ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

বিস্ময়কর থেরাপি ॥ শরীর নিজে ক্যান্সার ধ্বংস করবে

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বিস্ময়কর থেরাপি ॥ শরীর নিজে ক্যান্সার ধ্বংস করবে

ক্যান্সার চিকিৎসায় যুগান্তকারী অগ্রগতি ঘটেছে। উদ্ভাবিত হয়েছে এমন এক কৌশল যা প্রচলিত ক্যান্সার চিকিৎসায় আমূল রূপান্তর ঘটিয়ে দেয়ার অপার সম্ভাবনা ধারণ করে আছে। নতুন এই বৈপ্লবিক চিকিৎসাটি কোন পিলের আকারে বা ড্রাগের আকারে নয়। এটি শরীরের নিজস্ব কোষগুলোকে ক্যান্সার বিধ্বংসী এজেন্টে রূপান্তরিত করে দেয়। জিনেটিক্সের শক্তিকে ইমিউন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করে এই বিস্ময়-চিকিৎসাটি রোগীদের জীবন রক্ষা করছে। লিউকেমিয়া ও লিম্ফোমায় এর কার্যকারিতা আশাব্যঞ্জকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এখন স্তন, প্রোস্টেট, প্যানক্রিয়াস, ওভারি, মারকোমা ও মস্তিষ্কের ক্যান্সারসহ অন্যান্য ক্যান্সারে এই চিকিৎসা প্রয়োগ করে দেখা হচ্ছে। চিকিৎসাটির নাম হলো কারটিসেল থেরাপি। ‘কার’ শব্দটি চিমেরিক এন্টিজেন রিসেপটরের সংক্ষেপ। চিকিৎসাটি এত সম্ভাবনাময় ও শক্তিশালী হওয়ার কারণ এটি একটি জীবন্ত ওষুধ যা রোগীর শরীরই তৈরি করে দেয়। এর জন্য কোন পিল বা লিকুইড নিয়মিত খেতে হয় না। বরং একবারই রোগীর শরীরে প্রবেশ করানো হয়। তারপর তা শরীরকে এমনভাবে ট্রেনিং দেয় যেÑ শরীর নিজেই আজীবনকাল নিজের চিকিৎসা করে চলে। কিভাবে সেই চিকিৎসাটি কাজ করে সে প্রসঙ্গে কিছু বলার আগে দুটি কথা বলে নেয়া ভাল। একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া এমন এক রোগ যা বাচ্চাদের মধ্যে অতি সচরাচর দেখা যায় এবং এর কোন নিরাময় নেই। বাচ্চাদের যত ধরনের ক্যান্সার হয় তার প্রায় এক-চতুর্থাংশই হলো লিউকেমিয়া। অবশ্য ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ বাচ্চার ক্ষেত্রে কেমোথেরাপিতে লিউকেমিয়ার কার্যকর চিকিৎসা হতে পারে। এই ক্যান্সার নির্মূল করতে না পারলে তা আবার ফিরে আসে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই এর পরিণতি হয় মৃত্যু। কয়েক দফা কেমোথেরাপিতে রোগীর আয়ু কিছু প্রলম্বিত করা যেতে পারে বটে, তবে রোগের যত ব্যাপ্তি ঘটে ততই উপশমের সংক্ষিপ্ত হতে থাকে। এর বিকল্পও তেমন একটা ভাল নেই। বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টের একটা ব্যবস্থা আছে বটে। তবে প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রে সেটা সফল হয়। ডোনারের সেল প্রত্যাখ্যাত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। চিকিৎসা গবেষকরা অনেক হিসাব-নিকাশ করেই এক র‌্যাডিকেল নতুন পথ বের করেছেন। সেটা হলো জিন থেরাপিকে এমনভাবে কাজে লাগনো যাতে করে রোগীর ইমিউন সিস্টেম যেভাবে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস নিধন করে ঠিক তেমনিভাবে সেটি ক্যান্সার কোষকেও চিহ্নিত করা ও ধ্বংস করার জন্য প্রশিক্ষিত হয়। এটাই হলো ইমিউনোথেরাপির ক্ষেত্রে সর্বশেষ অগ্রগতি। এক্ষেত্রে বলাই বাহুল্য, লিউকেমিয়া বা লিম্ফোমা রোগীর চিকিৎসার বেলায় প্রথমে তার শরীরের রক্ত থেকে টি সেল বের করে নেয়া হয়। টি সেলের কাজ হচ্ছে ক্যান্সার কোষের সন্ধান বের করে ধ্বংস করা। যাই হোক, ল্যাবরেটরিতে টি সেলগুলোকে জিনগতভাবে পরিবর্তন করা হয় যাতে করে সেগুলো চিমেরিক এন্টিজেন রিসেপটর (কার) উৎপাদন করতে পারে। কার তৈরি করতে পারলে টি সেলগুলো ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে আরও ভালভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে