ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বোরহান আহমেদের অজানা কথা

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বোরহান আহমেদের অজানা কথা

আজ ২৪ সেপ্টেম্বর, প্রখ্যাত সাংবাদিক বোরহান আহমেদের মৃত্যুর আট বছর পূর্ণ হবে। জানি না কিভাবে কেমন করে এতগুলো দিন, মাস, বছর পার করেদিলাম। উনার চলে যাওয়াটা কেন জানি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমি জানি জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ সবই মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা। এই পৃথিবীতে ভাল-মন্দ যা কিছু ঘটে সবই আল্লাহর ইচ্ছায়ই ঘটে। তাই মনে হয়, এত জীবন্ত তরতাজা মানুষটা যাওয়ার আগে ছেলের ঘরে গিয়ে হয়ত শেষবারের মতো সাদ্দামকে দেখে নিয়েছিলেন। বুয়াকে বললেন, ‘গেলাম কিন্তু, ঘর-বাড়ি দেখেশুনে রাখবা’। আমরা দুজন পার্কে হাঁটার জন্য বেরুলাম। আমি রিক্সাতে বসতেই বললেন, টাকা নিয়েছ ত। আমি বললাম ‘তোমার পকেট থেকে বিশ টাকা নিয়েছি। তারপর বললেন, ইশ নতুন প্যান্টটা পড়ে এসেছি। আমি বললাম তাতে কি হয়েছে। রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন দেশ কোথায়, কেমন করে সংসার চলে ইত্যাদি। উনি একটু হেঁটে বসে পড়েছিলেন। আমি এক রাউন্ড হেঁটে এসে দেখি মাথাটা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে বসে আছেন। হয়ত আল্লাহ উনার মুখটা শেষবারের মত দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সেই করুণ চেহারা বুকের মধ্যে এখনও গেঁথে আছে। কিছুদূরে যেতেই আমাকে একজন ডাকছেন। আপনার স্বামী কি হাঁটতে এসেছেন? আমি বললাম জি, উনি হাঁটতে এসেছেন। তখন তিনি বললেন, উনি তো অজ্ঞান হয়ে গেছেন। আমি অতি দ্রুত হেঁটে গিয়ে দেখি উনি লম্বা হয়ে মাটির ওপর শুয়ে আছেন। উনাকে এ্যাম্বুলেন্সে করে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। এরই মধ্যে রুমানা, সাদ্দামকে জানিয়ে দিলাম ওদের আব্বুর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা। প্রথমে সাদ্দাম পরে রুমানা চলে আসল। শ্রদ্ধেয় রউফ ভাই সকালের খবরের সাংবাদিকদের নিয়ে চলে আসলেন। অন্যান্য সব আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই এসে হাসপাতাল ভরে গেল। হাসপাতালে সবাই অনেক চেষ্টা করল। আধা ঘণ্টা পরে ওরা জানাল উনি আর নেই। এমন করে আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে গেল! আমাকে কিছুই জানালে না। বোরহান সাহেব একজন অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন। মানুষের জন্য অনেক করেছেন। শুধু পরের উপকার করতেন। উনার কাছে সাহায্যের হাত বাড়ালে খালি হাতে কেউ ফেরেনি। দেশের জন্য, দশের জন্য নিজের সবকিছু দিয়ে সেবা করেছেন, সহযোগিতা করেছেন। তাঁর একটা টেলিফোনের মূল্য ছিল অনেক। অনেক নামি-দামি মানুষ, মন্ত্রী-মিনিস্টার তাকে চিনতেন, সম্মান করতেন। এখনও অনেকে আমাদের খোঁজ খবর নেয়। সবচেয়ে বড় কথা উচ্চ পর্যায়ের অনেকে শ্রদ্ধাভরে সম্মান করে, মর্যাদা দেয় এবং ভালবেসে মনে করে আর বলে যে, বোরহান ভাইয়ের মতো ভাল মানুষ হয় না। আমি আমার অন্তর থেকে উনাকে শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি, উনার স্মৃতি অত্যন্ত জীবন্ত এবং অনেক মধুর। আমার মেয়ে ডাঃ রুমানা বাবাকে ভীষণ ভালবাসে। আমার ছেলে আহমেদ সাদ্দাম বাবাকে প্রচ- ভালবাসে। বাবার কবর জিয়ারত করে, নফল নামাজ আদায় করে, তসবি পড়ে। আমরা তিনজনই উনাকে কোনদিনই ভুলব না। আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় উনার স্মৃতি জ্বল জ্বল করবে আজীবন। বোরহান সাহেব বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। তিনি একজন উঁচু মাপের লেখক ছিলেন। প্রায়ই অনেকে ফোন দিয়ে বলত, আজ যে বড় বোরহান ভাইয়ের লেখা নেই। উনার লেখা না পড়লে মজা লাগে না। তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারাগারের দিনগুলো, ছোটদের জিয়া, সমকালীন প্রেমের গল্প, খালেদা-হাসিনার রাজনীতি, বিএনপি-আওয়ামী লীগের শাসনকাল, মৃত্যুঞ্জয়ী জিয়া ইত্যাদি। মৃত্যুঞ্জয়ী জিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বইটি একটি অলিখিত দলিল বলা যেতে পারে। এর ভেতরে যা লেখা আছে তার সবটাই বাস্তব সত্যি। তিনি বইটি উনার মেয়ে ডাঃ রুমানা ও ছেলে সাদ্দামের নামে উৎসর্গ করেছিলেন। জিয়ার আদর্শ ও সততা হোক ওদের প্রেরণার