ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সহজ ম্যাচ কঠিন করে ফেলল মুশফিকরা

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩০ আগস্ট ২০১৭

সহজ ম্যাচ কঠিন করে ফেলল মুশফিকরা

মিথুন আশরাফ ॥ মিরপুর টেস্টে দুই দিন দাপট দেখাল বাংলাদেশ। একদিনেই খেলার মোড় ঘুরে গেল। যেখানে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল ছিল, সেখানে উল্টো এখন হারের শঙ্কা জেগে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার জিততে আর ১৫৬ রান দরকার। হাতে আছে দুইদিন ও ৮ উইকেট। ব্যাট হাতে অস্ট্রেলিয়ার এ মুহূর্তের সেরা দুই ব্যাটসম্যান ওয়ানার (৭৫*) ও স্মিথ (২৫*) এখনও আছেন। যে ব্যাটিং মঙ্গলবার শেষ সেশনে দেখাল অসিরা, তা যদি আজও বজায় থাকে, তাহলে ম্যাচ বাংলাদেশের হাত থেকে ছুটে যাবে। ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ যে এখন পুরোপুরি অস্ট্রেলিয়ার হাতে চলে গেছে। আজই যে ম্যাচ শেষ হবে, তা নিশ্চিত। তবে বাংলাদেশের জয়ের আশাও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। অসিদের হাতে থাকা ৮ উইকেট টপাটপ নিতে পারলেই তো হলো। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং খুব ভাল করেনি। ৩০০ রান করার সম্ভাবনা থেকে ২৬০ রান করেছে। দ্বিতীয় ইনিংসেও একই ধারা বজায় থেকেছে। তামিম যদিও ৭৮ রান করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু লিয়নের স্পিন ঘূর্ণির সামনে পড়ে শেষপর্যন্ত সাকিব, মুশফিকদের ব্যাটিং ব্যর্থতায় ২২১ রানের বেশি করা যায়নি। অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ২১৭ রান করায় ২৬৫ রানের টার্গেট দাঁড় হয়। এই রান করতে গিয়ে তৃতীয় দিন শেষে ২ উইকেট হারিয়ে ১০৯ রান করেছে অস্ট্রেলিয়া। এখন বাংলাদেশের সামনে ম্যাচ জিততে একটি পথই খোলা আছে। অসিদের ৮ উইকেট টার্গেট অতিক্রম করার আগেই তুলে নিতে হবে। সেই সম্ভাবনা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। চতুর্থ দিনের উইকেট থাকবে। স্পিনও ধরবে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সবশেষ মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে হওয়া টেস্টে ২৭৩ রানের টার্গেট দিয়েও জিতেছিল বাংলাদেশ। ইংলিশরা বিনা উইকেটে ১০০ রানও করে ফেলেছিল। কিন্তু এক সেশনেই ১০ উইকেট শিকার করে নিয়েছিল বাংলাদেশ স্পিনাররা। এরপর আর ৬৪ রানের বেশি করতে পারেনি ইংল্যান্ড। যদি এইরকম একটি সেশনের দেখা মিলে, তাহলে বাংলাদেশের জেতার সম্ভাবনাও থাকছে। টার্গেট খুব বড় নয়, ২৬৫ রান। অস্ট্রেলিয়ানদের হাতে থাকে ১০ উইকেট ও আড়াইদিনের একটু কম দিন থাকে। শুরু থেকেই তাই ধীরে ধীরে খেলতে থাকেন অস্ট্রেলিয়ান দুই ওপেনার ওয়ানার ও রেনশ। কিন্তু সেই ধীর চল নীতিতেও কাজ হয়নি। ২৭ রান হতেই উইকেট পড়া শুরু হয়ে যায়। রেনশকে মিরাজ আউট করার পর খাজাকে সাকিব আউট করে দেন। ১৯ রানেই অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উইকেট