ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দিনে ১০ থেকে ২০ হাজারের অনুপ্রবেশ ঘটছে

বর্মী বাহিনীর রোহিঙ্গা নিধন অভিযান থামছে না

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বর্মী বাহিনীর রোহিঙ্গা নিধন অভিযান থামছে না

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা বর্বরতার ঘটনায় রোহিঙ্গা সঙ্কট গভীর থেকে গভীরতম হচ্ছে। বিশ্ববাসী যেখানে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান বন্ধের জন্য মাঠে নেমেছে সেখানে মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্বাধীন যৌথ অভিযান থামছেই না। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে- মিয়ানমার বাহিনী তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের সমূলে রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হতে যে মিশন নিয়েছে তা তারা সম্পন্ন করবেই। নির্যাতন, হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও ও বিতাড়নমুখী তৎপরতার ফলে প্রতিদিন গণহারে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেই চলেছে। আর দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে সীমান্তমুখী হওয়ার পথে নির্বিচার গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ রোিহঙ্গারা। সমুদ্রপথে আসতে গিয়েও ডুবে মরছে। বৃহস্পতিবার নাফ নদীতে আরও চার রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার হয়েছে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরের মিয়ানমার এলাকায় অসংখ্য রোহিঙ্গার লাশ ভাসছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রাখাইনের চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে একমাত্র চীন ছাড়া কোন বৃহৎ শক্তি মিয়ানমার সরকারের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেয়নি। প্রতিবেশী দেশ ভারত রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে সুনির্দিষ্ট কোন পদক্ষেপ না নিলেও অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণের প্রথম একটি চালান প্রেরণ করেছে। রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-জুলুম ও গণহারে হত্যার ঘটনা বিশ্ব ইস্যুতে পরিণত হলেও বর্মী (মিয়ানমার) বাহিনী থামছে না। তাদের নিপীড়নের মুখে টিকতে না পেরে প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ হাজার করে রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে বাংলাদেশে। গত ২৫ আগস্ট রাত থেকে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা আইওএমের (ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশন) মতে, পৌনে চার লাখেরও বেশি উল্লেখ করা হলেও বেসরকারী পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা পাঁচ লাখ ছুঁই ছুঁই করছে। গুলিতে, মাইন বিস্ফোরণ, নৌকাডুবিসহ বিক্ষিপ্ত ঘটনায় ঠিক কী পরিমাণ রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে, সঠিকভাবে তা নির্ণয় করা না গেলেও বেসরকারী বিভিন্ন সূত্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ইতোমধ্যে পৌনে দুই শতাধিক গ্রাম রোহিঙ্গাশূন্য হয়েছে। বৃহস্পতিবার নতুন করে তমব্রু সীমান্তের ওপারে তিনটি রোহিঙ্গা বসতি সেনা সদস্যরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। সীমান্তের জিরো পয়েন্টগুলোতে এখনও হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। গুলিবিদ্ধসহ আরও তিন রোহিঙ্গাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ নিয়ে এ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধসহ গুরুতর জখম নিয়ে আহত ভর্তি রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০৫ জনে উন্নীত হলো। এছাড়া কক্সবাজারের এমন কোন হাসপাতাল ও ক্লিনিক নেই, যেখানে আহত ও গুরুতর জখম নিয়ে রোহিঙ্গারা চিকিৎসা নিচ্ছে না। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া এমনকি পটিয়া পর্যন্তও বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকে বহু রোহিঙ্গা ভর্তি হয়েছে চিকিৎসা নিতে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বহু দেশের প্রতিবাদ, নিন্দা এবং রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধের আহ্বানকে উপেক্ষা করে চলছে মিয়ানমার বাহিনীর রোহিঙ্গা নিধন অভিযান। রাখাইন রাজ্য জ্বলেপুড়ে মানব কঙ্কালে রূপ নিয়েছে। তবে সামরিক জান্তা নতুন একটি কৌশলও গ্রহণ করেছে, বিক্ষিপ্ত স্থানে কিছু রোহিঙ্গাকে আটকে রেখেছে। সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো বলেছে, এটি সে দেশের সরকারের নতুন কৌশল। