ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

মিলন কান্তি দে

যাত্রাভিনেতা অমলেন্দু বিশ্বাস

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২৭ অক্টোবর ২০১৭

যাত্রাভিনেতা অমলেন্দু বিশ্বাস

মুক্ত স্বদেশে ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ অমলেন্দু বিশ্বাসের নতুন পদচারণা। চট্টগ্রামের বাবুল অপেরার প্রয়োজনের মাইকেল মধুসূদনের পালা মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে তাঁর গৌরবময় যাত্রা জীবনের নবযাত্রা শুরু। মাইকেলের পর লেনিন, হিটলার। এ দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য জীবন কাহিনীর রূপায়ণ ঘটান যাত্রাপালার আসরে। হিটলার-এ তিনি যুদ্ধবাজ একনায়কের নিষ্ঠুরতার চিত্র তুলে ধরেছেন। লেনিন-এ শুনিয়েছেন মার্কসীয় দর্শনের আলোকে শোষণহীন সমাজব্যবস্থার কথা ঐতিহ্যবাহী যাত্রাভিনয়কে যিনি নাগরিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যাঁর সৃজনশীল শিল্পকর্মের নব নব উপস্থাপনা যাত্রাকে নতুন মাত্রাবোধে উজ্জীবিত করেছে তিনি যাত্রালোকের মহারেখী, একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য শিল্পী অমলেন্দু বিশ্বাস। আজ শুক্রবার তাঁর ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী। অমলেন্দু বিশ্বাসের পূর্ববর্তী কিংবা সমসাময়িক যাত্রাশিল্পীদের জনপ্রিয়তা ছিল মূলত অভিনয়কেন্দ্রিক। সন্দেহ নেই, তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন গুণী শিল্পী। কিন্তু সমকালীন চিন্তা-চেতনা ও জীবনঘনিষ্ঠ উপলব্ধি না থাকার কারণে তাঁরা কেউ বিশ্বাসের মতো সমপর্যায়ের ব্যক্তিত্ব হতে পারেননি। গুণী শিল্পীদের মধ্যেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। এখানে অমলেন্দু বিশ্বাসের প্রতিভাবে আমরা ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্যের একটি ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারি-‘মানস-সরসে সরস-কমলকুল বিকশিত যথা।’ অমলেন্দু বিশ্বাসের পৈত্রিক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার সীতাকু- থানার মছজিদ্দা গ্রামে। জন্ম মাদ্রাজের এগামোর হাসপাতালে ১৯২৫ সালে। বাবা সুরেন্দ্রলাল বিশ্বাস তখন থাকতেন ইয়াঙ্গুন শহরে। তিনি ছিলেন সেখানকার কাস্টমসের সুপারিনটেনডেন্ট। মা জ্ঞানদা দেবী। ঘটনাবহুল তাঁর জীবননাট্য। সপ্তম শ্রেণীতে প্রথম অভিনয় ‘দাতা হরিশচন্দ্র’ নাটকে। ১৯৪১ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষার পর কলকাতায় ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সে যোগদান, জব্বলপুর মিলিটারি হেড কোয়ার্টারের বেঙ্গলি ক্লাবে নাটকে অভিনয়, ররার্টসন কলেজ থেকে এফএ পাস, তারপর কিছুদিন সিনেমার নায়ক হবার ব্যাকুলতা, টালিগঞ্জের রঞ্জিত মুভিটোনে মাসিক বেতনে চাকরি, ১৯৪৯ সালে দেশে ফিরে আসা, চট্টগ্রাম রেলওয়ে জোনে যোগদান, পাশাপাশি নাট্যচর্চা, ১৯৫৮ সালের গণসঙ্গীত স্কোয়াডের সদস্য হিসেবে গ্রামেগঞ্জে বিপ্লবী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, অতঃপর আইয়ুব সরকারের গ্রেফতারী পরোয়ানা থেকে রক্ষা পেতে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিলেন যাত্রাদলকে। যাত্রাভিনয়ে অমলেন্দু বিশ্বাসকে আবিষ্কার করেন সেই আমলের বিখ্যাত যাত্রা সংগঠক তুষার দাশগুপ্ত। তখন ১৯৬১ সাল। অভিনেতা-নির্দেশক হয়ে প্রথমে যোগ দেন সিরাজগঞ্জের বাসন্ত অপেরায়। পরে চট্টগ্রামের বাবুল অপেরা, গীতশ্রী