ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রদীপ মালাকার

বঙ্গবন্ধুর কুশলী নেতৃত্ব এবং বর্তমান সময়

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১১ অক্টোবর ২০১৭

বঙ্গবন্ধুর কুশলী নেতৃত্ব এবং বর্তমান সময়

সুপ্রীমকোর্টে সরকারের আপীল করা মামলা ‘ষোড়শ সংশোধনী’ বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, কারও একক নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। তার এই মন্তব্য নিয়ে রাজনীতির মাঠ বেশ কিছু দিন সরগরম ছিল। একটি মীমাংসিত বিষয়কে বারবার কেন অপ্রাসঙ্গিকভাবে তোলা হয় তা সত্যিই ভাববার বিষয়। জাতির পিতাকে নিয়ে বিতর্ক ছাড়ছেই না। গুটিকতক রাজনীতিক, শিক্ষক অসৎ মতলবে ১৯৭৫-এর পর ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠ বিষয়গুলোকে বিকৃতভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করে বিভ্রান্ত করছে। গত ২৬ মার্চের এক অনুষ্ঠানেও বিরোধী দলের এক নেতা বলেছেন, শেখ মুজিব জনগণকে প্রস্তুত না করে ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা আরম্ভ হলে তিনি পাকবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা ও নেতৃত্ব দেননি। গত বছর এক বাম নেতা ৭ মার্চের আলোচনা সভায় বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের জনসভা থেকে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে এত লাখ লাখ লোক ক্ষয় হতো না কিংবা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পুলিশ, ইপিআর, বাঙালী সৈনিক ভাইয়েরা লাখ লাখ জনগণকে নিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টগুলো দখল করে অতি সহজেই দেশ স্বাধীন করতে পারত। রাজনীতিবিদদের বক্তব্য রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে মোকাবেলা করা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদ থেকে যখন অযাচিত কথা উঠে তা আমাদের চিন্তায় ফেলে দেয়। মাননীয় প্রধান বিচারপতির সদয় অবগতির জন্য বলছি, আপনার অধীনস্থ হাইকোর্ট গত বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫জন শিক্ষক/শিক্ষয়িত্রীকে সশরীর উপস্থিত থেকে জবাব দেয়ার জন্য তাদের তলব করছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, নিজেদের রচিত বইগুলোতে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানকে উপস্থাপন করে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের বিভ্রান্ত করেছেন। এজন্য আদালত তাদের ভর্ৎসনার পাশাপাশি রাষ্ট্রদোহের বিচার হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছিল। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে স্পষ্টতই জানা গিয়েছিল, উল্লিখিত শিক্ষকগণ এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুসারী কিংবা ’৭১-এ তারা স্বাধীনতার সংগ্রাম দেখেনি বা তাদের জন্মই হয়নি। এসব ভেদবুদ্ধি ও স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষকদের জন্য করুণা হয় তাদের ইতিহাস জ্ঞান দেখে। এবার আমি প্রধান বিচারপতির উক্তি ও বাম নেতার বক্তব্য এক সঙ্গে মিলিয়ে আলোচনা করব। প্রথমেই আমি ৭ মার্চের বাম নেতার বক্তব্যের একটু আলোচনা করি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল প্রাথমিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং এই ঘোষণার মধ্যে ছিল একটি সার্বিক নির্দেশনা। ৭ মার্চের সেই বিশাল জনসভা থেকেই বঙ্গবন্ধু অসহযোগে আন্দোলনের ডাক দেন এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ব্যংক, বীমা, অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, কলকারখানা বন্ধ ও পশ্চিম পাকিস্তানে খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেন। কার্যত সেই দিন থেকেই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদেশ-নির্দেশ ব্যতীত অন্য কিছু ছিল অচল। আর সেই একক নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায়, পাকবাহিনী দ্বারা ২৫ মার্চে গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ১০ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈধ্যনাথ তলায় (মুজিবনগর) বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে-অস্থায়ী বা উপরাষ্ট্রপতি করে তাজউদ্দীন আহমদকে- প্রধানমন্ত্রী করে ৬ সদস্যের প্রবাসী সরকার, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। এই মুজিব নগর সরকারের অধীনেই জিয়াসহ সারাদেশে ১১টি সেক্টর কমান্ডারগণও তাদের অধীন মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনী ৯ মাস পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্ব ও ধারাবাহিকতায় একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক, ৭ মার্চের পূর্ব থেকেই এবং ভাষণের কয়েক ঘণ্টা পূর্বেও তখনকার সময়ের ছাত্র আন্দোলনের চার খলিফা যথাÑ আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখ ছাত্র নেতাদের পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর ওপর