ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শরীফা খন্দকার

যাদবপুরের আমিনা এখন আমেরিকায়

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২৭ আগস্ট ২০১৭

যাদবপুরের আমিনা এখন আমেরিকায়

যাদবপুর গ্রামের চেনা দিনগুলোতে জীবনের সবটুকু বর্ণময়তা হারিয়ে আমিনা এসে দাঁড়িয়েছিলেন এক ধু-ধু জীবনের ধূসর সায়াহ্নে। সারা শরীরে তখন কত রকম যে রোগব্যাধির বাসা। দেহ ঘিরে রক্তচাপ, চিনি সবই ছিল অস্বাভাবিক রকম উঁচু। এর ওপর ছিল সারা শরীরে ব্যথা, জিভে ঘা এবং ছানির কারণে একটি চোখ প্রায় দৃষ্টিশক্তিহীন। এরই ওপর পুকুর পাড়ে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল পায়ের একটি হাড়। চুয়াডাঙ্গা হাসপাতালের নবীন ডাক্তার বলেছিল- ‘বুড়ো বয়সে হাড় ভেঙ্গে গেলে তো আর জোড়া লাগানো যায় না দাদিমা। কারণ তার জন্য ভাঙ্গা জায়গায় অপারেশন প্রয়োজন। কিন্তু আপনার এই বয়সে সেটা করা সম্ভব নয় যে।’ তাই ভাঙ্গা অস্থিটি কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি নানা হাবিজাবি চিকিৎসা করেও জোড়াবিহীন হয়েই ছিল। অন্য সব রোগের নানাবিধ ওষুধ দেয়া হয়েছিল বটে; কিন্তু কোনটাই ঠিক সুস্থ করতে পারছিল না আমিনাকে। অচল স্থবির হয়ে যেতে যেতে সবার কাছে জ্ঞান পেয়েছিলেন- পঁচাত্তর বছর বয়সে সে তো কম নয় গো, এবার শেষ পারানির ঘাটে ভিড়েছে তোমার জীবনতরী! কিন্তু বিধির বিধান বড় বিচিত্র। যাদবপুরের কুমারখালী নদীর তিরতির করা জলে যেটি চিরকালের তরে থমকে পড়ার কথা তার মোড়টি ভাগ্যবিধাতা অদ্ভুতভাবে ঘুরিয়ে দিলেন। ঝপাৎ করে তার জীর্ণ নৌকো পৌঁছে গেল সাতসমুদ্দুর তেরো নদীর পারে এক নতুন দেশে। আমেরিকান নাগরিক মেজ মেয়ে পারুল মায়ের এমন দশা দেখে ইমিগ্রেশন করিয়ে নিয়ে এলো তার কাছে। অথচ জীবনের লম্বা এক সময়জুড়ে আমিনা নামের মানুষটি আমেরিকা নামের দেশটির নামই শোনেননি। মেয়ে বলেছিল অনেক উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা আছে সে দেশে, দেখ সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি। তারপরেও প্রথম প্রথম সেই যাদবপুরের বদ্ধ জীবনের জন্যই যখন তখন শোকে-দুঃখে কাতর হতেন তিনি। নিজের দেশ গাঁ ভিটেমাটি ঘর গেরস্থালি আর নাতি-নাতনি সব মিলিয়ে আশ্চর্য এক মায়ার নাটাইয়ে বাঁধা ছিল সারা অস্তিত্ব। সব ফেলে আমিনা যেন কাটা ঘুড়ি হয়ে এলেন এই অজানা দেশে। প্রতিদিন- শুধু দিন কেন, রাতের ঘুমেও কুপির আগুনে মনটা পুড়ত যখন তখন। কিন্তু যেদিন তার সাক্ষাত হলো এক আশ্চর্য নীল চোখের ডাক্তারের