ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ,মাথাপিছু আয়, বৃদ্ধি এসডিজি অর্জন

সরকারের তিন সাফল্যে বিশেষ ভূমিকা রাখছে নারী শিক্ষা

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সরকারের তিন সাফল্যে বিশেষ ভূমিকা রাখছে নারী শিক্ষা

সমুদ্র হক ॥ সরকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে, মাথাপিছু আয় বাড়াতে এবং জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্জনে নারীশিক্ষা অন্যতম ভূমিকা পালন করছে। নারীশিক্ষার সঙ্গে দেরিতে বিয়ে এবং সন্তান গ্রহণের হার সরাসরি সম্পর্কিত। দেশে নারীশিক্ষার হার বেড়েছে। তবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত যতটা বেড়েছে উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে ততটা এগোয়নি নারী। যে কারণে নারীর এগিয়ে যাওয়া এখনও কাক্সিক্ষত হার পর্যন্ত পৌঁছেনি। তবে আশা করা হয়েছে, এ হার ২০২১ সালের মধ্যে অনেকদূর এগিয়ে যাবে। দেশে প্রতি মিনিটে গড়ে চারজন, প্রতিদিন অন্তত পাঁচ হাজার ৪৭৯ জন এবং প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ। ২০৫০ সালে জনসংখ্যা বেড়ে ২২৬ মিলিয়নে ঠেকবে। এরপর এ হার কমে আসবে। আগামী শতকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে বিংশ শতকের সত্তর দশকের পর্যায়ে নেমে আসবে। একজন বিশেষজ্ঞ উদাহারণ দিয়ে বরলেন, আমাদের পূর্বসূরিদের প্রতি দম্পতির সন্তান সংখ্যা পাঁচ থেকে অন্তত ১০ জন (কখনও এর চেয়ে বেশি) ছিল। বর্তমানের সেøাগান দুই সন্তান যথেষ্ট, একটি থাকলে আরেকটি নয় অথবা বিলম্বে। হিসাব কষে দেখা যাচ্ছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম প্রজন্মের পর জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে কমতে শুরু করবে। এদিকে বাল্যবিয়ে এখনও সম্পূর্ণ প্রতিরোধ না হওয়ায় অনেক বালিকাবধূ হওয়ার পরবর্তী বছরেই মা হচ্ছে। দেশে ১০ থেকে ১৯ বছরের কিশোর-কিশোরী বা বালিকার হার ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। ১৫ থেকে ২৪ বছর পর্যন্ত যৌবনপ্রাপ্ত বা তরুণ-তরুণীর হার প্রায় ২০ শতাংশ। দেখা যায়, দেশে মোট জনসংখ্যার অন্তত ৩৪ শতাংশ কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী। এদের বিয়ের হার যত বেশি, সন্তান জন্মের হারও তত বেশি। আবার দেশে প্রজনন হার ১৯৭০ সালের তুলনায় কমেছে। আরেকদিকে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার এখনও আশাব্যঞ্জক নয়। এ হার এখনও ৬২ দশমিক ৪ শতাংশ। হতাশার এ চিত্রের সঙ্গে আশার চিত্র হলো, অধিক শিক্ষিত নারীরা দেরিতে বিয়ে করে কম সন্তান নিচ্ছে। ‘ফাইভ বেনিফিটস অব গার্লস সেকেন্ডারি এডুকেশন’ নামের এক গবেষণায় মে মাসে রায়হানী দেখিয়েছেন, মাধ্যমিক শিক্ষা লাভের মাধ্যমে নারী পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবদান রাখতে পারে। মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং সহজলভ্য হওয়ায় প্রাথমিকের পর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। প্রাথমিক স্কুলে মেয়েদের তালিকাভুক্তি বেড়েছে। মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা দ্বারা পুরো সমাজ উপকৃত হয়। মাধ্যমিক শিক্ষা মেয়েদের স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করে যেমন- দেরিতে বিয়ে এবং দেরিতে গর্ভধারণ, কম সন্তান গ্রহণ, শিশু টিকার হার বাড়ানো, উন্নত পারিবারিক পুষ্টি ও কম পারিবারিক নির্যাতন। মাধ্যমিক শিক্ষা মেয়েদের এইচআইভি ও এইডস থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা, বিলম্বে যৌনক্রিয়া শুরু এবং এইচআইভির ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে। নারীদের মাধ্যমিক শিক্ষার পর উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে নিয়ে গেলে দেশে একদিকে বাল্যবিয়ে, আরেকদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে আসবে এবং তা দ্রুত। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশে এখনও ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে। এ কারণে উচ্চ শিক্ষার আগেই তারা ঝরে পড়ে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইজ) রিপোর্টে দেখা যায়, প্রাথমিকে দেশে যত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে তার ৫০ শতাংশ মেয়েশিশু। মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীর সংখ্যা ৫৩ শতাংশ, যেখানে ছাত্র ৪৭ শতাংশ। কলেজপর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর ৪৭ শতাংশ ছাত্রী। এরপর উচ্চ শিক্ষায় গিয়ে মেয়েদের হার কমে ৩৩ শতাংশে নেমে আসে। উচ্চ শিক্ষায় মেয়েদের হার বাড়ানো গেলে এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমবে। ইতোমধ্যে দেশে সরকারী চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে নারীদের উচ শিক্ষামুখী করে তুলতে পারলে চাকরি পেয়ে জাতীয় মাথাপিছু আয়ও বাড়বে। আরেকদিকে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলে (এসডিজি) নারী উন্নয়নে নির্ধারিত সময়ের আগে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে। মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে একটি কথা সংযোজিত হয়েছে তা হলো, মেয়েরা শিক্ষিত হলে দারিদ্র্য মোচন সহজ হয়। একই সঙ্গে নারী শিক্ষার হার বাড়লে জাতীয় মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়। দেশের আট বিভাগের মধ্যে কম বয়সে মা হওয়ার প্রবণতা বেশি রাজশাহী বিভাগে ও সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে। একটা সময় দেশের উত্তরাঞ্চলে (বর্তমানে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ) বালিকা বধূর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে তা কমেছে। যদিও এখনও আশাব্যঞ্জক অবস্থানে যায়নি। এখনও বগুড়ার পশ্চিমাংশ এবং উত্তরের কয়েকটি জেলার মধ্যে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র-যমুনার চরাঞ্চলে বাল্যবিয়ের হার বেশি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে মেয়ে শিক্ষার্থীর বিয়ে হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন জোর করেই তাদের পুত্রবধূকে সন্তান নিতে বাধ্য করে। অনেক সময়ই সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মা অথবা সন্তানের (কখনও উভয়েরই) মৃত্যু ঘটে। একই কারণে দেশে মা ও শিশুমৃত্যুর হার এখনও সহনীয় পর্যায়ে আসেনি। এক জরিপে দেখা গেছে, ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সে সন্তান জন্মদানকারী মায়েদের তুলনায় ২০ বছরের কম বয়সে সন্তান জন্মদানকারী মায়েরা বেশি মৃত শিশু জন্ম দেন এবং নানাভাবে শিশুর মৃত্যু ঘটে। দেশে প্রতি তিনজন কিশোরীর একজন (৩২ দশমিক ৭ শতাংশ) ১৯ বছরের মধ্যে মা বা গর্ভবতী হচ্ছে। ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের কিশোরীদের এক-তৃতীয়াংশ এবং ১৮ থেকে ১৯ বছর বয়সের তিন-চতুর্থাংশ কিশোরী সন্তান ধারণ শুরু করে। প্রত্যন্ত গ্রামে সামাজিক নিরাপত্তার অভাবের কারণে অনেক বাবা-মা বালিকা বেলাতেই মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন।
×