ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

গ্যাস চুরি

বাখরাবাদের ২ কর্মকর্তাসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৬ অক্টোবর ২০১৭

বাখরাবাদের ২ কর্মকর্তাসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব সংবাদদাতা, কুমিল্লøা, ২৫ অক্টোবর ॥ কুমিল্লøায় বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের দুই কর্মকর্তাসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অবৈধ পাইপলাইন স্থাপন করে গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ দিয়ে এবং বিল প্রদানের ভুয়া বই সরবরাহ করে একাধিক ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বিল আদায়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদার মঙ্গলবার রাতে জেলার তিতাস থানার ওসিকে এ মামলা এফআইআর করার নির্দেশ দেন। এদিকে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জেলার গৌরীপুর অফিসের অধীন ৫টি উপজেলা এলাকায় সহস্রাধিক পরিবারে গ্যাস সংযোগ দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে গত দুই বছরে একাধিক ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। বুধবার জেলার তিতাস উপজেলার প্র্রতারিত ও ভুক্তভোগী গ্রাহকরা তাদের বিল পরিশোধের রশিদ বই ও সংযোগ নেয়ার প্রমাণাদি জেলা প্রশাসককে প্রদর্শন করে প্রতিকার চেয়েছেন। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভিন্ন মহলে বেশ তোলপাড় চলছে। জানা গেছে, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জেলার গৌরীপুর অফিসের অধীন দাউদকান্দি, হোমনা, তিতাস, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর ও চাঁদপুরের কচুয়াসহ ৫টি উপজেলার গ্যাস সংযোগসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসব উপজেলা এলাকায় অনেক অবৈধ সংযোগ রয়েছে। গত মঙ্গলবার তিতাস উপজেলার শিবপুরসহ ৫টি গ্রামে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের অভিযানে যান কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদার। দিনভর ওই অভিযানে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির গৌরীপুর কার্যালয়ের কর্মকর্তা, র‌্যাব, পুলিশ ও আনসার টিম উপস্থিত ছিল। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদারের নেতৃত্বে অভিযানিক দল তিতাসের শিবপুর এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের অভিযান চালিয়ে প্রায় ২ কিলোমিটার পাইপলাইন উত্তোলন করে এবং ৫টি গ্রামের অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এতে এলাকার লোকজন ও গ্রাহকরা ফুঁসে ওঠে। এ সময় শত শত ভুক্তভোগী প্রতি মাসে গৌরীপুরের জনতা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় তাদের গ্যাস বিল পরিশোধের বৈধ রশিদ বই, গ্যাস বিল বকেয়া সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র ও চাহিদাপত্র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রদর্শন করে। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের কথা শোনেন এবং তাদের বিল বইসহ কাগজপত্র পর্যালোচনা করে কয়েকটি বই ও চাহিদাপত্র জব্দ করেন। অভিযানকালে গ্যাসলাইন সরবরাহের নামে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্থানীয় মজিদপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ ফারুক মিয়া সরকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লিখিত আবেদন করেন। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার আদেশনামায় ৬ জনের নাম উল্লেখ করে ও অভিযোগের কপিসহ এ বিষয়ে মামলা দায়েরের জন্য মঙ্গলবার রাতে তিতাস থানায় প্রেরণ করেন এবং বিষয়টি এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করার জন্য ওসিকে নির্দেশ দেন। এ মামলায় বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির গৌরীপুর কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক (রাজস্ব) মোঃ হাবিবুর রহমান খান, রাজস্ব সহকারী মোঃ আনিছুর রহমান এবং তিতাসের জিয়ারকান্দি গ্রামের মোঃ আলমগীর, মোনাইরকান্দি গ্রামের মাহবুব, গোপালপুর গ্রামের জুয়েল ও আসমানিয়া দড়িকান্দি গ্রামের আমিনসহ ৬ জনকে মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। অভিযুক্তরা ওই এলাকার সহস্রাধিক পরিবার হতে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে গ্যাস সংযোগ প্রদান করে এবং তাদেরকে বিল পরিশোধের জন্য ভুয়া রশিদ বই সরবরাহ করে। এদিকে বাখরাবাদ গ্যাসের গৌরীপুর কার্যালয়ের