ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাভরা ধান গোয়ালভরা গরু ফেলে এসে বহু রোহিঙ্গা এখন ফকির

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৯ অক্টোবর ২০১৭

গোলাভরা ধান গোয়ালভরা গরু ফেলে এসে বহু রোহিঙ্গা এখন ফকির

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ সাজানো সংসার ফেলে কখনও এখানে আসতে আগ্রহ ছিল না। নিজ দেশে ভালই ছিলাম। মিয়ানমারে গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, দোকানভর্তি মাল ও ঘেরে চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছিল। স্বামী বাংলাদেশের টেকনাফে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে চিংড়ি ব্যবসা করত। হঠাৎ ২৬ আগস্ট সকালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পাড়ায় পাড়ায় এসে যাকে যেখানে পারছে, গুলি করে হত্যা করছে। অনেক রোহিঙ্গাকে জবাইও করতে দেখা গেছে। মৃতদেহগুলো নিয়ে যাচ্ছে তাদের গাড়িতে করে। চোখের সামনে এসব নৃশংসতা দেখে ভয়ে এক প্রকারে পাথর বনে যাই। তৎক্ষণাৎ দরজা বন্ধ করে স্বামীকে কাঁথা মুড়িয়ে লুকিয়ে রাখি লাকড়ি রাখার ঘরে। ভেবেছিলাম হয়ত বাইরে থেকে চলে যাবে সেনা সদস্যরা। হায়রে কপাল! দরজা ভেঙ্গে তারা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। মেয়েদের টানাহেঁচড়া ও শ্লীলতা হানি করে। স্বামীসহ দুই ভাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ির উঠানে। তারপর গুলিতে বুক ঝাঁঝরা করে দেয় চোখের সামনে। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কথাগুলো বলছিলেন উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রিত মিয়ানমারে উত্তর মংডু কুয়াংচিবং এলাকার শফি উল্লাহর স্ত্রী নুর আনকিছ। ওপারের ধনী, অথচ এপারে এসে অনেকে ত্রাণ সংগ্রহ করে অন্ন তুলে দিচ্ছে স্ত্রী সন্তানদের মুখে। চিংড়ি, লবণমাঠ, চাষাবাদ ও ইয়াবা ব্যবসা করে রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ অঢেল টাকা ও সম্পদের মালিক হলেও জান্তা সরকারের অত্যাচারে পালিয়ে এসে ত্রাণসামগ্রীর মুখাপেক্ষী হচ্ছেন তারা। রাখাইনের উত্তর মংডু রাইমনখালী এলাকার চেয়ারম্যান ফজল করিম চৌধুরীর পুত্র তুমব্রু সীমান্তে আশ্রয় নেয়া আনোয়ার চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, হায়রে আফসোস! যে হাতে হাজার হাজার টাকা দান করেছি, সে হাতে এখন পরের দেয়া দান গ্রহণ করতে হচ্ছে। মিয়ানমারের বহু বর্ডারগার্ড পুলিশকে হাজার হাজার এমনকি লাখ টাকাও অনুদান দিয়েছি। সহিংসতার আগে আমাদের হয়রানি না করতে নিয়মিতভাবে মাসিক ২-৩ লাখ কিয়াত দিতাম। চিংড়ি প্রজেক্টের জমিসহ বিভিন্ন ব্যবসা ছিল সেখানে। ১৭ সেপ্টেম্বর সেনা বাহিনী সব শেষ করে দিয়েছে। এখানে ত্রাণ নিতে তাদের খুবই লজ্জাবোধ হচ্ছে বলে জানান। তারা তুমব্রু সীমান্তে আত্মীয়দের সহযোগিতায় আশ্রয়ে রয়েছেন। প্রতিদিন একটিবার হলেও আশ্রয়স্থলের বাইরে কলাগাছ তলায় গিয়ে কখন ফিরে যাবে এ আশায় নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারের দিকে তাকিয়ে থাকে। শফি উল্লাহর স্ত্রী নুর আনকিছ বলেন, গত ২৫ আগস্ট রাতে অজস্র গুলির শব্দ পেয়ে আমরা সকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। তখন আমার স্বামী ছিল চিংড়ি ঘেরে। ভেবেছিলাম হয়ত কোন দুর্ঘটনা। পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে শুনি বাগিদের (বিদ্রোহী গ্রুপ) সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এ খবর শুনে আরও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সকালে ঘের থেকে স্বামী এসে জানায়, মিলিটারি আসছে। প্রজেক্ট থেকে এসে কিছুই মুখে দিতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর সেনা বাহিনী এসে আমাদের পাড়ায় তা-ব চালাতে শুরু করে। আমরা তাড়াতাড়ি চেহারায় পাতিলের কালি লাগাই। যেহেতু চেহারা মলিন দেখা গেলে সেনা সদস্যদের গণধর্ষণ থেকে নিজেদের রক্ষা