অপেরা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কমলা অপেরার মাধ্যমে তাঁর মেধা ও প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। ’৬০-এর দশকে একজন জাঁদরেল যাত্রানট হিসেবে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করেন তিনি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রয়েছে যেসব যাত্রাপালায় : জালিয়াত, প্রতিশোধ, সোহ্রাব-রুস্তম, রাজ সন্ন্যাসী, চন্দ্রশেখর, গৃহলক্ষ্মী, চাঁদ সুলতানা ও দোষী কে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি যাত্রার আসরে নিয়ে আসেন বিপ্লবী পালা ‘একটি পয়সা’। মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত যাত্রাদল নট্ট কোম্পানিতে বিশিষ্ট নট ও নাট্যকার মহেন্দ্র গুপ্তের সান্নিধ্যে অভিনয় করেন তিনি। মুক্ত স্বদেশে ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ অমলেন্দু বিশ্বাসের নতুন পদচারণা। চট্টগ্রামের বাবুল অপেরার প্রয়োজনের মাইকেল মধুসূদনের পালা মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে তাঁর গৌরবময় যাত্রা জীবনের নবযাত্রা শুরু। মাইকেলের পর লেনিন, হিটলার। এ দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য জীবন কাহিনীর রূপায়ণ ঘটান যাত্রাপালার আসরে। হিটলার-এ তিনি যুদ্ধবাজ একনায়কের নিষ্ঠুরতার চিত্র তুলে ধরেছেন। লেনিন-এ শুনিয়েছেন মার্কসীয় দর্শনের আলোকে শোষণহীন সমাজব্যবস্থার কথা। বাংলাদেশে তাঁর অভিনীত দলগুলো হচ্ছে-বাবুল অপেরা, গীতশ্রী অপেরা, বাণীশ্রী অপেরা এবং চারণিক নাট্যগোষ্ঠী। এসব দলে তাঁর অভিনয়সমৃদ্ধ পালা ছিল-জানোয়ার , নীচু তলার মানুষ, মমতাময়ী মা, সতী না অসতী, পাঁচ পয়সার পৃথিবী। অমলেন্দু বিশ্বাস প্রথম থেকেই যাত্রার প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে ছিলেন। যাত্রাভিনয়ে একটা শৈল্পিক পরিবর্তন চাইতেন সবসময়। যাত্রার অভিনয় বাস্তবতা বিবর্জিত, বাহুল্য ভাঁড়ামি, অতিরঞ্জন যাত্রার মজ্জাগত ত্রুটি, সাহিত্যের আসরে যাত্রার স্থান নেই, প্রচলিত এই বিশ্বাস ও ভিত্তি বিশ্বাসের মর্মমূলে আঘাত হেনেছিল। এরই জবাব দিয়েছেন তিনি মাইকেল মধুসূদন যাত্রায় অভিনয়ের মাধ্যমে। সংস্কৃতিকর্মীরা তো বিস্মিত, হতবাক। যাত্রাভিনয়ের পরিশীলিত রূপ দেখে মুগ্ধ হলেন বিশিষ্ট নাট্যজনরা। মৃত্যুর এক বছর আগে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’ যাত্রা মঞ্চে অভিনয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। মহৎ শিল্পীর অনেক ইচ্ছাই অপূর্ণ থেকে যায়। অমলেন্দু বিশ্বাসও অতৃপ্তিজনিত দোলা নিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে যান ১৯ বছর আগে, ১৩ অক্টোবর, ১৯৮৭। একুশে পদকসহ (মরণোত্তর) বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। পেয়েছেন মুনীর চৌধুরী সম্মাননা পদক ও বাচসাস পুরস্কার। পর পর দুবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার স্বীকৃতি পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় যাত্রা উৎসবে। এই বরেণ্য যাত্রাশিল্পীকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ প্রবর্তন করেছে ‘অমলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতি পদক’। এ পর্যন্ত ৩১ গুণীজনকে এই পদক দেয়া হয়েছে। অমলেন্দু বিশ্বাস আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু এখনও মনে পড়ে মাইকেল-এর অভিনয়ে তাঁর শেষ সংলাপ- ‘দাঁড়াও পথিক বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে।’
×