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থার সদস্যদের রোহিঙ্গারা যে সেখানে রয়েছে তা দেখাতে ঘৃণ্য এ কৌশল নিয়েছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। আরও আগুন ও হত্যা এদিকে, রোহিঙ্গাবিরোধী দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠলেও সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত আউং সান সুচি সরকার তাদের গৃহীত নীলনক্সা বাস্তবায়নে রোহিঙ্গা নিধন ও বিতাড়ন যেন অব্যাহত রেখেছে। নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু সীমান্তের ওপারে বৃহস্পতিবার নতুন করে তিনটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে অসংখ্য বাড়িঘর পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার সীমান্তের ওপারে ঢেকিবুনিয়া, চাকমাকাটা, গাইট্টাবুনিয়া, তমব্রু, রাইট, কেয়াংচিবং, নয়াপাড়ার রোহিঙ্গা বসতিগুলো সেনা ও রাখাইন সদস্যদের দেয়া আগুনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাশূন্য মিয়ানমারের সিটওয়ে, বুচিদং, রাচিদং ও মংডু- এ চার শহরের বিভিন্ন এলাকা রোহিঙ্গাশূন্য হয়ে পড়েছে। বুধ ও বৃহস্পতিবার এ চার গ্রামে শতাধিক রোহিঙ্গাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে রোহিঙ্গাদের সরদার, মাতব্বর, সাবেক চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং শিক্ষিত শ্রেণীর লোকজনও রয়েছে। সমুদ্রপথে আসছে লাশ, ভিড়ছে কূলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গাদের লাশ সাগরের টেকনাফ উপকূল দিয়ে প্রতিনিয়ত আসছে। এছাড়া রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকাডুবিও ঘটছে প্রতিনিয়ত। বুধবার টেকনাফ উপকূলে আরও চার রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার হয়েছে। স্থানীয়দের সহায়তায় এদের দাফন করা হয়েছে। রোহিঙ্গাশূন্য ১৭৬ গ্রাম রাখাইন রাজ্যে ইতোমধ্যে সেনা বর্বরতায় ১৭৬টি গ্রাম রোহিঙ্গাশূন্য হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশে করেছে এদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। পুরুষের সংখ্যা নারী ও শিশুর তুলনায় অনেক কম। ধারণা করা হচ্ছে, পুরুষ ও যুবকদের নির্বিচারে একদিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অপরদিকে, গুলি ও বর্বরতা থেকে রক্ষা পেতে পুরুষ ও যুবকদের বড় একটি অংশ সেখানকার গহীন অরণ্যে অবস্থান নিয়ে আত্মরক্ষার পথ বেছে নিয়েছে। এমনও তথ্য আসছে, রোহিঙ্গা যুবকদের একটি অংশ দলে দলে আরসার (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) সঙ্গে যোগ দিয়ে বড় ধরনের সশস্ত্র সংগ্রামের পথে শামিল হচ্ছে। টেকনাফ উপকূল দিয়েই এখন বেশি আসছে রোহিঙ্গারা ইতিপূর্বে মিয়ানমার-বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নেমেছিল। এখন এসব স্থানে ওপারে বিজিপি টহল জোরদার হওয়ায় টেকনাফ উপকূল দিয়েই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বড় রুটে পরিণত হয়েছে। এ রুটটি দিয়ে ইঞ্জিনচালিত বিভিন্ন নৌযান বোঝাই হয়ে রোহিঙ্গারা আসছে। আসার পথে ধারণক্ষমতার বেশি নৌকাগুলো উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে ডুবছে। এতে ইতোমধ্যে অসংখ্য রোহিঙ্গার সলিল সমাধি হয়েছে। এদের মধ্যে হাতেগোনা কিছু ভাগ্যবান রয়েছে যারা ঢেউয়ের তালে তালে প্রাণ নিয়ে কূলে এসে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। আবার অনেকে হয়েছে লাশ। মানবতা পদতলে পিষ্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের জের হয়েছে মানবতা পদতলে পিষ্ট। এ নিষ্ঠুর বর্বরতা এমন যে, এর কাহিনী লোমহর্ষকতাকেও হার মানাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের লাইন ধরিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। নারী ও যুবতীরা হচ্ছে ধর্ষিত। শুধু তাই নয়, শিশু থেকে কিশোর, যুবক কেউ হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এর ফলে যেসব রোহিঙ্গা শত প্রতিকূলতার মাঝেও থেকে গিয়েছিল তারাও এখন প্রাণ নিয়ে ছুটছে এদিক-ওদিক। কেউ যাচ্ছে গহীন অরণ্যে আর কেউ করছে অনুপ্রবেশ রাখাইন রাজ্যে সেনা বর্বরতার জের হিসেবে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ সেখানকার গহীন অরণ্য ও ঝোপ-জঙ্গলে আশ্রয় নিচ্ছে। আবার অন্যদিকে বড় অংশটি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পথই বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়ার সুবাদে যারা বন-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিল তারাও এখন অনুপ্রবেশের পথ বেছে নিয়েছে। আগামীতে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ঠিক কোথায় দাঁড়াবে তা স্থানীয়দের পক্ষ থেকে অনুমান করাও মুশকিল বলে জানানো হচ্ছে। নিবন্ধন ও যত্রতত্র বসতি অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন শুরু হয়েছে। তবে গত তিন দিনে নিবন্ধনের আওতায় এসেছে এক হাজারেরও সামান্য বেশি। অভিযোগ উঠেছে, ত্রাণসামগ্রীর আশায় রোহিঙ্গাদের একটি অংশ নিবন্ধন হতে চাইছে। আবার আরেকটি অংশ তাদের পুনরায় ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হবে এ আশঙ্কায় নিবন্ধিত হতে অনাগ্রহী। এ অবস্থায় সব রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা যাবে কি-না তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
×