উৎস। কারাগারের দিনগুলো বইটি পড়তে গিয়ে বারবার কান্নায় দুচোখ ভরে উঠেছে। ১৯৯৪ সালে বোরহান আহমেদ কারাগারে দু’মাস ছিলেন। তখন তিনি দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। জনকণ্ঠ পত্রিকার একজন সহ-সম্পাদক কোরআন শরীফের একটি আয়াত নিয়ে লিখেছিলেন। এই কারণে তাঁকে এবং উপদেষ্টা সম্পাদক শ্রদ্ধেয় তোয়াব খানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এসময় দুটি পরিবার মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম। উনারা ঋরৎংঃ উরারংরড়হ একটি কক্ষে দুজন একসঙ্গে থাকতেন। ঠিক দুদিন পর রাতে দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মাসুদ ভাই ফোন করে বললেন, কী ব্যাপার ভাবী আপনিতো তদবির করে বোরহান সাহেবকে বেল করিয়ে নিলেন।’ আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘মাসুদ ভাই আপনি এসব কি বলছেন? আমি বললাম, মাসুদ ভাই আপনি বোরহানের বেল ঈধহপবষ করে দিন। যে কারণে উনারা দুজন গ্রেফতার হয়েছেন, ঠিক সেভাবে দুজন একসঙ্গে জেল থেকে বেরুবেন। একটু পরে মাসুদ ভাই আবার ফোন দিলেন। ‘ভাবী আপনি ভেবে বলছেন তো যে, বোরহান সাহেবের বেল নেবেন না।’ আমি এর উত্তরে বললাম, অবশ্যই ভেবে বলছি। তার পরদিন দৈনিক জনকণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় বের হলো মিসেস বোরহান আহমেদ বোরহান সাহেবের বেল নিতে অসম্মতি জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলি। কারাগারের দিনগুলো বইটির ইংরেজি ভাষায়ও লেখা হয়েছিল। তিনি দীর্ঘ দুমাস কারাগারে থাকাকালীন সময়ে নিজ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নিত্যদিনের ঘটনাবলী অত্যন্ত সুন্দরভাবে সুনিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। একটি সেলে দশটি কক্ষ ছিল। এতে মোট বিশ জন ছিলেন। প্রত্যেকটি রুমের সঙ্গে বাথরুম, সিলিং ফ্যান ছিল। আলাদা বাবুর্চি ছিল, বারান্দা ছিল, ওদের সঙ্গে অভিও ছিল। কেন জানি না বোরহান ওকে ভীষণ পছন্দ করতেন। আমি জীবনে মাঝে মাঝে অনেকের সম্পর্কে লিখেছি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এই প্রথম আমি স্বামীর সম্পর্কে নিজ অভিজ্ঞতা থেকে লিখলাম। আরও অনেক কিছু আছে যা লিখে হয়ত শেষ করতে পারব না। তিনি একজন সাংবাদিক, লেখক এবং বাংলাদেশ ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। জনকল্যাণ তাঁর ব্রত ছিল। তিনি অন্য পেশা বাদ দিয়ে সাংবাদিকতা পেশা বেছে নেন। যদিও দারুণ এক ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। তিনি ভালবেসে এ কাজটি করতে গিয়ে নিজে একদিনও ছুটি নেননি। তিনি নিয়মিত দুবার অফিসে যেতেন এবং যত রাতই হোক কাগজ বের হলে নিজে হাতে নিয়ে দেখেশুনে বাড়ি আসতেন। তার সাংবাদিকতা শুরু হয় দৈনিক আজাদ পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি প্রবল প্রতিরোধ ও বিপরীত স্রোতধারার সঙ্গে লড়াই করেছেন এবং আপোষহীন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের বিস্তৃতি ঘটেছে। বোরহান আহমেদ মানিকগঞ্জের এক মুসলিম পরিবারের সন্তান। তিনি ১৯৪৩ সালের ২ জুন নিজ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাংবাদিকতা জীবনে দৈনিক দেশ, জনপদ, পূর্বদেশ, কিশোর বাংলা, জনকণ্ঠ পত্রিকায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষে সকালের খবরের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক হিসেবে নতুন দৈনিক পত্রিকা বের করার দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। তাঁরই প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি দৈনিক। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সংগঠনের কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশ জার্নালিস্ট ফাউন্ডেশন ও নবাঙ্কুর শিশু-কিশোর মেলার সভাপতি ছিলেন। ক্রেতা সাধারণের স্বার্থ রক্ষার্থে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কনজুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেসক্লাবের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে তাঁর নিরলস শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে সংগঠন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেছেন। মহান আল্লাহর কাছে আমার একমাত্র প্রার্থনা আল্লাহ্ যেন উনাকে জান্নাতবাসী করেন। আমিন। লেখক: সাংবাদিক বোরহান আহমেদের স্ত্রী
×