হারাত অসিরা। ওয়ানার আউট হতে পারতেন। কিন্তু সাকিবের করা বলে ওয়ানারের ব্যাট ঘেঁষে প্রথম সিøপে যাওয়া বলটি দেখে ভয় পেয়ে যান সৌম্য। তাতে ক্যাচও মিস হয়ে যায়। বাউন্ডারিও হয়। স্মিথও আউট হওয়ার সম্ভাবনাতেই ছিলেন। ব্যাট হাতে নেমেই একবার ইমরুলের হাত থেকে ক্যাচ আউট হওয়া থেকে বাঁচেন। আরেকবার মিরাজের বলে স্ট্যাম্পিং হয়েছেন মনে করে ড্রেসিংরুমের দিকে হাঁটাও শুরু করেন। মাঝপথে গিয়ে ড্রেসিংরুম থেকে ইশারা পেয়ে থামেন। থার্ড আম্পায়ারও রিপ্লে দেখে নটআউট দেন। ওয়ানার ও স্মিথ যেন ‘নতুন জীবনই পেয়ে যান। এ দুই ব্যাটসম্যানের জুটিকে দ্রুত থামানো জরুরী। না হলে বিপদ আসতে পারে। কিন্তু তাদের থামানোই গেল না। ‘নতুন জীবন’ পেয়ে যেন তাতিয়ে উঠলেন তারা। এমন ব্যাটসম্যানদের সুযোগ দেয়া মানে ম্যাচ হাত থেকে ফসকে যাওয়া। যেন সেই চিত্রই ফুটে উঠছে। ওয়ানার ও স্মিথ মিলে ৮১ রানের জুটি গড়ে দিনটিও শেষ করেছেন। বাংলাদেশ যদি ৩০০ রানের টার্গেট দিতে পারত, তাহলে তৃতীয় দিনেও বাংলাদেশের হাতেই ম্যাচটি থাকত। কিন্তু সকালের শুরুতেই তাইজুল ইসলামের আউটের পর ইমরুলও ব্যর্থ হলেন। এরপরও মুশফিকুর রহীমকে সঙ্গে নিয়ে দুদান্তভাবেই এগিয়ে চলতে থাকলেন তামিম। নিজে হাফসেঞ্চুরিও করে ফেললেন। ৫০তম টেস্টের দুই ইনিংসেই হাফসেঞ্চুরি করলেন তামিম। প্রথম ইনিংসে ৭১ রানের ইনিংস খেলার পর দ্বিতীয় ইনিংসে সেই রানকেও পেছনে ফেললেন বাংলাদেশ ওপেনার। একদিকে তামিম বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকেন। আরেকদিকে মুশফিক উইকেট আঁকড়ে থাকেন। সুযোগ বুঝে তিনিও ছক্কা-চার হাঁকান। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম ছক্কাটিই হাঁকান মুশফিক। দুইজন মিলে অস্ট্রেলিয়ার বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন। ১০০ রানের লিড আগেই হয়ে যায়। তামিম-মুশফিক মিলে সেই লিডকে আরও অনেকদূর নিয়ে যান। মধ্যাহ্ন বিরতিতে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে ১৩৩ রান যোগ হয়ে যায়। মধ্যাহ্ন বিরতি আগেই লিড হয়ে যায় ১৭৬ রান। যেভাবে উইকেটে ব্যাট করার সুবিধা মিলে, সেই সুবিধা পুরোপুরি নেন তামিম ও মুশফিক। তাতে করে বাংলাদেশও বড় রানের লিড নেয়ার আশা জাগে। যত বড় লিড হবে, তত বড় টার্গেট দাঁড়াবে। যে টার্গেট অতিক্রম করা অস্ট্রেলিয়ার জন্য কঠিনই। সবার ভেতরে এমন যখন ভাবনা চলছে, মধ্যাহ্ন বিরতির পর খেলতে নেমেই আউট হয়ে যান তামিম। কামিন্সের বলটি লাফিয়ে উঠেছিল। তামিমের গ্লাভস আর শরীরের উপরিভাগের মাঝখান দিয়ে বল উইকেটরক্ষক ওয়েডের হাতে যায়। আপীল হয়। কিন্তু আম্পায়ার আউট দেন না। স্মিথ রিভিউ নেন। তাতেই কাজ হয়ে যায়। গ্লাভসে হালকা ছোঁয়া লেগে যায়। মধ্যাহ্ন বিরতিতে যাওয়ার আগে ৭৬ রানে ছিলেন তামিম। সেঞ্চুরি করবেন। সেই আশায় সবাই ছিল। কিন্তু আর ২ রান যোগ করেই সাজঘরে ফেরেন। তামিম ও মুশফিকের জুটিটি দুদান্তভাবে এগিয়ে চলছিল। ৬৮ রানেই জুটিটি থেমে