ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শহরের একক সচ্ছল পরিবারে এই শুশ্রƒষাকারীদের রয়েছে বিপুল চাহিদা ষ মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয়ের সুযোগ, বিদেশেও চাহিদা

বৃদ্ধাশ্রম ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের বিকল্প সেবা ধারণা ॥ কেয়ার গিভার

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বৃদ্ধাশ্রম ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের বিকল্প সেবা ধারণা ॥ কেয়ার গিভার

আনোয়ার রোজেন ॥ ফরহাদুল ইসলাম ও নাহিন আকতার স্বামী-স্ত্রী। তারা দুজনই চাকরি করেন। ফরহাদের বৃদ্ধ বাবা এবং মা তাদের সঙ্গে ঢাকাতেই থাকেন। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে প্রায়ই ভোগেন তারা। চাকরির ব্যস্ততায় দিনেরবেলা বাবা-মায়ের দেখভাল ঠিকমতো করতে পারেন না ফরহাদ-নাহিন। এমন অবস্থায় এই তরুণ দম্পতি যোগাযোগ করেন স্যার উইলিয়াম বেভারেজ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করছে দক্ষ ‘কেয়ার গিভার’ (শুশ্রƒষাকারী), যারা নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ঘরে এসে যত সহকারে প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে থাকেন। তানিয়া আক্তার এমনই একজন কেয়ার গিভার। রাজধানীর একটি কলেজের স্নাতক পড়–য়া তানিয়া ‘পার্ট টাইম জব’ হিসেবে বাসায় গিয়ে বয়স্ক ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেবা দিয়ে থাকেন। প্রশিক্ষিত ও দক্ষ তানিয়ার সেবায় সন্তুষ্ট ফরহাদের বাবা-মা। তাদের সন্তুষ্টি অনেকটা চিন্তামুক্ত করেছে ফরহাদ-নাহিন দম্পতিকে। আর এ সেবার বিনিময়ে পারিবারিকভাবে অসচ্ছল তানিয়ার মাসে আয় হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। শুধু তানিয়া নন, অনেক বেকার তরুণ-তরুণীর জন্য কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরি করেছে ‘কেয়ার গিভিং’ ধারণা। পূর্ণকালীন চাকরি (৮ ঘণ্টা ডিউটি) হিসেবে এ কাজের মাধ্যমে অনেকেই ২৫-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। দক্ষ কেয়ার গিভারদের চাহিদা রয়েছে বিদেশেও। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও ইংরেজীতে মোটামুটি দক্ষতা থাকলে প্রতিঘণ্টায় ১৫ ডলার পর্যন্ত আয়ের সুযোগ আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেয়ার গিভার ধারণাটি আমাদের দেশে নতুন। কিন্তু বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে পরিচিত ও প্রচলিত। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে বহুগুণ। ফলে বাংলাদেশেও শহরাঞ্চলে বিশেষ করে রাজধানীতে বিভিন্ন সচ্ছল পরিবারে অসুস্থ, বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য কেয়ার গিভারের চাহিদা বাড়ছে। ‘বৃদ্ধাশ্রম’ ও শিশুদের জন্য ‘দিবাযত কেন্দ্র’ থেকে সেবা নেয়ার জন্য ব্যক্তি বা শিশুকে যেতে হয় সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে। কিন্তু অনেকে আছেন, যারা ঘরেই সেবা পেতে চান। মূলত তাদের জন্যই ‘কেয়ার গিভার’। সূত্র জানায়, দেশে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বিপুল চাহিদার প্রেক্ষিতে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ কেয়ার গিভার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারী সংস্থাটি বৈশ্বিক সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান স্যার উইলিয়াম বেভারিজ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে। চুক্তির আওতায় উইলিয়াম ফাউন্ডেশন তরুণদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি তাদের চাকরির ব্যবস্থাও করবে। পিকেএসএফ আশা করছে এই উদ্যোগ দেশে কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে; যা দারিদ্র্য বিমোচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জানা গেছে, চুক্তির আওতায় ইতোমধ্যে ১ম ব্যাচে ২০ জন (১১ মেয়ে, ৯ ছেলে) কেয়ার গিভার উইলিয়াম বেভারিজ ফাউন্ডেশন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এদের মধ্যে ১২ জন প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পরপরই ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় চাকরি পান। মনিকা সরকার তাদের একজন। বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানার শাশুড়ি সামসুন্নাহার সিদ্দিকীর কেয়ার গিভার হিসেবে কাজ করেছেন মনিকা। জনকণ্ঠকে তিনি জানান, প্রায় তিন-চার মাস সামসুন্নাহার সিদ্দিকীর কেয়ার গিভার হিসেবে কাজ করেছেন। এ সময় উপযুক্ত পারিশ্রমিকের পাশাপাশি ওই পরিবারের সহযোগিতাও পেয়েছেন। একই ব্যাচের আরেক কেয়ার গিভার ঈশিতা চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, কেয়ার গিভিংয়ের ক্ষেত্রে দক্ষতার পাশাপাশি বিশ্বস্ততা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত উইলিয়াম বেভারিজ ফাউন্ডেশনের লোকজন আমাদের কাজ যোগাড় করে দেন। আমি বর্তমানে বনানী ও ক্যান্টনমেন্টের দুটি পরিবারে দুই বৃদ্ধার কেয়ার গিভার হিসেবে কাজ করছি। পারিশ্রমিক পাই ঘণ্টা হিসেবে। যা পাই তাতে নিজের খরচ মেটানোর পাশাপাশি পরিবারকেও সহযোগিতার চেষ্টা করি। জানা গেছে, প্রথম ব্যাচের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আরও ৩০ জনকে দুই ধাপে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। প্রশিক্ষণ বাবদ খরচের বড় অংশ পিকেএসএফ অনুদান সহায়তা দেবে। প্রশিক্ষিত এসব কেয়ার গিভারের বেশিরভাগ নারী। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা তরুণদের প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিকেএসএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোঃ জসীম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবীণ জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে কেয়ার গিভারের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। শুধু বৃদ্ধদের জন্য নয়, একক পরিবারে শিশুদের দেখভালের জন্যও উপযুক্ত মানুষের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়াও এশিয়ার উন্নত দেশগুলোতে কেয়ার গিভারের বিপুল চাহিদা রয়েছে। এই উপলব্ধি থেকে কেয়ার গিভার প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পিকেএসএফের মূল উদ্দেশ্য কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করা। প্রশিক্ষিত কেয়ার গিভার তৈরি করতে পারলে উচ্চ মজুরিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ যেমন সৃষ্টি হবে পাশপাশি প্রবীণরা সেবাও পাবেন। ভবিষ্যতে আরও অধিক কেয়ার গিভার তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা পিকেএসএফের রয়েছে বলে জানান তিনি।
×