লড়াই করতে পারে। কারে টি সেলগুলো ল্যাবে বিপুল সংখ্যায় তৈরি করে ইনফিউশনের মাধ্যমে রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ক্যান্সার কোষগুলোতে বিচিত্র এক ধরনের প্রোটিন থাকে যেগুলো এসব কোষের একান্ত নিজস্ব। কার টি সেলের রিসেপটরগুলো এই অদ্ভুদ প্রোটিনগুলোকে চিনতে পারে এবং সেগুলোকে আটকে ফেলে। তখন টি সেলগুলো ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে দেয়। সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন সন্তুষ্টিগতভাবে যা করতে পারে তার চেয়ে ঢের বেশি নিখুঁতভাবে টার্গেট করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে এই কার টি সেল থেরাপি। প্রথম দিকে ক্যান্সার ইমিউনোথেরাপির লক্ষ্য ছিল যে কোন ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা। পরে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এটিকে ব্যক্তি পর্যায়ের নিখুঁত চিকিৎসায় রূপ দেন। কারণ, তারা লক্ষ্য করেছেন যে প্রত্যেক রোগীর ক্যান্সার কোষ অনন্য। তাই সেগুলো ধ্বংস করতে হলে অনন্য কার টি সেল প্রয়োজন। আর রোগীর দেহে এই কার টি সেলের ইনফিউশন জীবনে একবারই মাত্র লাগে। ওই একটি ইনফিউশনেই তার শরীরের ইমিউন ব্যবস্থা আজীবন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে পারে। অবশ্য এই বৈপ্লবিক চিকিৎসাটা হঠাৎ করে আসেনি। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে শরীরের ইমিউন সেগুলোকে কাজে লাগানোর ধারণাটি অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগের ব্যাপারটা খুব কঠিন হয়ে দেখা দেয়। সংক্রমণ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস শরীরের নিজস্ব নয়। এগুলো বাইরে থেকে আসে। ইমিউন কোষগুলো একান্ত বহিরাগত এই কোষগুলোর বিরুদ্ধে লড়তে চায় ও লড়ে। কিন্তু ক্যান্সার কোষ তো আর বহিরাগত নয়। এগুলোর যাত্রা শুরু হয় সুস্থ কোষ হিসেবে?। সেগুলোই পরে রূপান্তরিত হয়ে ক্যান্সার কোষের রূপ নিয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শরীরের ইমিউন ব্যবস্থা তার এই নিজস্ব কোষকে টার্গেট করে লড়তে প্রবৃত্ত হয় না বা চায় না। কার টি সেল থেরাপি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিজ্ঞানী। এতে অগ্রণী ভূমিকা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সেলুলার ইমিউনোথেরাপির পরিচালক ড. কার্ল জুন’এর প্রায় তিন দশক এ নিয়ে সাধনা করেন। প্রথম দিকে একের পর এক পরীক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এক সময় দেখা যায় যে ইমিউন সেলগুলো হয় ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করছে অথবা মিস করছে। এটা নির্ভরযোগ্য কোন চিকিৎসার রূপ নিতে পারেনি। শেষে তিনি ক্যান্সারের মার্কারের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন সেটার ওপর ইমিউন কোষগুলো যেন ভর করতে পারে এমনভাবে কাজে লাগানো যায়। লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে সেই মার্কারটা দেখা গেল সিডি ১৯ নামের একটি প্রোটিন যা ক্যান্সারপুষ্ট সমস্ত রক্তকোষের গায়ে গজিয়ে ওঠে। ড. জুন ইমিউন কোষের জিনগত রূপান্তর ঘটিয়ে এমন একটি প্রোটিন বহনে সশস্ত্র করে তোলেন সেটি সিডি ১৯ এর সঙ্গে এটে থাকবে। সেই সঙ্গে আরেকটি মার্কারও বের করেন যা ইমিউন কোষকে এমনভাবে সক্রিয় করে তুলবে যে সেগুলো ক্যান্সার মার্কারের দেখা পাওয়া মাত্র ক্যান্সার কোষকে আগ্রাসীভাবে আক্রমণ করে ধ্বংস করবে। ড. জুলন ও তার সহকর্মী ব্রুস লেভিন ইমিউন কোষের জিনেটিক রূপান্তর ঘটিয়ে ল্যাবরেটরিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যান্সার