ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৫২ শতাংশের বেশি স্কুল শিক্ষক এখনও সৃজনশীল বোঝেন না

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ৩০ আগস্ট ২০১৭

৫২ শতাংশের বেশি স্কুল শিক্ষক এখনও সৃজনশীল বোঝেন না

বিভাষ বাড়ৈ ॥ শিক্ষকের অভাবসহ নানা সঙ্কটের কারণে খোদ সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি পড়েছে প্রশ্নের মুখে। পাবলিক পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নের ব্যবহার নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অসন্তোষের মধ্যেই সরকারী গবেষণা প্রতিবেদনে বেড়িয়ে আসল সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরিতে শিক্ষকদের অযোগ্যতার উদ্বেগজনক চিত্র। এ বিষয়ে এতদিন বিভিন্ন মহল উদ্বেগ প্রকাশ করলেও শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাতে সাড়া মিলেছে কমই। তবে এবার খোদ সরকারী গবেষণা প্রতিবেদনই বলছে, বিদ্যালয়ের ৫২ শতাংশেরও বেশি শিক্ষক এখনও সৃজনশীল বোঝেন না। যাদের মধ্যে প্রায় ৩৯ শতাংশ শিক্ষক অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্ন প্রণয়ন করছেন। সমিতি থেকেও প্রশ্ন সংগ্রহ করেন ২১ শতাংশেও বেশি শিক্ষক। শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ হয়। কিন্তু ১০ বছরের বেশি হয়ে গেলেও এ পদ্ধতির সঙ্গে অভ্যস্ত হতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। যেখানে এতদিনেও শিক্ষকরাই ঠিকভাবে সৃজনশীল প্রশ্ন বোঝেন না সেখানে এ বিষয়ে শিক্ষকদের দক্ষ না করে কেবল শিক্ষার্থীদের ওপর একের পর এক সৃজনশীল বিষয় চাপিয়ে দেয়া রীতিমতো অন্যায়। সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষকদের দক্ষতার অভাবেই অভিভাবকরা বাধ্য হচ্ছেন গৃহশিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের উপর নির্ভর করতে। এ জন্য ক্লাসরুমে পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবকে দায়ী করছে গবেষণা সংস্থাগুলোও। জানা গেছে, এসএসসি পরীক্ষায় দুই ঘণ্টা ৩০ মিনিটে ৭টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখতে হচ্ছে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষা থেকে। এতদিন যেখানে দুই ঘণ্টা ১০ মিনিটে ৬টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দেয়া নিয়েই ছিল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আপত্তি। প্রশ্নের সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও সেভাবে সময় না বাড়ায় রাজধানীর নামী দামী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বত্রই স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের মাঝে আছে অসন্তোষ। উদ্বেগ আছে অভিভাবকদের মাঝেও। ‘৭টি সৃজনশীল মানব না’ ‘৬টির বেশি লিখব না’ ‘আমরা মানুষ, রোবট নই’ নিত্যনতুন পদ্ধতি করে আমাদের ক্ষতি করবেন না’ এমন সব সেøাগান নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার আগেই দাবি পূরনের জন্য আন্দোলন চলাকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ড কর্মকর্তাদের ‘কৌশলী’ বক্তব্য বিবৃতিতে আন্দোলন স্থগিত করে শিক্ষার্থীরা। কর্মকর্তারা বলেন, যেহেতু অবজেকটিভ প্রশ্ন ১০টি কমেছে তাই সময় নিয়ে আপত্তি থাকার কথা না। কিন্তু এবার আবারও একই আপত্তি শিক্ষার্থীদের। হয় প্রশ্ন আগের মতো ৬টি হোক না হয় একটি প্রশ্নের জন্য আরও সময় বাড়ানো হোক। অভিভাবকরা দিনের পর দিন অভিযোগ করছেন, সৃজনশীল বিষয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা যথাযথ শিক্ষা দিতে পারছেন না। অথচ একের পর এক বিষয়ে সৃজনশীলের নামে নতুন পদ্ধতি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষকের অদক্ষতা অভাবে শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে বহুদিন ধরে বলে আসছেন অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা। যদিও সেভাবে সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ হচ্ছে না বলেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সৃজনশীল নিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বেগের কারণ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে ‘রিসার্চ ফর এ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন’ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনেও। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীসহ সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে এখনও অভ্যস্ত হতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। তাই অভিভাবকরা বাধ্য হচ্ছেন গৃহশিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের উপর নির্ভর করতে। এ জন্য ক্লাসরুমে পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবকে দায়ী করছেন শিক্ষাবিদরা। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ হয়। পাশাপাশি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধেও ২০০৬ সালে মাধ্যমিকে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রচলন করা হয়। কিন্তু এতদিনেও এ পদ্ধতির সঙ্গে অভ্যস্ত হতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। গবেষণায় দেখা গেছে, সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝতে গাইড বইয়ের সাহায্য নেয় ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী। গৃহশিক্ষকের সহায়তা নেয় ৬৭ শতাংশ। আর, খোদ শিক্ষকরাই গাইড বইয়ের সহায়তা নেন ৪৭ শতাংশ। এদিকে সরকারী ও নিবন্ধনকৃত স্কুলের শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেলেও নতুন জাতীয়করণ করা ২৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এখনও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পাননি। তাই সঙ্কট দূর করা যাচ্ছে না। এদিকে কেবল বেসরকারী তথ্যই নয়, সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে সৃজনশীল নিয়ে সঙ্কটের চিত্রটি। যেখানে বলা হয়েছে, ৫২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ শিক্ষক এখনও সৃজনশীল বোঝেন না। এরমধ্যে ৩০ দশমিক ৮৯ শতাংশ শিক্ষক অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্ন প্রণয়ন করেন। তবে সবচেয়ে পিছিয়ে আছেন বরিশাল অঞ্চলের শিক্ষকরা। এই অঞ্চলের ৭৯ দশমিক ২৪ শতাংশ শিক্ষকই নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না। তার পর কুমিল্লা অঞ্চলের ৭২ দশমিক ৯২ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। দেশের ১৮ হাজার ৫৯৮টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৬ হাজার ৬৭৬ প্রতিষ্ঠান সুপারভিশন করা হয় বলে বলছে মাউশি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ঢাকা বিভাগের ৫২ দশমিক ৫১ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না। ময়মনসিংহ বিভাগের ৭৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ শিক্ষক, সিলেটে ২৮ দশমিক ১৪ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৫০ দশমিক ৯৪ শতাংশ, রংপুরে ৫০ দশমিক ৫২ শতাংশ, রাজশাহীতে ৪৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ, খুলনায় ৩৫ দশমিক ১২ শতাংশ, বরিশালে ৭৯ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং কুমিল্লায় ২৭ দশমিক ১৮ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না। ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের অভিভাবক আবিদা সুলতারা তার সন্তানের উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলছিলেন, একটি প্রশ্নে বলা হলো ‘বুড়িগঙ্গার কাছাকাছি অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনার তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।’ এ প্রশ্নের উত্তরে এক শিক্ষার্থী লালবাগ কেল্লার তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছে। কিন্তু শিক্ষক এটি কেটে দিয়েছেন। শিক্ষক দাবি করছেন, এর সঠিক উত্তর হিসেবে আহসান মঞ্জিলের বিবরণ দিতে হবে। ক্ষুব্ধ অভিভাবকের অভিযোগÑ এর উত্তর লালবাগ কেল্লা না হয়ে আহসান মঞ্জিল হবে তা বোঝার উপায় কী? কারণ বুড়িগঙ্গার তীরে এবং কাছাকাছি আরও অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে অসন্তোষ আছে। অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন, তারা প্রচ- মানসিক যন্ত্রণায় রয়েছেন সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে। সারাদিন সন্তান নিয়ে টেনশন করতে হচ্ছে। পাগলের মতো ছুটতে হচ্ছে কোচিং-প্রাইভেটে। অনেক শিক্ষকও ঠিকমতো বোঝেন না। অভিভাবকও বোঝেন না। আবার বইতেও কোন কিছু নেই। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা করবে কী? প্রয়োজনীয় বই ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ ছাড়া পঞ্চম শ্রেণীতে সৃজনশীল চালু করার সমালোচনা করে অভিভাবকরা বলেছেন, সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা হলেও পঞ্চম শ্রেণীর কোন বই সৃজনশীল ধারায় সেভাবে লেখা হয়নি। আগের পরীক্ষা পদ্ধতি অনুযায়ী লিখিত বইই পড়ানো হচ্ছে কিন্তু পরীক্ষা দিতে হচ্ছে অন্য পদ্ধতিতে। অভিভাবক ও শিক্ষকেরা জানান, বইয়ে যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক নমুনা প্রশ্ন দেয়া থাকত তাহলে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকেরা বই পড়ে কিছুটা ধারণা পেতে পারতেন। কিন্তু সে সুযোগ নেই। আর শিক্ষকদেরও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। ফলে শিক্ষক নিজের মতো করে ক্লাসে যতটুকু সম্ভব ধারণা দিচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে গণিত ও ইংরেজীতে। বিভিন্ন স্কুলের গণিতের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, গণিতে সৃজনশীলের ওপর তিনটি প্রশ্ন থাকছে পঞ্চম শ্রেণীতেই। কিন্তু বইয়ে সৃজনশীলের কোন নমুনা বা উদাহরণ নেই। বেশির ভাগ অভিভাবকই এটা বোঝেন না এবং শিক্ষার্থীরাও বোঝে না। গ্রামের অবস্থা আরও ভয়াবহ। অনেক শিক্ষকও বলছেন, সৃজনশীলের জন্য শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় আরও সময় দরকার। প্রতি বছর সৃজনশীল প্রশ্নের পরিমাণ বাড়ছে কিন্তু পরীক্ষার সময় বাড়ানো হচ্ছে না।
×