স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার চাপ ছিল। বঙ্গবন্ধু সবকিছুকে থোরাই কেয়ার করে নিজ সিদ্ধান্তে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের এ দুর্লভ ভাষণটি দেন। ধরা যাক, বাম নেতা কিংবা ঐ সময়ের ছাত্রনেতাদের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন এবং সেই সঙ্গে ইপিআর, পুলিশ, বাঙালী সেনা ও লাখ লাখ জনতাকে নির্দেশ দিলেন ঢাকাসহ সারাদেশের ক্যান্টনমেন্টগুলো দখল করতে। সব ক্যান্টনমেন্টগুলোতে অবাঙালী সৈন্যদের পরাভূত করে দখলও হয়ে গেল। তারপর একদিন, দুদিন বা তিনদিন তারপর কি হবে? আসলে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সামরিক জান্তা বুঝে যায় ভাষণের অর্থ কি? তারপর দিনই সামরিক জান্তা দ্রুতগতিতে আকাশপথে, জলপথে ব্যাপকভাবে সৈন্য সমাবেশ, সামরিক সরঞ্জাম পাঠাতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বড় সাহায্যকারী প্রতিবেশী ভারত ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে আসছে। ৭ মার্চের পর পাকবাহিনী যখন সুসজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অঙ্কুরেই সশস্ত্র স্বাধীনতার আন্দোলন দমন করে ফেলত। ভারত তখন অন্যের অভ্যন্তরীণ বলে সীমান্ত বন্ধ করে দিত। আজ একদল লোক ঐ সময়ের যে মেজরকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করেন, তখন তিনিও সামরিক জান্তার অনুগত সৈনিক হিসেবে সশস্ত্র আন্দোলন দমনে এগিয়ে আসেন। বিশ্ববাসীর কোন সহানুভূতি পেতে কিংবা গণহত্যা, বিদ্রোহ দমনের কোন খবরই বাইরে যেতে পারত না বা যেতে দিত না। বঙ্গবন্ধুসহ সকল নেতাদের আটক বা হত্যা করে আন্দোলন দমিয়ে ফেলত। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রমাণ নেই বাইরের সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া নিরস্ত্র জনগণ আধুনিক সুশিক্ষিত একটি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তা হলে চেচনিয়া, কাশ্মীর, প্যালেস্টাইনসহ অনেক দেশ অনেক আগেই স্বাধীন হয়ে যেত। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সমর্থন নিয়েও কেন ৬০ বছরেরও অধিক সময় প্যালেস্টাইনীরা দেশকে স্বাধীন করতে পারল না? বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই পাকিস্তানী সামরিক, বেসামরিক শাসক গোষ্ঠীর আচরণ ও বৈষম্যের কারণে খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহুবার জেল খেটেছেন। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর আন্দোলন ও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। একবার বঙ্গবন্ধু কারারুদ্ধ হলে কারাগারে কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান মনি সিং এর সঙ্গে দেখা হয়। বঙ্গবন্ধু মনিবাবুর সঙ্গে আলাপচারিতায় পূর্ব পাকিস্তানকে কিভাবে স্বাধীন করা যায় সেই বিষয়ে মতবিনিময় করেন। এ বিষয়ে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি মরহুম ফরহাদ সাহেব তার রচিত বইয়ে উক্ত তথ্যটি উল্লেখ করে যান। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি শুধুই একটি নিছক মামলা ছিল না। এ মামলাটি মিথ্যা হলেও শাসক গোষ্ঠীর কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের সংহতির প্রতি হুমকি স্বরূপ। ইতিপূর্বে ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণভাবে শত্রুর দয়ায় অরক্ষিত থাকে। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর কথা সক্রিয়ভাবে ভাবতে থাকেন। তারপর ১৯৭০-এ উপকূল অঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ জলচ্ছ্বাসের কারণে দশলক্ষ মানুষের করুণ মৃত্যু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রশ্নে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন। বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ’৭০-এ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। সামরিক জান্তা বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা চলে যাচ্ছে দেখে সেইদিন থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বলেছেন, আমি যদি তোমাদেও নির্দেশ দিতে নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। অর্থাৎ তিনি জানতেন শত্রু আক্রমণ করবে। সেই ক্ষেত্রে তিনি আটক বা নিহতও হতে পারেন। পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এখানেও রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি প্রতিরোধের ইঙ্গিত দিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু আরও মনে করতেন বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা সামরিক জান্তা কখনও মেনে নেবে না। পশ্চিমারা মনে করত ৬ দফা দাবি মানার অর্থই হবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের নামে বিনা বাধায় পাকিস্তানের সংহতি বিপন্ন হওয়া। তার ওপর ৭ মার্চের জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধুর ৪ দফা শর্ত ঘোষণা ছিল গোদের উপর বিষফোঁড়া। কাজেই বঙ্গবন্ধু প্রচ-ভাবে বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানীরা এ সকল দাবি মেনে নেবে না। বঙ্গবন্ধু এ সকল দাবির ব্যাপারে ছিলেন অনমনীয়। কাজেই পাকিস্তানীরা যে শক্তি প্রয়োগ করবে সে ব্যাপারে তিনি আগেভাগেই সতর্ক ছিলেন। সেই জন্য ৭ মার্চের পরে ও আগে ঢাকা ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন হলে বিশেষ করে ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল, মোহসীন হলে বাঁশের কিংবা ডামি রাইফেলের মাধ্যমে ট্রেনিং চলত। প্রমাণ হিসেবে দেখা যায়, মার্চ মাস এলেই টিভি চ্যানেলগুলোতে ঐ সময়ের মহড়া দেখানো হয়। ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু আলোচনার অগ্রগতি না দেখে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বলেছেন, শত্রু শক্তি প্রয়োগ করবে নিশ্চিত। আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যেন অন্য সহকর্মীদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে গিয়ে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। সবশেষে যখন চূড়ান্তভাবে আলোচনা ভেঙ্গে যায় এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পৌঁছে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ ক্যান্টনমেন্টে সেনা-কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং করছেন তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মী সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমদ, কামরুজ্জামান, মনসুর আলীসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে মিটিং করে তাদের নির্দেশ দেন তারা যেন নিরাপদ স্থানে চলে গিয়ে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। এ প্রসঙ্গে বিরোধী বিএনপি নেতাদের আরেকটি প্রশ্নের আলোচনা না করলে বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমা ও কুশলী নেতৃত্ব সম্বন্ধে ধারণা করা যাবে না। বিরোধী প্রতিপক্ষ নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন, পাকবাহিনীর হামলা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু কেন জাতিকে অরক্ষিত রেখে এবং সকল নেতাকে ছেড়ে পাকবাহিনীর কাছে ধরা দেন। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের লেখা ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার ছিল ধারাবাহিকতার ফসল’ শিরোনামে লেখা থেকে জানা যায়, শাহরিয়ার কবিরের নেয়া এক সাক্ষাতকারে সংসদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতার জানিয়েছেন ১৯৬৯ সালে লন্ডনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ে ১৯৬৪ সালে বিএলএফ বা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের অনুকাঠামো গঠিত হয়। তিনি আরও বলেন, ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ভারতের সাহায্যের বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য যে আলোচনা করেছিলেন সেখানে বিএলএফ নেতাদের সম্ভাব্য গেরিলা প্রশিক্ষণের বিষয়টি বিশেষভাবে স্থান পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি পুরো বিষয়টি তাজউদ্দীনকে জানিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, চিত্তরঞ্জন বাবু শাহরিয়ারকে আরও জানিয়েছিলেন ২৫ মার্চের আগে বঙ্গবন্ধু তাকে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন দুটি বাড়ি ভাড়া করার জন্য। যাতে সময় এলে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ জড়ো হয়ে সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। সম্প্রতি ভারতে ১৯৭১ সালের বিএসএফ প্রধান রুস্তমজীর আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে যেসব তথ্য বিধৃত হয়েছে তার সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের সাক্ষাতকারের মিল ও ধারাবাহিকতা আছে। ২৫ মার্চের আগে ইন্দিরা গান্ধী রুস্তমজীকে প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান গোলক মজুমদার রুস্তমজীর নির্দেশে ২৬ মার্চের পরে তাজউদ্দীন আহমদকে খুঁজে বের করেন এবং দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। কাজেই বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাহায্য, সহযোগিতা ও গেরিলা যুদ্ধের ব্যবস্থাও করে যান। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ সহকর্মীদের প্রচ- চাপের মুখে দেশবাসীকে ছেড়ে যেতে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, আমি জাতির এই দুর্যোগময় সময়ে চলে গেলে জাতি ভুল বুঝবে এবং হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে না পেয়ে অনন্যোপায় হয়ে আরও বেশি হত্যা চালাবে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু যদি দেশের মুক্তাঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে নেতৃত্ব দিতেন; তাহলে নিজ দলে যেখানে বিশ্বাসঘাতক, কনফেডারেশনের সমর্থক ও সুবিধাবাদী খন্দকার মোশতাকের মতো নেতারা রয়েছেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা বা স্বাধীনতা সংগ্রাম বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল বেশি। আর ভারতে আশ্রয় না নিয়ে তিনি বিচক্ষণতার কাজটিই করেছেন। প্রথম প্রথম ভারত সরকারের কাছে বঙ্গবন্ধুর গুরুত্ব থাকলেও পরবর্তীতে আর সেটা থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। ভারতের মাটিতে অবস্থান করে নিজ মত প্রকাশের স্বাধীনতাও থাকবে না। আত্মসমর্পণ দুই প্রকার। কোন যুদ্ধে হেরে গিয়ে শত্রু পক্ষের কাছে অস্ত্রসমর্পণের নামও আত্মসমর্পণ ইংরেজীতে যাকে বলে সারেন্ডার। যেমন ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরে যৌথবাহিনীর কাছে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ করেছিল। আর এক প্রকার আত্মসমর্পণ আছে- রাজনৈতিক নেতারা যা হরহামেশা করে থাকেন। আন্ডার গ্রাউন্ডে পালিয়ে না গিয়ে শত্রুর হাতে স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব গ্রহণ করেন। বলা বাহুল্য, এই প্রকারের আত্মসমর্পণ বা স্বেচ্ছা-বন্দিত্ব তাদের এক ধরনের রণকৌশল মাত্র। তারা তাদের নীতিও বিসর্জন দেন না, দাবিও পরিত্যাগ করেন না। বিশ্বের স্বাধীনতাকামী জাতিসমূহের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ স্বেচ্ছা-বন্দিত্বের কৌশলকে তাদের সংগ্রামের একটি হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। গান্ধী, নেহরু, সুকর্ণ, নেলসন ম্যান্ডেলাসহ বিশ্ববরেণ্য নেতৃবৃন্দ তাদের রাজনৈতিক জীবনে সব সময়ই এই ধরনের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। মহাত্মাগান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ইংরেজের কাছে স্বেচ্ছাবরণের কথা ইতিহাসের ছাত্রমাত্রই অবগত আছেন। বঙ্গবন্ধু ও এই ক্ষেত্রে তাই করেছেন। ২৫ মার্র্চ রাতে মিটিং শেষে সহকর্মীদের বিদায়ের ঘণ্টা দুয়েক পর আসেন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ ও ফজলুল হক মণি। বঙ্গবন্ধু তোফায়েলের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তাদের বলেন দেশের বাইরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য। তোফায়েল ও মণি বঙ্গবন্ধুর পা ছুঁয়ে সালাম করে চলে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পিলখানার ইপিআর-এর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেন। এবং সেই সঙ্গে নিজ পরিণাম জানা সত্ত্বেও নিজ বাসভবনে অবস্থান করেন। এখানেই রাজনীতির সুদক্ষ দাবা খেলোয়াড়ের মতো বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ নেতৃত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। ছাত্রজীবনে ইংরেজী প্রবন্ধে পড়েছিলাম থ্রি কোশ্চেনস্ অর্থাৎ তিনটি প্রশ্ন। এই তিনটি প্রশ্ন বঙ্গবন্ধুর জীবনে সফল প্রয়োগ দেখা যায়। তিনটি প্রশ্ন হলো, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত, সঠিক সময়ে সঠিক শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করা বা সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা। অর্থাৎ ৭ মার্চের ভাষণে নির্দিষ্ট সময়ে জনগণকে জানানো, সঠিক সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সঠিক সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম সংগঠিত করা। এই আলোচনার পর আলাদাভাবে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক নিয়ে লেখার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমার উপরিল্লিখিত ক্ষুদ্র লেখাটির বিবরণীতে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে জাতিকে প্রস্তুত করা, নেতৃত্ব ও মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ আছে। তারপরেও দুই একটা কথা না বললে হয় না। দেশের সর্বোচ্চ আদালতেই প্রমাণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু আটক হওয়ার পূর্বে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। এরপরও এ বিষয়ে বিতর্ক করা মূলত সংবিধান ও আদালত অবমাননার শামিল বলে আমি মনে করি। যারা জেনে শুনে নিজেরা ইতিহাস বানাতে চায় বা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ইতিহাসের নিজস্ব গতিধারায় একদিন এসকল জ্ঞানপাপী ব্যক্তি, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা এমনভাবে ছিটকে পড়বেন যে একদিন তাদের ছাত্র, ভক্তরা তাদের ধিক্কার দিবে। যাদের মিথ্যা ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে. মগজ ধোলাই করা হচ্ছে, একদিন তারাই সত্য জানার পর এদের ঘৃণা করবে। বেশি দূরের ইতিহাস নয়, পলাশী যুদ্ধের অন্যতম খলনায়ক রবার্ট ক্লাইভ দেশে ফিরে গেলে নবাব সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে অন্ধকোপের মিথ্যা প্রচারণার কারণে দেশের মানুষ তাকে শাস্তি দেয় ও ঘৃণা করে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। আজ যারা বিশেষ মহল বা গোষ্ঠীকে খুশী বা মনোরঞ্জনের জন্য জাতির গর্ভভরা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে চায় ইতিহাস তাদের শাস্তি দেবে এটাই ইতিহাসের অমোঘ বিধান। লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী
×