ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ট্রেনে করে প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছে হাজারো মানুষ। ট্রেনের বগি স্বল্পতার কারণে যাত্রীরা ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে ও বগির ছাদে উপরে বসে প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছে। ফলে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে যাত্রীদের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। ইঞ্জিনের সামনে এবং বগির ছাদের উপরে বসে শত শত যাত্রী চলাচল করলেও কর্তৃপক্ষ তা কিছুতেই রোধ করতে পারছে না। বগির স্বল্পতার কারণে যাত্রীরা টিকেট কেটেও দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ট্রেনের ইঞ্জিনে ও বগির ছাদের উপরে বসে যাতায়াত করা এখন মৃত্যুরফাঁদে পরিণত হয়েছে। নাগরিক কমিটিসহ সাধারণ মানুষ এ রেলপথে ট্রেনের বগির বাড়ানোর জোর দাবি জানান।
জানা গেছে, শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জ রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা। ঢাকার কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ নগরীর নদীবন্দর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটারের রেলপথ রয়েছে। এতে কমলাপুর, গে-ারিয়া, পাগলা, ফতুল্লা, চাষাঢ়া ও নারায়ণগঞ্জ নামে ৬টি রেল স্টেশন রয়েছে। ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত সোয়া এগারোটা পর্যন্ত সরকারী ও বেসরকারী তিনটি ট্রেন ৩২ বার আসা-যাওয়া করছে। দুটি লোকাল ট্রেন লিজ নিয়ে এসআর ট্রেডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। ডেমু ট্রেনটি রেলওয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে। নারায়ণগঞ্জ নগরী, বন্দর ও ফতুল্লাসহ আশপাশের মানুষ এ রেলপথে যাতায়াত করে থাকে। এছাড়াও মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, মতলবসহ বিভিন্ন অঞ্চলের যাত্রীরা লঞ্চে করে এসে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর হয়ে ট্রেনে চড়ে রাজাধানী ঢাকায় যাতায়াত করছে। এ তিনটি ট্রেন দিয়ে প্রতিদিন আনুমানিক ৩০ হাজার যাত্রী ট্রেনের ভেতরে, ইঞ্জিনে ও বগির উপরে বসে যাতায়াত করছে। এ পথে প্রতি প্রায় ঘণ্টায়ই ট্রেন চলাচল করছে। সড়ক পথে যানজট ও ভাড়া বেশি হওয়ায় যাত্রীরা ট্রেনে যাতায়াতই বেছে নিচ্ছে। এতে ট্রেনে যাত্রীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যাত্রী সংখ্যা বেশি হলেও বাড়ছে না বগি। অনেক যাত্রী টিকেট কেটেও বসার আসন পাচ্ছে না। তারা দাঁড়িয়ে নির্ধারিত গন্তব্যে যাতায়াত করছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে চাকরিজীবী, ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার লোকজন যাতায়াত করে থাকে। বিশেষ করে অফিস শুরুর আগে ও শেষ হওয়ার পরে ট্রেনের যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যায়। ফলে ট্রেন কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের পরিবহন করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। নগরীর নিতাইগঞ্জ এলাকার যাত্রী জুয়েল মিয়া (৫৫) জানান, বগির স্বল্পতার কারণে যাত্রীরা টিকেট কেটেও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আবার ৩ জনের আসনে ৪ জন বসেও যাতায়াত করছে। গাদাগাদি করে এ পথে যাতায়াত করতে হয়। অনেকে আবারও ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে ও বগির ছাদের উপরে বসেও যাতায়াত করছে। ঢাকার গে-ারিয়ার ছাত্রী পলি আক্তার জানান, প্রতিদিন ট্রেনে করে সরকারী তোলারাম কলেজে লেখাপড়া করতে আসেন। অধিকাংশ সময়ই তিনি ট্রেনের আসন পান না। কারণ পূর্বের স্টেশন থেকেই ট্রেনের আসন পূর্ণ হয়ে যায়। ফলে তাকে দাঁড়িয়েই যাতায়াত করতে হয়। দেওভোগের