ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হলে ৫ বছরের মধ্যে এ খাত থেকে ৭শ’ কোটি ডলার আয় সম্ভব

রফতানিতে নতুন সম্ভাবনা ডেনিম পোশাক ॥ চীনকে টপকে এক নম্বর হওয়ার পথে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪:২২, ৭ অক্টোবর ২০১৭

রফতানিতে নতুন সম্ভাবনা ডেনিম পোশাক ॥ চীনকে টপকে এক নম্বর হওয়ার পথে বাংলাদেশ

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশের রফতানি খাতে নতুন সম্ভাবনার নাম ডেনিম বা জিন্স পোশাক। ইতোমধ্যে ডেনিম পোশাক রফতানিতে বিরাট সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। সারা বিশ্বে এই পোশাক তৈরিতে বাংলাদেশ শীর্ষ তিন দেশের একটি। ইউরোপের বিশাল বাজারে জিন্স রফতানিতে বাংলাদেশই শীর্ষে। বিশ্ববাজারে এই পোশাক রফতানিতে চীনকে টপকে এক নম্বর হওয়ার পথে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে অনেকটা। তবে এখানেই শেষ নয়। চীন ও তুরস্কের ডেনিম বাজার দখলের হাতছানিতে বাংলাদেশ। শুধু বিদেশে রফতানিই নয়, অভ্যন্তরীণ বাজারেও এই পোশাকের একচ্ছত্র প্রভাব। বাংলাদেশে তারুণ্যের পোশাক হয়ে উঠেছে জিন্স। যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ খাত থেকে ৭০০ কোটি ডলারের রফতানি আয় সম্ভব। এই অফুরন্ত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উদ্যোক্তারা কম সুদে ঋণ, গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। জানা গেছে, ডেনিম নামের বিশেষ কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাকের নাম জিন্স। শুরুতে ডেনিম কাপড়ে তৈরি প্যান্টকে জিন্স বলা হতো। এখন জিন্স শব্দটি এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, অনেকে ডেনিম কাপড়কেই জিন্স নামে চেনেন। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কারণে প্যান্টের পাশাপাশি ডেনিম কাপড় দিয়ে এখন ছেলে ও মেয়েদের শার্ট ও জ্যাকেট, পাঞ্জাবি, মেয়েদের টপস, বাচ্চাদের পোশাক তৈরি হচ্ছে সমানতালে। ফ্যাশনসচেতন মানুষের হাতব্যাগ, কাঁধে ঝোলানোর ব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, এমনকি পায়ের জুতায়ও স্থান নিয়েছে ডেনিম কাপড়। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশে এই পোশাক রফতানিতে এখন শীর্ষস্থানে বাংলাদেশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ডেনিম পোশাক রফতানিতে চীন ও মেক্সিকোর পর তৃতীয় অবস্থানটি বাংলাদেশের। বাংলাদেশের রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) কিংবা পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর কাছে পৃথকভাবে ডেনিম পোশাক রফতানির পরিসংখ্যান নেই। তবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির প্রায় ৮২ শতাংশই যায় ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে আমদানিকারকদের কাছ থেকেই পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান দফতর ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে তুরস্ককে পেছনে ফেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ডেনিম পোশাক রফতানিতে শীর্ষে পৌঁছায় বাংলাদেশ। সে বছর ৯৩ কোটি ৯০ লাখ ইউরোর (১ ইউরোয় ৮৬ টাকা) ডেনিম রফতানি করে বাংলাদেশ। পরের বছর ২৫ শতাংশ বেড়ে ডেনিম পোশাক রফতানি ১১৭ কোটি ৬১ লাখ ইউরোতে দাঁড়ায়। গত বছরের ছয় মাসে ৫৬ কোটি ইউরোর ডেনিম রফতানি হয়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের তথ্য বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে ডেনিম পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে। গত বছর দেশটিতে ৪৩ কোটি ডলারের ডেনিম পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ। এই আয় ২০১৪ সালের ৯২ কোটি ডলারের চেয়ে শূন্য দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেনিম রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ। রফতানি হয়েছে ১৮ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের ডেনিম পোশাক। বর্তমানে জিন্সে বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে টমি, জি-স্টার, জ্যাক এ্যান্ড জোনস, কেলভিন ক্লেইন, স্পিরিট বাংলাদেশের কারখানা থেকে জিন্স তৈরি করছে। পাশাপাশি বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে লিভাইস, ডিসেল, জি-স্টার, এইচ এ্যান্ড এম, ইউনিক্লো, টেসকো, র‌্যাংলার, এস অলিভার, হিউগো বস, ওয়ালমার্ট ও গ্যাপসহ ৬৬টি ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে ডেনিম পোশাক আমদানি করে। একই সঙ্গে দেশেও কম মূল্যে জিন্সের চাহিদার বড় অংশ জোগান দিচ্ছে বুড়িগঙ্গার পাশে কেরানীগঞ্জের ছোট ছোট কারখানা। এখানকার কারখানায় বিশ্বের নামীদামী ব্র্যান্ডের আদলে জিন্স তৈরি হয়। ছোট ও বড়দের জিন্সের পাইকারি দাম ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে তরুণদের জন্য ৪৫০ থেকে ৭৫০ টাকার জিন্সই বেশি চলে। দেশের বাজারের ৭০ শতাংশ জিন্স এখান থেকে সরবরাহ হয় বলে অনুমান কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির নেতাদের। এ ছাড়া রফতানিমুখী কারখানার বাতিল ও ক্রয়াদেশের অতিরিক্ত জিনস্ বাজারে আসছে। নিউমার্কেট, বঙ্গবাজার, এলিফ্যান্ট রোডসহ বিভিন্ন জায়গায় এসব জিন্স পাওয়া যায়। এ ছাড়া দেশীয় ব্র্যান্ড শপগুলো জিন্স তৈরি করছে। তাদের ক্রেতা মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোক। ডেনিম উৎপাদনকারী আরেক প্রতিষ্ঠান অ্যাম্বার ডেনিমের অপারেশনস্ বিভাগের পরিচালক এমএস হাসান জানান, দামে সস্তা হওয়ার কারণেই শুধু বাংলাদেশের ডেনিম ইউরোপের বাজারে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তা নয়। উন্নতমান, স্বল্প সময়ের মধ্যে উৎপাদন (লিড টাইম) ও প্রতিশ্রুতি মতো পণ্য সরবরাহ রফতানি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, টেস্টিং ও সার্টিফিকেশনে আধুনিক একটি ডেনিম ল্যাবরেটরির জন্য অ্যাম্বার ডেনিম বড় বিনিয়োগ করেছে। এটি আমাদের লিড টাইম কমাতে সাহায্য করেছে। ডেনিম এ্যান্ড জিন্স ডটকমের তথ্যমতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ডেনিম পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ শীর্ষে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয়। ২০১৫ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ৪৬ কোটি মার্কিন ডলারের ৭ কোটি ৪৩ লাখ পিস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৭৭ কোটি ডলারের ১৪ কোটি পিস ডেনিম পণ্য (জিন্সের প্যান্ট, শার্ট, জ্যাকেট, ব্লেজার ইত্যাদি) রফতানি করেছে বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নে মোট রফতানির ২১ শতাংশ যোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রে মোট রফতানির ১২ শতাংশ ডেনিম পোশাক যোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ডেনিমের বাজার সম্পর্কিত কয়েকটি সমীক্ষার তথ্যমতে, ১৯৮৯ সালে প্রথম হংকং ও ফিলিপিন্সের দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে ডেনিম পোশাক তৈরির দুটি কারখানা স্থাপন করে। ১৯৯২ সালের নবেম্বরে বাংলাদেশ বিশ্বের ১১তম ডেনিম সরবরাহকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। জানা গেছে, বর্তমান বিশ্বে ডেনিমের বাজার কমবেশি ৫৬ বিলিয়ন ডলারের। ২০২১ সাল নাগাদ এটি ৬৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। গড়ে কম মূল্যের ডেনিম পোশাক রফতানি করে বলেই বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে জোগান দেয়া হয় ৩৫০ কোটি ডলারের ডেনিম পণ্য। বিশ্বে বাংলাদেশের ডেনিমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে এ খাতে ৭০০ কোটি ডলারের রফতানি আয় সম্ভব। এই অফুরন্ত সম্ভাবনা কাজে লাগাতে কম সুদে ঋণ, গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, ডেনিমের বাজার ধরতে বর্তমানে বড় সমস্যা অবকাঠামোগত দুর্বলতা। সঙ্গে দক্ষ কারিগরও নেই। এ ছাড়া মাঝারিমানের একটি ডেনিম কারখানা করতে কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন। এত টাকাও একজন উদ্যোক্তার পক্ষে জোগান দেয়া সম্ভব নয়। ব্যাংকঋণও পর্যাপ্ত নয়। ঋণ পেলেও সুদের হার অনেক বেশি, যা দিয়ে প্রতিযোগিতায় টেকা কঠিন। এ ছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের সঙ্কট তো আছেই। এসব কারণে দেশে ডেনিমের কারখানা হচ্ছে কম। চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের মোস্তাফিজ উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বের প্রতি তিনজন মানুষের একজন জিন্স পরে। আর শীতপ্রধান দেশে জিন্স ছাড়া তো উপায়ই নেই। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিশ্বের ডেনিমের বাজার ছয় হাজার কোটি ডলারের। সেখানে আমরা মাত্র ৩৫০ থেকে ৩৭০ কোটি ডলারের ডেনিম পোশাক রফতানি করি। ফলে রফতানি বাড়ানোর ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। বর্তমানে দেশের ৩০০ থেকে ৪০০ পোশাক কারখানায় ডেনিম পোশাক তৈরি হচ্ছে।
×