করা যায়। তারপরও ঘরে ঢুকে মহিলাদের ভীষণ অত্যাচার চালিয়েছে তারা। ধরে নিয়ে গেছে পুরুষদের। তাদের হত্যা করতে দেখেছি। সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পর স্বামী-দেবর হারা হলেও হয়ত তার রেখে যাওয়া সম্পদ নিয়ে ঘরে বেঁচে থাকতে পারব এ আশায় থেকে যাই। কিন্তু বিধিবাম। সপ্তাহ খানেক পর সেনা বাহিনী ফের পাড়ায় এসে ঘরে আগুন দেয়া শুরু করল। উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গা পল্লীগুলোতে তা-ব অব্যাহত রাখে। রোহিঙ্গা পুরুষদের নৃশংসভাবে হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনসহ এমন কোন অপরাধ নেই যা করছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপর ছোট ছোট তিন সন্তানকে নিয়ে আশ্রয়ের পথ খুঁজি। বাস্তুচ্যুত হয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বিছানার চাঁদর ছাউনি দিয়ে অন্যদের সঙ্গে ১০ দিন অবস্থান করি। সেনাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রাণ বাজি রেখে লুকিয়েছিলাম সত্যি, সঙ্গে করে কিছুই নিতে পারিনি। খাওয়ার মতো কিছুই ছিল না। বিশুদ্ধ পানি থেকে শুরু করে কোন ধরনের খাদ্যসামগ্রী নেই। খালি পড়ে থাকা বসতবাড়িতে সেনাবাহিনী আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, সম্পদ ধ্বংস করছে এবং রাখাইনের অবস্থা দিনদিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে দেখে বাংলাদেশে পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে পালিয়ে আসি। নূর আনকিছ আরও জানান, আমার মতো আরও হাজার হাজার নারীর স্বামীকে হত্যা করে বিধবা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। বুলেটে বুক খালি করেছে বহু গর্ভধারনী মাকে। স্বজনদের প্রাণভিক্ষা চেয়ে সেনাবাহিনীর পায়ে পড়ে কেঁদেছে অনেক বৃদ্ধ মহিলা ও স্ত্রী সন্তানরা। কিন্তু পাষাণ হৃদয় সেনা সদস্যরা গুলি চালিয়ে পাখির মতো হত্যা করেছে রোহিঙ্গা পুরুষদের। এমন বর্বরতা কোথাও দেখেননি দাবি করে নূর আনকিছের প্রতিবেশী সেতারা বেগম বলেন, আমার ভাইকে ধরার সঙ্গে সঙ্গে লম্বা কিরিচের আঘাত করে। এতে আবুল হাসিম মাটিতে লুটে পড়ে। পানি পানি বলে চিৎকার করে। সেনা সদস্যরা তার মুখে আরও একটি কিরিচের আঘাত করলে তখন সাড়াশব্দ বন্ধ হয়ে পড়ে। চলে যান ইহকাল ত্যাগ করে। বৃদ্ধ বাবা আবুল হোছেনকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করে ফেলে দেয় বিছানা থেকে। স্ত্রী হুমায়রা শিশু সন্তান হোবাইবকে কোলে নিয়ে ক্রন্দন শুরু করলে এক গুলিতে মাছেলে দু’জনকে চোখের সামনে হত্যা করে সেনাবাহিনী। তারপর সেনাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে জীবন বাজি রেখে আমরা ১০ দিন পাহাড়ের ঢালুতে অবস্থান করে রওনা হই বাংলাদেশের দিকে। হেঁটে চারদিন পর সীমান্তে এসে পৌঁছাই। পথিমধ্যে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ক্ষুধার জ্বালায় কাতর হয়ে হাঁটতেও পারছিল না। তাদের কাছের দোকান থেকে নাস্তা কিনে দেয়ার মিথ্যা আশ্বাস এবং পথের কাদা জল পান করিয়ে নিয়ে আসি। টেকনাফের উনচিপ্রাং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ ও পুটিবনিয়া ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা যুবতী আকলিমা বলেন, মিয়ানমারে তার বাবার অনেক ধন সম্পদ ছিল, সেদিকে না দেখে কোন রকম জীবন রক্ষার্থে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হই। তবে হাতেকড়ি যা নিয়ে যাত্রা করেছিলাম, জীবন বাঁচাতে এসে সেই শেষ সম্বলটুকুও মাঝিদের হাতে তুলে দিতে হয়েছে। নাফ নদী পারাপারে স্বর্ণালঙ্কার, বিপুল অঙ্কের কিয়াত এবং কিছু বাংলা টাকাও হাতিয়ে নিয়েছে নৌকার মাঝিরা। মিয়ানমারে আমরা অবস্থাসম্পন্ন হলেও এখন এখানে পুরোপুরি নিঃস্ব। আকলিমা জানান, শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্টে বার্মা থেকে তাড়াতাড়ি পার হওয়া যায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে।
×