ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

কি ঘটেছিল লাস ভেগাসে

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ১৭ অক্টোবর ২০১৭

কি ঘটেছিল লাস ভেগাসে

লাস ভেগাসের মান্দালে বে হোটেলের নিচে বুলেভার্ডে তিন দিনব্যাপী রুট নাইন্টিওয়ান কান্ট্রি-মিউজিক উৎসব তখন গুটিয়ে আসছিল। দিনটি ১ অক্টোবর। রবিবার। রাত দশটার দিকে কনসার্ট উপভোগকারী প্রায় ২২ হাজার নর-নারী-শিশুর ওপর যা নেমে আসে, এক কথায় সেটাকে নরকের বিভীষিকা বললেও কমই বলা হবে। হোটেলের ৩৩তম তলার একটি রুমের কাঁচের জানালা ভেঙ্গে স্টিফেন প্যাডক নামে ৬৪ বছরের এক প্রৌঢ় পৈশাচিক নারকীয়তায় মেতে ওঠে। এসল্ট স্টাইলের সেমি অটোমেটিক অস্ত্র ব্যবহারে ট্রেনিং পাওয়া এই মানুষটি জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানস্থলের অসহায় নর-নারী শিশুর ওপর একের পর এক গুলি চালাতে থাকে। রাত ১০টা ৮ মিনিটে গুলি শুরু হয় এবং ১০-১১ মিনিট অবিশ্রান্তভাবে চলে। যখন শেষ হয় ততক্ষণে ৫৮টি লাশ পড়ে গেছে এবং আহত হয়েছে ৫২৭ জন। আমেরিকার ইতিহাসে গুলি করে ব্যাপক হত্যাকা- চালানোর এত বড় ঘটনা আর ঘটেনি। নিরাপত্তা বাহিনী সোয়াত টিমের সদস্যরা দরজা ভেঙ্গে ঘাতকের রুমে ঢুকতে পারার আগেই সে রাইফেল নিজের দিকে তাক করে আত্মহত্যা করে। তাঁর রুমে ২৩টি আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল, যার মধ্যে ১২টি ছিল আধা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, যা দিয়ে সেকেন্ডে প্রায় ৯ রাউন্ড গুলি ছোড়া গেছে। এদিকে নিচের বুলেভার্ডে তখন চিৎকার আর আর্তনাদে আকাশ ভারি। হতাহতরা কোথাও স্তূপ হয়ে, কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। গোটা জায়গায় রক্তের স্রোত বইছে। গুলি থামার পরই জনতা তাদের ওপর নেমে আসা আতঙ্ক ও বিভীষিকার ব্যাপকতা উপলব্ধি করতে শুরু করে। ঘাতক স্টিফেন প্যাডক কি সন্ত্রাসবাদী ছিল? তার কি কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল? সে কি মানসিক রোগী ছিল? কেন সে এই নারকীয় হত্যায় মেতে উঠেছিল? এই প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশি অনুসন্ধানে জানা যায় লোকটির বাজি ধরার অভ্যাস ছিল। লাস ভেগাস স্ট্রিপ থেকে ৮৫ মাইল দূরে অবসর জীবনে যাওয়া নর-নারীদের স্থান হিসেবে পরিচিত মেসকোয়াইটে তার যে বাড়ি, সেখানে ১৯টি এবং রের্নোয় তাঁর বাসভবনে ৭টি আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যায়। এই অচিন্তনীয়, অব্যক্ত ট্র্যাজেডির প্রকৃত কারণটি হয়ত কোনদিনও জানা যাবে না। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এক ব্যক্তি কানেকটিকাটের স্যান্ডি লুক এলিমেন্টারি স্কুলে হামলা চালিয়ে ২০ শিশু ও ৬ জন প্রাপ্তবয়স্ককে গুলি করে হত্যা করেছিল। তারপর থেকে গোটা আমেরিকায় গুলিবর্ষণের দেড় হাজারেরও বেশি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে অকুস্থলে একই সময় চার বা ততোধিক ব্যক্তি নিহত বা আহত হয়েছে। এটা হল ম্যাস শূটিংয়ের একটি সংজ্ঞা। আরেকটি সংজ্ঞায় ২০০০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৪টি দেশে ১৬৬টি ম্যাস শূটিংয়ের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ১৩৩টি ছিল আমেরিকায়। তবে আমেরিকায় আগ্নেয়াস্ত্র ঘটিত সহিংসতায় প্রতিদিন শত লোক মারা যাচ্ছে ম্যাস শূটিংয়ে। নিহতের সংখ্যা সে তুলনায় অনেক কম। প্রতিদিন আগ্নেয়াস্ত্রে সেখানে গড়ে ৯৩ জনের মৃত্যু হচ্ছে। বেশির ভাগই আত্মহত্যা বা হত্যা। কিন্তু এগুলো আমেরিকানদের দৈনন্দিন জীবনকে মোটেই নাড়া দেয় না বা ত্রাস সৃষ্টি করে না। এই ঘটনাগুলো যেন সন্তানকে স্কুলে পাঠানো, গীর্জায় যাওয়া, ক্লাবে গিয়ে নাচ করার মতো মামুলী ব্যাপার। ম্যাস শূটিং সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। এর প্রভাবের ব্যপ্তি অতি বিশাল, বিভীষিকাও ভয়াবহ। লাস ভেগাসের হত্যাকা-টি ঠা-া মাথায় হত্যাকা-। স্টিফেন প্যাডক ম্যাস শূটিং ঘটানোর লক্ষ্য নিয়েই হোটেলটির এমন এক লাক্সারি সুইট ভাড়া করেছিল, যেখান থেকে অনুষ্ঠান স্থলটি স্পষ্ট দেখা যায়। পুলিশের আগমন আগে থেকে টের পাওয়ার জন্য সে সুইটের ভেতরে ও হলের বাইরে ক্যামেরা বসিয়েছিল। অস্ত্রের চালানও এনেছিল এমনভাবে যে কেউ টের পায়নি। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল আগ্নেয়াস্ত্র সংক্রান্ত আমেরিকার শিথিল আইনের জন্য। তাই নতুন করে দাবি উঠেছে, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আমেরিকায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের ওপর কড়াকড়ি করা থেকে। যতবারই ম্যাস কিলিং হয়েছে, ততবারই এমন দাবি ওঠে। পরে তা আবার স্তিমিত হয়ে যায়। ২০১৬ সালে ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোস-এ ওমর মাতিন নামে এক ব্যক্তি সমকামীদের নাইটক্লাবে গুলি চালিয়ে ৪৯ ব্যক্তিকে হত্যা করে, আহত হয় প্রায় ৮০ জন। ২০১২ সালে কানেকটিকাটের স্যান্ডি লুকের একটি প্রাথমিক স্কুলের ভেতরে ঢুকে এডাম লানজা তাঁর মা, ২০টি শিশু ও ৬ জন প্রাপ্তবয়স্ককে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৯১ সালের ভার্জিনিয়া টেকে ছাত্র চো সিউং হুই ডর্মিটরিতে ও ক্লাসরুমে গুলি চালিয়ে সহপাঠীদের হত্যা করে। নিহত ৩২ জন। ১৯৯১ সালে টেক্সাসের কিলনে জর্জ হেনার্ড একটি কাফেটারিয়ায় ঢুকে খদ্দেরদের ওপর গুলি চালায়, নিহত হয় ২৩ জন। ১৯৮৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ওয়াইসিড্রোতে জেমস অলিভার লুবাটি নামে এক ব্যক্তি ম্যাকডোনালডস শপে গুলি চালিয়ে ২১ ব্যক্তিকে হত্যা করে। এগুলো হচ্ছে ভয়াবহ আকারের ম্যাস কিলিং। এর কম পরিসরের ম্যাস কিলিং ১৯৮২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৬টির মতো ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা সাড়ে ২৬ কোটি। ৩০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী এগুলোর মালিক। ম্যাস শূটিং ও অন্যান্য হত্যাকা-ের পরও বেশিরভাগ আমেরিকান বলে যে, বন্দুকের মালিকানাধিকার তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্য অপরিহার্য। আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হলো এই যে, ১৯৬৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত সে ১৩৪টি ম্যাস শূটিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। তার মাত্র ৩টি ঘটেছে মহিলাদের হাতে। বাকি ৯৮ শতাংশের জন্য দায়ী পুরুষ। হত্যাকারীদের ৯০ শতাংশ হলো পুরুষ। ৭০ শতাংশ নরহত্যার ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। বিশ্বে সিভিলিয়ানদের মালিকানায় যত আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে, তার অর্ধেই আমেরিকানদের হাতে। তবে সেই অস্ত্রগুলোও সমভাবে বণ্টিত নয়। অনেক অস্ত্রই মজুদ করে রেখেছে সুপারওনারস নামে একটি গ্রুপ। এটি মূলত পুরুষ উগ্রবাদী গ্রুপ, যারা প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩ শতাংশ। তাদের একেক জনের হাতেই গড়ে ১৭টি অস্ত্র। মহিলারা আত্মরক্ষার জন্য ক্রমবর্ধমান হারে পিস্তল কিনছে, তবে একটি করেই। তদুপরি অশ্বেতাঙ্গদের তুলনায় শ্বেতাঙ্গদের হাতেই বেশি অস্ত্র। এ বছর এ পর্যন্ত আমেরিকায় ম্যাস শূটিয়ে প্রায় ৩৪৬ জন নিহত হয়েছে। ২০১৬ তে নিহত হয়েছিল ৪৩২ এবং ২০১৫ তে ৩৬৯, ২০১৪ তে ২৬৮, ২০১৩ তে ২৮৮ জন। যত ম্যাস শূটিং হচ্ছে আমেরিকায়, আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রিও তত বাড়ছে। আর এ কথাও অনস্বীকার্য যে, যত বেশি অস্ত্র থাকবে, অস্ত্রের কারণে মৃত্যুর ঘটনাও ততই বাড়বে। সূত্র : ইকোনমিস্ট ও টাইম
×