বিধ্বংসী কোষ উৎপাদনের এক নিখুঁত কৌশল উদ্ভাবন করেন। এরপর শুরু হয় লিউকেমিয়া আক্রান্ত প্রাণীদেহের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরীক্ষা সফল প্রমাণিত হলে মানবদেহে এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করা হয়। এই চিকিৎসার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ল্যাবে ইমিউন সেলের জিনেটিক পরিবর্তন আসার পর রোগীর শরীরে তা শিরাপথে (আইভি) প্রবেশ করানো হয় এবং সেটা একবারই মাত্র। কারণ জিন রূপান্তরিত ইমিউন কোষ বেঁচে থাকে এবং বিভাজনের মধ্য দিয়ে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলে। তাই এই চিকিৎসা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এবং চিকিৎসকরা আশা করেন যে সম্ভবত আজীবন কাজ করে থাকে। ভ্যাকসিন যেমন দেহকে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের হাত থেকে আজীবন সুরক্ষা যোগানোর মতো ইমিউন সেল তৈরি করতে সাহায্য করে এও ঠিক তাই। তথাপি কার টি৯ থেরাপিকে ভ্যাকসিনেশন বলা যায় না। কারণ এখানে চিকিৎসাটা জিন প্রকৌশলভিত্তিক। প্রথম দিকে জুন এই থেরাপি ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করে বিস্ময়কর ফল পান। টিউমার ছোট হয়ে আসে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারেই দূর হয়ে যায়। কিন্তু মানবদেহে প্রয়োগের বেলায় নানা ধরনের বাধা আসে। এমনকি আর্থিক বাধাও সে কারণে এই থেরাপি কার্যক্রম বন্ধও করে দেয়া হয়। দু’বছর পর লিউকেমিয়া ও লিম্ফোমা সোসাইটি ও অন্যদের অর্থায়নে জুন প্রথম এই থেরাপি মানব রোগীর ওপর প্রয়োগের সুযোগ পান। প্রথম রোগীটি ছিল ‘বিল লুডভিগ’ তার অবস্থা বেশ সঙ্কটাপন্ন ছিল। কেমোথেরাপিতেও আর তেমন কাজ দিচ্ছিল না। এ অবস্থায় তিনি পরীক্ষামূলকভাবে কার টি৯ থেরাপি গ্রহণে রাজি হন। থেরাপি নেয়ার পর তার কঠিন জ্বর হয়, শ্বাসকষ্ট হয়, কিডনি বিকল হওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। তাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। লুডভিগ ধরে নেন নতুন চিকিৎসায় কাজ হচ্ছে না। সবাই তার মৃত্যু অবধারিত হিসেবে ধরে নেয়। কিন্তু সবকিছু শেষ হওয়ার বদলে দেখা গেল তার পরিবর্তিত ইমিউন সেল দারুণভাবে কাজ করছে। রক্তের মধ্যকার ক্যান্সার কোষ ধ্বংস হয়ে চলেছে। তখনও পর্যন্ত ডাক্তাররা তা বুঝতে পারেননি। ৬ সপ্তাহ পর ডউগ অরসন নামে আরেক রোগীকে এই থেরাপি দেয়ার পর তারও যখন একই রকমের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিল তখন ডাক্তাররা বুঝলেন থেরাপি কাজ করছে এবং এগুলোই তার লক্ষণ। একই সময় বিপুল পরিমাণ ক্যান্সার কোষ মেরে ফেলার কারণেই শরীরে এমন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। পরীক্ষা সফল হলো। লুডভিগ ও অরসন দু’জনে আজ ৭ বছর ধরে বেঁচে আছেন এবং সুস্থ আছেন। কিছুদিন আগে একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া রোগী ৫ বছরের শিশু কাইটলিনের শরীরেও এই থেরাপ প্রয়োগে সাফল্য এসেছে। মাঝখানে এই ৭টি বছর কার টি সেল থেরাপি নিয়ে আরও গবেষণা এবং এর উৎকর্ষ সাধন করা হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে থেরাপিটি যথেষ্ট ব্যয়বহুল। বেশ কয়েক লাখ ডলার লেগে যায়। থেরাপিটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদন পাওয়া গেলে নোভারটিস কোম্পানি চলতি বছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫টি ক্যান্সার কেন্দ্রে এই থেরাপি পৌঁছে দেবে। অন্যান্য কোম্পানিও টি সেল চিকিৎসা সর্বজনীন করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। সূত্র : টাইমস
×