম্বরটি (১০৯) পরিবর্তন হয়েছে। এ বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের পরিচালক আবুল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘হয়তো হেল্পলাইন নম্বরটি প্রতিটি ঘরে পৌঁছাতে পারেনি। তাই নম্বরটির প্রচার বাড়ানোর জন্য আমরা সর্বদা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। দেশের আনাচে-কানাচে পোস্টারিং, লিফলেট, সব মোবাইল ফোন কোম্পানির গ্রাহকদের কাছে খুদে বার্তা পাঠানোসহ, প্রিন্ট ও ইলেকক্ট্রনিক মিডিয়াতে ১০৯ হেল্পলাইন বিষয়ে প্রচার চলছে। যে নারীরা আর কারও কাছেই নির্যাতনের কথা প্রকাশ করতে পারেন না, তারা একটি ফোন করেই নির্যাতনের তথ্য জানিয়ে সহজেই সহায়তা পেতে পারেন।’ ১০৯ এমনই এক ব্রহ্মাস্ত্র উল্লেখ করে মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট সালমা আলী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবারে মা-বাবা বা বয়োজ্যেষ্ঠরা মেয়ে সন্তানদের যে কোন ধরনের হয়রানিতে ১০৯-এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা নেয়ার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেবেন। এমনকি পরিবারের ভেতর আত্মীয়-অনাত্মীয় কারও দ্বারা আক্রান্ত হলেও জানাতে হবে। বিবাহিত নারীরা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আচরণে বেচাল দেখলে চরম সহিংসতা ঘটানোর আগেই ১০৯-এ কল করবেন। সরকারী-বেসরকারী-ব্যক্তি উদ্যোগে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, যানবাহন, যাত্রীছাউনি, হাসপাতাল, বাড়িঘর, দোকানপাটে ১০৯ নম্বরটির উপযোগিতাসংবলিত স্টিকার লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে মাঝেমধ্যেই মোবাইলে এ বিষয়ে খুদে বার্তা পাঠাতে হবে। তিনি বলেন, ‘সরকারীভাবে ব্যাপক প্রচার চলছে এই হেল্পলাইনটির বিষয়ে। এখন জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। হেল্পলাইনের মাধ্যমে মানুষকে নিরাপত্তার বোধ দেয়া হয়ে থাকে। জনসচেতনতা পারে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করতে। প্রতিবেশীরাও আজকাল বাল্যবিয়ে বন্ধে ১০৯ এ ফোন করছে। তার মানে দেশের জনগণ সচেতন হচ্ছেন। তবে তিনি এসব কার্যক্রমে আরও লোকবল বাড়ানো উচিত বলে মন্তব্য করে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকার ওসিসি সেন্টারে লোকবলের অভাব রয়েছে। সেখানেও নির্যাতিত নালীর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়। কারণ সেবাদাতারাই বিভিন্নভাবে সেখানে আশ্রিত নারীদের অবজ্ঞা করেন।’ নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টারে টোল ফ্রি হেল্পলাইন ১০৯ নম্বরে ফোন করে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু, তাদের পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট সবার প্রয়োজনীয় তথ্য, পরামর্শসহ দেশে বিরাজমান সেবা এবং সহায়তা সম্পর্কে জানতে পারেন। ২০১৭ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ৬৩ পাঠ্যপুস্তকের কভারে নম্বরটি দেয়া হয়েছে; যাতে নারী ও শিশুরা সহজেই সেবা নিতে পারে। এছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ রোধকল্পে এ্যাডভোকেসি প্রোগ্রামের আওতায় দেশব্যাপী ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। দেশব্যাপী নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সেবাপ্রাপ্তির সুবিধার্থে দেশের ৪০ জেলা সদর হাসপাতালে এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল স্থাপন করা হয়েছে।
×