ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নওগাঁর দুবলহাটি রাজবাড়ি

বিশাল রাজপ্রাসাদ, মন্দির স্কুল, নাট্যশালা মুছে যাচ্ছে স্মৃতিচিহ্ন

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

বিশাল রাজপ্রাসাদ, মন্দির স্কুল, নাট্যশালা মুছে যাচ্ছে স্মৃতিচিহ্ন

বিশ্বজিৎ মনি সৃষ্টি আর ধ্বংসের খেলায় এগিয়ে চলছে পৃথিবী। কেউ মত্ত সৃষ্টিতে, কেউ ধ্বংসে। এর মাঝে অবহেলা আর দায়িত্বহীনতার কারণে কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের কিছু স্মৃতিচিহ্ন। সুজলা সফলা শষ্য শ্যামলা এই বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাসের নানা স্মৃতিচিহ্ন। ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো বাঙালীর সত্তাতে আলোড়ন সৃষ্টি করে আজও। তেমনি ঐতিহাসিক স্থান নওগাঁর দুবলহাটি রাজবাড়ি। জেলা সদর থেকে মাত্র ৬ কি.মি. দক্ষিণে রাজবাড়িটির অবস্থান। ২শ’ বছরের পুরনো এই রাজবাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এখনও। সরকার উদ্যোগ নিলে এটি হয়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। ১৭৯৩ সালে রাজা কৃষ্ণনাথ লর্ড কর্ণওয়ালিসের কাছ থেকে ১৪ লাখ ৪৯৫ টাকা দিয়ে এই জমিদারিটি পত্তন নিয়ে রাজ্য চালাতে শুরু করেন। ১৮৫৩ সালে রাজা হরনাথ রায় এই রাজত্বভার গ্রহণ করেন। রাজা হরনাথের আমলে দুবলহাটি রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। তিনি দুবলহাটি রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, নাট্যশালা নির্মাণ এবং প্রজাদের সুপেয় পানীয় জলের কষ্ট লাঘবে রাজপ্রাসাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক পুকুর খনন করেন। ১৮৬৪ সালে রাজপরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে স্কুলটির নামকরণ করা হয় ‘রাজা হরনাথ উচ্চ বিদ্যালয়’। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর রাজা হরনাথ রায় চৌধুরী সপরিবারে ভারতে চলে যান। কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে যায় সুবিশাল রাজপ্রাসাদটি। রাজবাড়ির প্রধান ফটকে রোমান স্টাইলের স্তম্ভগুলো রাজাদের রুচির পরিচয় বহন করে। রাজবাড়িতে সব মিলিয়ে ৭টি আঙিনা, ৩শ’টি ঘর এবং প্রাসাদের ভেতরে ভবনগুলো কোনটি ৩ তলা আবার কোনটি ৪ তলা ছিল। প্রাসাদে ছিল রাজরাজেশ্বরী মন্দির। যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় জ্বালানো হতো সন্ধ্যাপ্রদীপ। শোনা যেত শঙ্খের ধ্বনী। যা কালের বিবর্তনে আজ পরিণত হয়েছে জনমানবহীন শ্মশানে। রাজবাড়িতে এখনও শান বাঁধানো এঁদেরার (কুয়ো) অস্তিত্ব রয়েছে। রাজবাড়ির সামনে রয়েছে বিশাল গোবিন্দ পুকুর। চারধারে ছিল শান বাঁধানো ঘাট। পুকুরের পূর্বপাড়েই ছিল নাট্যশালা। যেখানে গান-বাজনা, যাত্রা-থিয়েটারসহ চলত বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান। এই নাট্যশালার অদূরেই ছিল কালীমন্দির। যেখানে আগাছা আর জঙ্গলে পরিপূর্ণ। কালীমন্দির থেকে মাত্র ৫শ’ গজ উত্তরে ছিল রাজার বাগানবাড়ি। বাগানবাড়ি এলাকাজুড়ে ছিল আমবাগান। স্থানীয়রা এই বাগানবাড়িকে ছোট রাজবাড়ি বলত। এই বাগানবাড়িতে বর্তমানে দুটি পরিবার বসতি স্থাপন করেছে। বর্তমানে রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখে অনায়াসেই বোঝা যায়, তৎকালীন এখানকার রাজাদের ব্যাপক জৌলুস ছিল। রাজ্য বিস্তারে ব্যাপক প্রভাব ছিল এই রাজপরিবারের। রাজা খেতাব পেয়েছিলেন হরনাথ রায় চৌধুরী। তার পূর্বপুরুষরা মুঘলদের দেয়া জমিদার খেতাবে ভুষিত ছিলেন। রাজপরিবারের গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে অন্তর্ভুক্ত ২২ কাহন কৈ মাছ দিয়ে রাজস্ব প্রদানের স্বীকৃতি রয়েছে। বর্তমানে রাজবাড়ির প্রধান গেটের পাশে আবাস গড়ে তুলেছে এক ছিন্নমূল পরিবার। দোতলায় কয়েক বছর থেকে কবুতর পালন করছে স্থানীয় এক যুবক। জমিদারি বিলুপ্ত হওয়ার পর সরকার এই রাজবাড়িকে সরকারী সম্পদ হিসেবে গ্রহণ করে দেখভালের দায়িত্ব দেয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দায়িত্ব গ্রহণ করলেও এই প্রত্ন সম্পদটি রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেয়নি এখনও। স্থানীয় প্রভাবশালীদের কবলে পড়ে দিনের পর দিন রাজবাড়ির মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লুটপাট হয়ে গেছে। মূল্যবান দরজা, জানালা, শাল কাঠের তীর লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর দালানের ইট খুলে নিয়ে এলাকার অনেকেই বাড়ি তৈরি করেছে। অবহেলা আর অযত্নে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুবলহাটি রাজবাড়িতে এখন সকাল-সন্ধ্যা চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। অবাধে চলছে মদ, জুয়া আর গাঁজার আড্ডা। সেই সঙ্গে প্রচলিত হয়ে উঠেছে ইয়াবা, হেরোইন, নেশাজাত ইনজেশন আর রাতের আঁধারে নারী দেহ ব্যবসা। স্থানীয়দের মতে এই রাজবাড়ি এখন হয়ে উঠেছে অসামাজিক কার্যকলাপের উন্মুক্ত কেন্দ্রবিন্দু। এগুলো যেন দেখার মতো কেউ নেই। বর্তমানে প্রয়োজন এই ঐতিহাসিক রাজবাড়িটির সংস্কার। এটি সংস্কার করা হলে এই রাজবাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। ইতিহাসের সাক্ষী এই দুবলহাটি রাজবাড়িটি সংস্কার করে পর্যটকদের জন্য দর্শনীয় করে তোলার জন্য দাবি করেছে এলাকাবাসী।
×