সঙ্গে আর তার চিকিৎসায় বছরের মাথায় জিভের ঘা সারল, এজমাসহ উচ্চ রক্তচাপ এলো নিয়ন্ত্রণে তখন থেকেই যেন ষাট বছর ধরে বসবাস করা যাদবপুর গ্রাম বিস্মৃতির কুয়াশায় কখনও কখনও ঢেকে যেতে থাকে। পনেরো বছর বয়সে যে গ্রামে সংসার করতে এসেছিল মিনা নামের এক কিশোরী। নিউইয়র্কে এক হাসপাতাল অপারেশন করে জোড়া লাগালো ভাঙ্গা পাখানা। ছানি কাটানোর পর যখন চোখের আলো ফিরে এলো তখন তার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক হলেন আমিনা। এখনও এত সুন্দর তিনি! নাতনি দুটো অবশ্য সবসময় বলে সে কথা। -তুমি স্কিনে কি মাখতে নানি, এখনও এত সুন্দর, এত সফট? -সেই সময় গায়ে সর্ষের তেল ছাড়া কিছু কি ছিল নাকি রে? -যাহ্! তার কথা ওরা বিশ্বাসই করতে চায় না। হাঁড়ি হাঁড়ি ভাত রাধা শেষ করে মিনার বিকেল গড়িয়ে পড়ত পুকুর পাড়ে নাইতে যেতে। ক্লান্ত শরীরের রাত্রি-দিনের যত গ্লানি জলে ধুয়ে গা মোছার পর ছিল তো ঘানিতে মাড়া ওই সর্ষের তেল। আর খাওয়া? স্বামীর বাড়িতে গিয়ে ওই যে শুরু“হয়েছিল শাকপাতা খাওয়ার অভ্যাস- সেই থেকে শাকপাতাই তার প্রিয় খাদ্য। এদেশে কত সব রকমারি খাবার খেতে দেয় মেয়ে পারুল। সকালে দুধ, কর্নফ্লেক্স, দুটো ডিম, বড় এক গ্লাসে ফলের রস, পাউরুটি, মাখন, আরও কতকিছু। ঘণ্টা দুয়েক পর আবার দই ফল। দুপুরে ভাত মাছ, রাতে মুরগি। কিন্তু সেসব স্বাদের কাছে এর যেন তুলনা হয় না। এদেশের মুরগিতে যেন স্বাদ নেই, মাছেও এক আঁশটে গন্ধ। আমেরিকাতে এসে শাকান্ন রান্না হলে বড় তৃপ্তি করে খান আমিনা। তবে যেদিন বাড়িতে বাংলাদেশের স্বাদের ইলিশ কিনে আনা হয় সেদিন অবশ্য পাতে সাগ্রহে মাছ তুলে নেন আমিনা। গরমকালে মেয়ে পারুল নিজ হাতে যাকে ব্যাকইয়ার্ড বলে সেখানে লালশাক, ঝিঙে, বেগুন, লাউ, কত যে শাকসবজি বোনে। বিদেশের মাটিতে তার মেয়ের এসব কাজকর্ম এক অবাক কা-। যাদবপুরের বাড়িতে ছিল কাজের লোক মিলিয়ে চল্লিশের ওপর মানুষ। সকাল থেকে উনুনে প্রায় পনেরোটি ভাতের পাতিল ওঠানো আর নামানোর কাজটি ছিল আমিনার। অন্য বৌরা কাটত আনাজপাতি, পুকুর থেকে মাছ তোলা হলে মাছ। ওসব ওরাই রাঁধত। সূয্যি মাঝ আকাশে যাবার আগেই শুরু“হতো খাওয়া-দাওয়ার পাট। প্রথমে বাড়ির কর্তা নিজ ঘরের উঁচু বারান্দায় মাদুর বিছানো মেঝেতে খেতে বসতেন। তারপর বাড়ির সব পুরুষ মানুষ একদিকে, কাজের পুরুষরা অন্যদিকে। খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে কাপড়-চোপড় পরে ঘোড়া হাঁকিয়ে গৃহকর্তা ইয়াজউদ্দিন বেরিয়ে যেতেন গঞ্জে। সেই ক’টা দিন যেন ছিল আমিনার মুক্তির