ইনচার্জ ছগির আহমেদ এসব গ্যাস সংযোগ অবৈধ ও বিল বইকে ভুয়া বললেও বিল বই প্রত্যয়নে ওই কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক (রাজস্ব) মোঃ হাবিবুর রহমান খান, রাজস্ব সহকারী মোঃ আনিছুর রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে এবং গত দুই বছর ধরে গ্রাহকরা জনতা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের গৌরীপুর শাখায় প্রতি মাসে বিল পরিশোধ করে আসছেন। কিন্তু দুই বছর পর হঠাৎ করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল বুধবার ভুক্তভোগীরা কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এসে জেলা প্রশাসকের কাছে তাদের এ অভিযোগ তুলে ধরেন। এ সময় তারা সাংবাদিকদের কাছে ক্ষোভ ও হতাশার কথা ব্যক্ত করে গ্যাস সংযোগ ও বিক্রির নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া দুর্নীতিবাজ চক্রের শাস্তির দাবি জানান। অবৈধ সংযোগের গ্যাস বিলের টাকা যায় কোথায়! ॥ সম্প্রতি জেলার তিতাস, দাউদকান্দি, লাকসাম, চান্দিনা, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, চৌদ্দগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় একশ’ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাসের পাইপলাইন উত্তোলনসহ কয়েক হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। সূত্র মতে, বাখরাবাদ গ্যাসের একশ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণদের যোগসাজশে ঠিকাদার নামধারীরা প্রতিজনের নিকট থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে সংযোগ প্রদানসহ বিল বই সরবরাহ করে। ওই বিল বইয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা তাদের ব্যবহৃত গ্যাসের বিলের টাকা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকের মাধ্যমে জমা করে আসছে। কিন্তু অবৈধ গ্যাস সংযোগের ওই বিলের টাকা যায় কোথায়- এ নিয়ে বুধবার দিনভর অনুসন্ধান চালিয়েও সংশ্লিষ্ট কোন পক্ষ থেকে সদুত্তর পাওয়া যায়নি। দাউদকান্দির গৌরীপুরের এনসিসি, জনতা, যমুনাসহ বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় তিতাসের শিবপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের সহস্রাধিক পরিবারের ব্যবহৃত গ্যাসের বিলের জমাকৃত টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় যায়, কারা গ্রহণ করে তা খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য। এ বিষয়ে বাখরাবাদ গ্যাসের গৌরীপুর কার্যালয়ের ইনচার্জ ছগির আহমেদ জানান, এ কার্যালয়ের অধীনে ৫টি উপজেলায় বৈধভাবে ১১২টি বাণিজ্যিক ও ২৪ হাজার আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। তিতাস উপজেলার যেসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে তা অবৈধ সংযোগ ছিল। অবৈধ গ্রাহকরা বিল বইয়ের রশিদের মাধ্যমে ব্যাংকে কিভাবে টাকা জমা করেছে তা রাজস্ব কর্মকর্তা বলতে পারবেন। কোম্পানির ওই কার্যালয়ের রাজস্ব কর্মকর্তা ও মামলায় অভিযুক্ত মোঃ হাবিবুর রহমান খান জানান, সকল গ্রাহকের গ্যাস সংযোগ ও হিসাবের কাগজপত্র প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় রাজস্ব কর্মকর্তা ভাল বলতে পারবেন। আমি কাগজপত্র না দেখে কিছু বলতে পারব না। এ বিষয়ে যমুনা ব্যাংক গৌরীপুর শাখার ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ জানান, এ শাখায় ২টি হিসাবে বাখরাবাদ গ্যাসের গ্রাহকদের টাকা জমা হয়। ওই টাকার বিষয়ে বাখরাবাদ গ্যাসের কর্মকর্তারাই ভাল বলতে পারবেন। বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতানা মমতাজ জানান, গ্রাহকের নাম-ঠিকানাসহ টাকার হিসাব সংশ্লিষ্ট শাখা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানেন। সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যাংকের শাখার মাধ্যমে বৈধ গ্রাহকদের পরিশোধকৃত টাকা কোম্পানির কেন্দ্রীয় রাজস্ব হিসাবে জমা হয়, এক্ষেত্রে রাজস্ব ফরম-২ অনুযায়ী গ্রাহকদের নাম-ঠিকানা কিংবা সংকেত নম্বর আমাদের নিকট সংরক্ষণে থাকে না। অনুসন্ধানে সহস্রাধিক অবৈধ গ্রাহকদের দুই বছর ধরে জমাকৃত টাকার হদিস কোনো পক্ষ থেকে সঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিতাস উপজেলার যাদের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে তাদের কথা শুনে তাদেরকে বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির এমডির কাছে পাঠানো হয়েছে। বৈধ-অবৈধ গ্রাহক কারা তা বাখরাবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেবে।
×