বাসিন্দা আব্দুস সালাম জানান, ট্রেনে যাতায়াত করলে যানজটে আটকে থাকতে হয় না। তাই তিনি ঢাকায় ট্রেনেই বেশি যাতায়াত করছেন। তবে বগির স্বল্পতার কারণে সময়মতো স্টেশনে এসে টিকেট কেটেও দাঁড়িয়ে গন্তেব্য যেতে হচ্ছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের দাঁড়িয়ে যেতে খুবই সমস্যা হচ্ছে। এভাবেই প্রতিদিন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ট্রেনে চড়ে হাজারো যাত্রী কষ্ট স্বীকার করেই যাতায়াত করছে। গত এক বছরে ইঞ্জিনের সামনে ও বগির ছাদের উপরে বসে যাতায়াত করা ও ট্রেনে কাটাপড়াসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় লোকজনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে শ্রমিক, শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত লোকজনও ট্রেনে করে যাতায়াত করে থাকে। ট্রেনে যাতায়াতের দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো জীবনের ঝুঁকি কম, দ্বিতীয়টি হলো- বাসের ভাড়ার চেয়ে ট্রেনের ভাড়া কম থাকায় গরিব মানুষগুলো ট্রেনে যাতায়াত করে থাকে বেশি। তিনি আরও জানান, শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড় থেকে ৫-৭ লাখ মানুষ ঢাকায় যাতায়াত করে থাকে। এমনকি ঢাকা থেকেও তারা ট্রেনে করে এলাকায় আসা-যাওয়া করে। আমরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে আরও ট্রেন বাড়ানোর দাবি জানাই। অন্তত পক্ষে আরও ৩টি ট্রেন বাড়ানো যায় তবে অনেকটাই এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আমরা মনে করি। আর যদি সরকার এখনই ট্রেন বাড়াতে না চান, তবে দু-একটি বগি বাড়ালেও আপাতত কিছু হলেও সঙ্কট দূর হবে।
নারায়ণগঞ্জ রেল স্টেশনের এসআর ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের টিকেট কাউন্টারের সুপার ভাইজার গোলাম মোস্তফা জানান, যাত্রীর চাপ বাড়লেও আমাদের এসআর ট্রেডিং কোম্পানির মালিকের করার কিছুই নেই। যদি সরকার ইচ্ছে তবে বগি বাড়তে পারেন। তিনি আরও জানান, নারায়ণগঞ্জ স্টেশন থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টিকেট বিক্রি হচ্ছে। চাষাঢ়ায় প্রতিদিন ২ হাজার থেকে আড়াইহাজার টিকেট বিক্রি হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুরের ভাড়া জনপ্রতি ১৫ টাকা করে। ডেমু ট্রেনের ভাড়া ২০ টাকা করে। ডেমু ট্রেনটি সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে।
নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের সিনিয়র স্টেশন মাস্টার গোলাম মোস্তফা বলেন, এসআর ট্রেডিংয়ের কাছে ট্রেনের সঙ্গে ৭টি বগি দিয়ে চলাচলের জন্য লিজ দেয়া আছে। তারাই ভাড়া ও যাত্রীর বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন। যদি যাত্রীর চাপ বেশি থাকে তবে তারাই রেলওয়ের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে বলেন, তবে হয়ত কর্তৃপক্ষ বগি বাড়াতেও পারেন। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ এলাকার সচেতন মহল যদি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে বলেন তবে তাদের অনুরোধেও বগি বাড়ানোর ব্যবস্থাও করতে পারে। তিনি আরও জানান, এক শ্রেণীর লোক আছে যারা ট্রেনের ভেতরে খালি থাকলেও তারা ইঞ্জিনের সামনে ও বগির ছাদের উপরে বসে যাতায়াত করতেই বেশি পছন্দ করেন। এটা কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না। আমরা অনেক চেষ্টাও করেছি। বহুবার এসব যাত্রীদের ট্রেন থেকে নামিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে তারা আবারও ট্রেনের ছাদে ও ইঞ্জিনের সামনে উঠে যায়। তবে ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে ও বগির ছাদে চড়ে যাতায়াত করা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এতে প্রাণহাণির আশঙ্কাও রয়েছে।