দিন। সবার খাওয়া শেষে হাঁড়িতে ছিন্নভিন্ন যা পড়ে থাকত দেখে রুচি থাকত না মিনার। নিজের জন্য চারটি ভাত চাপিয়ে দৌড়ে পুকুর পাড় থেকে তুলে আনতেন কলমি বা পুঁইলতা কিংবা পাড়তেন সজনে ফুল- এরকম সব জিনিস। জীবনে ওই কাজটাই ছিল কেবল মিনার নিজের জন্য, সংসারের জন্য নয়। কি যে সুবাস ছড়াত ভাত, শ্বাস টানলে সেই সুবাস এখনও যেন ভেসে আসে আমেরিকাতেও। এরপর তার স্নান সেরে খাওয়া, রান্নাঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়া। এ সময়টাতে বুকটা ফুলে উঠে চোখ ভিজে যেত মিনার। রাতে সবার খাওয়ার পাট শেষ হওয়ার আরও পরে যেদিন স্বামী ফিরতেন শোনা যেত ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ। দিগি¦দিক অন্ধকার করে পঞ্চদশীর সারা শরীরে তখন ঘোর অমাবস্যা। আরও রাতে মিনাকে নিতে আসতেন বিধবার বড় জা। ক্রন্দসীকে জড়িয়ে তিনি দাঁড়াতেন স্বামীর ঘরের দরজার এপারে। কিন্তু ভয়ে ত্রাসে মিনা তো পার হবে না তার চৌকাঠ। এক সময় রাগে মাতালের মতো বেরিয়ে আসতেন জলিলুদ্দিন। কোন কথা নয় পশ্চাদদেশে সরাসরি ছুড়তেন প্রচ- এক লাথি। মিনা উপুড় হয়ে ছিটকে পড়ত ঘরের মেঝেতে। কতদিন সকালে তার কপালে বাসি রক্তের দাগ দেখেছে বাড়ির লোকজন। এমনি করে চব্বিশ বছরের সংসারে একে একে এলো ৬টি সন্তান। এসব কথা খুব গল্প করতে ইচ্ছে হয় তার ডাক্তারের কাছে। কিন্তু আমিনা ইংরেজী জানেন না যে। আমেরিকায় এসে অবাক হয়ে দেখলেন নাতি-নাতনি, এমনকি নিজের মেয়ে পারুল অবধি কথা বলে ইংরেজীতে। বাড়ির কুকুরটা অবধি সে ভাষা ছাড়া কথা বোঝে না। কর্তার আবার কুকুর-বিড়াল পছন্দ ছিল না বলে ওরা ত্রিসীমানায় ভিড়তে পারেনি। আর এ বাড়িতে এক কুকুরের আহ্লাদীপনায় আমিনা হতবাক। যেটার নাম নাকি ন্যান্সি। যখন-তখন কোলে উঠছে, ঘাড়ে উঠছে। ওকে নাকি কোথা থেকে নাইয়ে আনতে হয় শ্যাম্পু দিয়ে। ওর চুল ছাঁটাতেই লাগে বাংলাদেশের টাকায় ৬ হাজার। ন্যান্সির জন্য নাকি ঘরে খাবার স্বাস্থ্যকর নয়। সে খায় কৌটোয় করে আনা দোকানের অন্যরকম খাদ্য। সে না হয় হলো, ন্যান্সির হাগা-মোতার যাগযজ্ঞ দেখলেই তো পিত্তি জ্বলে যায়। কি এক পেতে রাখা কাপড়ে ওসব করবে সে, আর জামাই বাড়ি ফিরে সেটা নিজ হাতে করে ফেলে দেবে বাইরের ময়লা ফেলার টিনে। এরপর আরও আছে যে! এমন বিরাট কাজকর্ম শেষ হলে ন্যান্সি তার নখপলিশ পরা দুই পায়ে দাঁড়িয়ে পড়বে পারুলের সামনে। যতক্ষণ না তাকে বলা হবে ‘গুড গার্ল’ ওভাবেই থেকে যাবে এমনি ঢঙ্গি সে। তারপর তাকে পুরস্কার দিতে হবে বিস্কিটের মতো এক খাবার, যার নাম