গেল। লাঞ্চের পর যেন সব ওলট পালট হয়ে যেতে শুরু করে। সাকিব ব্যাট হাতে নেমে লিয়নের ছুড়ে দেয়া লেগ সাইডের বলটিকে কাভারে বানিয়ে খেলতে চান। কিন্তু মাত্র ৫ রান করেই কামিন্সের হাতে ধরা পড়েন। লাঞ্চের পর ৪ ওভারেই তামিম, সাকিবকে হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় বাংলাদেশ। ১৪৩ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে যেন বাংলাদেশ উল্টো বিপত্তির রেখা দেখতে শুরু করে দেয়। তখনও ২০০ রানের লিডও হয়নি। অবশ্য মুশফিক, সাব্বির, নাসির, মিরাজ থাকায় ভরসাও থাকে। একটি বড় জুটিইতো বাংলাদেশকে ৩০০ রানের কাছাকাছি অনায়াসে নিয়ে যেতে পারে। মুশফিক ও সাব্বির মিলে সেইদিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দুইজনের জুটি যখন ৪৩ রানে যায়, দলও ১৮৬ রানে পৌঁছায়, লিডও ২০০ রান পেরিয়ে ২২৯ রানে যায়, তখন অহেতুক রান আউট হয়ে যান মুশফিক (৪১)। লিয়নের বলে সাব্বির ব্যাট চালান। বলটি স্ট্যাম্প বরাবর যায়। লিয়নের হাতে বলে ছোঁয়া লেগে স্ট্যাম্পের বেলস পড়ে যায়। মুশফিক লাইন থেকে একটু এগিয়ে থাকেন। লিয়নের হাতে বল লেগে স্ট্যাম্পে যাচ্ছে, তা দেখেও লাইনে ব্যাট রাখার চেষ্টা করেননি। শুধু দেখতেই থাকেন। দেখতে দেখতেই আউট হয়ে যান মুশফিক। এরপর ব্যাট হাতে নামেন, আর মুহূর্তেই সাজঘরে ফেরেন নাসিরও। ৭ উইকেট হারিয়ে পুরোপুরি বিপদে পড়ে যায় বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ান বোলাররাও চাপ তৈরি করতে থাকেন। সেই চাপ নিতে পারেননি সাব্বিরও (২২)। ১৮৬ রানেই ৩টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। মধ্যাহ্ন বিরতির পর উইকেটে বল বেশ ভাল টান নেয়া শুরু করে। সেই টানে লিয়ন ও এ্যাগার যেন বিধ্বংসী হয়ে ধরা দেন। যেখানে তৃতীয় দিন মধ্যাহ্ন বিরতির আগে ৩ উইকেট হারিয়েছিল বাংলাদেশ, সেখানে পরের সেশনেই ৫ উইকেট হারিয়ে বসে। ৭২ রানও যোগ করে। লিড দাঁড়ায় ২৪৮ রানের। তখনই সবার ভেতর আতঙ্ক ঢুকে যায়। যদিও মিরাজ ও শফিউল মিলে দারুণ ব্যাটিং করছিলেন। কিন্তু ৩০০ রানও যদি টার্গেট না দেয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশেরই বিপদ এসে পড়তে পারে। তা নিয়েই যত আলোচনা চলে। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ধসে গেছে। দ্বিতীয় ইনিংসেও যে সেইরকমই হবে, তার তো কোন ভরসা নেই। এমন ভাবনা যখন চলছে, তখনই শফিউল আউট হয়ে গেলেন। শফিউলকে আউট করে লিয়নও ৫ উইকেট শিকার করে নেন। আরেকটু এগিয়ে যেতেই মিরাজও (২৬) লিয়নের বলেই অহেতুক শট খেলতে গিয়ে আউট হয়ে সাজঘরে ফিরলেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশও ২২১ রানে অলআউট হয়ে গেল। শেষ ৩৫ রানেই ৫ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ২৬৪ রানে এগিয়েও থাকল। কিন্তু এই এগিয়ে থাকা কী আর জয়ের নিশ্চয়তা দিচ্ছে? তৃতীয় দিন শেষেই বোঝা যাচ্ছে, সেই নিশ্চয়তা এখন নেই। উল্টো হারের শঙ্কাতেই পড়ে গেছে বাংলাদেশ।
×