ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতুতে স্প্যান ওঠানোর প্রক্রিয়া শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

পদ্মা সেতুতে স্প্যান ওঠানোর প্রক্রিয়া শুরু

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ পদ্মায় স্প্যান (সুপার স্ট্রাকচার) ওঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শুক্রবার সকালে তিন হাজার ২শ’ টন ওজনের স্প্যানটি ভাসমান ক্রেনে ওঠানোর কাজ শুরু হয়। রেললাইনের ন্যায় বিশেষ ক্রেনলাইনে করে এটি ওয়ার্কশপ থেকে নদীতীরে নেয়া হয়। পরে ভাসমান ক্রেনে ওঠানো সম্ভব হয় সন্ধ্যায়। দিনভর বিশাল এ স্প্যান ওঠানো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন বিশেষ কর্মীরা। এর আগে রং সম্পন্ন হলে স্প্যানটি বৃহস্পতিবার রঙের ওয়ার্কশপ থেকে বের করা হয়। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখার সময় স্প্যানটি ভাসমান ক্রেনের সঙ্গে ঝুলন্ত রশি দিয়ে বাঁধা হচ্ছিল। ৩৬শ’ টন ক্ষমতার এ ভাসমান ক্রেন স্প্যানটি টেনে নিয়ে যাবে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিয়ারে। সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) এ ভাসমান ক্রেনটির (জাহাজ) এ স্প্যান নিয়ে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে। তবে দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, কাল রবিবারও রওনা হতে পারে। এখন বিলম্ব শুধু নদীতে নাব্য সঙ্কট। নদীর যে চ্যানেলে এ জাহাজটি যাবে সেখানে পানির গভীরতা যথাযথ নয়। তাই উচ্চক্ষমতার তিনটি ড্রেজার সেখানে দিনরাত খননকাজ করছে। তবে আগামী দু’-একদিনের মধ্যেই প্রয়োজনীয় নাব্য ফিরিয়ে আনতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। পরবর্তীতে ৩০ সেপ্টেম্বর এ স্প্যান স্থাপন করার কথা রয়েছে। সে মাহেন্দ্রক্ষণটিকে ঘিরে আছে এখন নানা প্রস্তুতি। ১৬ কোটি বাঙালীর সেই ক্ষণের অপেক্ষায় এখন। পদ্মা সেতুর দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, প্রথম স্প্যানটি স্থাপনের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে অন্যান্য স্প্যানও ওঠানো শুরু হবে। এখন ৩৭ থেকে ৪২ নম্বর পিলার সম্পন্ন পর্যায়ে। ৩৯ নম্বর পিলারে খুঁটি উঠছে। ৪০ নম্বর পিলারের পাইলের ওপর বেইজ ঢালাই চলছে আর ৪১ নম্বর পিলারের পাঁচটি পাইল বসেছে। বাকি পাইলটিও এখন বাসানোর কাজ চলছে। এ ৪১ নম্বর পাইল বসাতে গিয়েই কয়েকবার হ্যামার বিকল হয়। তবে সব চ্যালেঞ্জ সফল হওয়ার পর এখন ৪১ নম্বর পিলারও সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। এছাড়া তীরের ৪২ নম্বর পিলারে পাইলের ওপর বেইজ করা হচ্ছে। প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের কাজ ১৭ সেপ্টেম্বর শেষ হয়েছে। দুই পিলারের ওপর যে স্প্যান বসানো হবে তার কাজও শেষপর্যায়ে। পিলার দুটির কংক্রিট ৫০ মেগাপ্যাসকেল শক্তি অর্জন করলে ¯প্যান বসানো হবে। এরপরই শেষ হবে ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিলারের কাজ। এ চারটি পিলারের ওপর তিনটি স্প্যান বসবে। স্প্যানের মাঝ বরাবর চলবে ট্রেন। উপরে কংক্রিটের চার লেনের সড়কে চলবে গাড়ি। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রকল্পের প্রায় ৪৭ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। সেতুতে মোট ৪২টি পিলার থাকবে। এর মধ্যে ৪০টি পিলার নির্মাণ করা হবে নদীতে। দুটি নদীর তীরে। নদীতে নির্মাণ করা প্রতিটি পিলারে ছয়টি করে পাইলিং করা হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য গড়ে প্রায় ১২৭ মিটার পর্যন্ত। একটি পিলার থেকে আরেকটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে দুটি পিলারের ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হবে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আগামী বছরের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, নদীতে মূল সেতুর এখন ৫৫টি পাইল সম্পন্ন হয়ে গেছে। এছাড়াও বটম অবস্থায় রয়েছে আরও ২২টি পাইল। এছাড়া জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সেতুর ১৭৮টি পাইল বসেছে। এখানে আর মাত্র ১৫টি পাইল বাকি সংযোগ সেতুর (ভয়াডাক্ট) জন্য। আর মাওয়ায় এ পর্যন্ত সংযোগ সেতুর পাঁচটি পাইল বসেছে। এদিকে পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেল তিন দিনব্যাপী সরেজমিন সভা সম্পন্ন করে গুরুত্বপূর্ণ অবজারবেশন দিয়েছে। এতে অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ দেশী-বিদেশী ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পুরো টিম অংশ নিয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেনÑ যুক্তরাষ্ট্রের আব্দুল আউয়াল, জাপানের ইসিহারা ও ফুজিনো, কানাডার অস্টেন ফিল্ট ও নেদারল্যান্ডসের কারবাজাল। গত শনিবার গুরুত্বপূর্ণ সভাটি শেষ হয়। এতে বেশিরভাগ সময়ই বাকি ১৪টি পিয়ারের ডিজাইন চূড়ান্তকরণে বিশেষ বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘কাউই’ ও ‘রেন্ডেল’ বিস্তারিত রিপোর্ট উপস্থাপন করে। পরে অবজারবেশন দেয়া হয় এ ব্যাপারে। তাই আশা করা যাচ্ছে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাকি ১৪ পিলারের চূড়ান্ত ডিজাইন অনুমোদন পাচ্ছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অবিরাম বিশেষ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। সবার মধ্যেই বিশেষ এক উদ্যম লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে ধূসর রং হবে পদ্মা সেতুর। তাই ধূসর রঙের ‘৭এ’ নম্বর স্প্যানটি বসার অল্প সময়ের পরই বসবে পরেরটি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ‘৭বি’ নম্বর স্প্যানটির ফিটিং সম্পন্ন রয়েছে। এটিও শীঘ্রই রং করা শুরু হবে। কারণ অক্টোবরের শেষদিকে এ স্প্যানটি বসবে ৩৮ ও ৩৯ পিয়ারের। ইতোমধ্যেই ৩৯ নম্বর পিয়ারের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানান, দুটি হ্যামার এখন হরদম পাইল বসাচ্ছে। জাজিরা ও মাওয়া উভয় প্রান্তে পাইল বসেছে। আগামী নবেম্বর মাসের শেষদিকে আরেকটি হ্যামার জার্মানি থেকে আসছে মাওয়ায়। এদিকে শুক্রবার সেতু ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পদ্মা সেতু প্রকল্পে আসেন। তিনি প্রকেল্পের অগ্রগতি নিয়ে প্রকৌশলীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে প্রকল্পের ভেতরেই জুমার নামাজ আদায় করে ঢাকায় ফেরেন। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলিও প্রকল্প এলাকায় আসেন। তিনি মাওয়া ঘুরে এসে সন্ধ্যায় বলেন, ‘বাঙালীর গর্বের পদ্মা সেতু মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসের ফসল, গোটা বাঙালীর গর্ব।’
×