ট্রিট। হঠাৎ করে কখনও মেয়ে কুকুর ন্যান্সির সঙ্গে নিজের ফেলে আসা তরুণী বয়েসের কথা তুলনা করলে বড় বিষণœ বোধ করেন আমিনা। এখনও তার মনে পষ্ট গাঁথা আছে জীবনের প্রথমদিন গ্রামের পাঠশালা আর মাস্টারদের হাতের লকলকে বেতের কথা। ক্লাসের পড়ুয়াদের কোন ভুল কিংবা অমনোযোগের কারণে সেটা পড়ছে ছাত্রছাত্রীদের পিঠে সপাংসপাং। শিশু মিনার কলজে শুকিয়ে গিয়েছিল ত্রাসে, ভয়ে। তারপর সবার অলক্ষ্যে পেছনের বেতের বন পেরিয়ে সেই যে পালিয়েছিলেন নিজেদের বাড়ি। বাপমরা মেয়েটিকে পাঠশালামুখো করা যায়নি আর কোনদিন। এই আমেরিকায় বসবাস করতে গিয়ে আমিনা এখন ভাবেন পাঠশালায় বেত খেয়েও সে সময় লেখাপড়াটা হলে হয়ত ভাল হতো। নইলে দশ বছরের বালিকা তামির চল্লিশ বছরের বিপতœীক মানুষের সঙ্গে নাকি চাচাদের আদেশে বিয়ে দিত মা! মা আর গাঁয়ের মানুষ সবাই যাকে আদর করে মিনা ডাকত, ১১ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল সেই পিতৃহারা মেয়ের। বৌমরা তিন সন্তানের পিতা পাত্র ইয়াজউদ্দিন সে সময় যাদবপুরের মস্ত ধনী মানুষ। যদিও বয়স চল্লিশের ওপরে; কিন্তু চাচারা বললেন- পুরুষের জন্য ওটা তো উঠতি যুবকের বয়স। বিয়ের পর স্বামী যখন মিনাদের বাড়িতে আসতেন তখন সে ভয়ে, ত্রাসে গিয়ে লুকাত খেলার সাথীদের বাড়ি। তবে পনেরো বছর বয়সে পা রাখতেই খবর এলো তখন নাকি তার সময় হয়েছে সংসার করার। পালকিতে করে নিজ গ্রাম, মা, সখীর দল ছেড়ে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছিল যাদবপুর নামের অচেনা এক গ্রামে। তেতাল্লিশ বছর বয়সের বিপতœীক তিন সন্তানের পিতা স্বামী জলিলুদ্দিন পাশে পাশে যাচ্ছিলেন তার নিজ ঘোড়া টগবগিয়ে। মিনা শুনেছিল স্বামী লোকটি যেমন ডাকসাইটে তেমনি রাগী। ঘোড়ার ক্ষুরের টগবগ শব্দে প্রাণটা ছটফট করছিল ঝড়ের পাখির মতো। ইয়াজউদ্দিনের বিশাল বাড়িতে সবচেয়ে কম বয়সের মানুষ হয়ে এলো নতুন বৌ আমিনা। স্বামীর মৃত স্ত্রীর সন্তানরা সকলেই ছিল আমিনার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে ছেলেপুলের মা। নিউইয়র্কে চিকিৎসার কাগজপত্রাদির কাজ শেষ হলে প্রথমেই তাকে নিয়ে যাওয়া হলো সত্যিকার এক ইংরেজ চিকিৎসকের কাছে। কি সুপুরুষ, দেখে চোখ যেন ফেরানো যায় না। বাসায় ফিরে এসব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেই আমেরিকান নাতনিরা খুব আমোদ পাচ্ছিল যেন হেসেই গড়াগড়ি। ‘তা এতে হাসির হলোটা কি বাপু! ধরুক না হয় চুলে কিছু পাক, তাই বলে সুন্দর মানুষকে সুন্দর বলা যাবে না এ কেমন কথা বাপু।’ আমিনা রাগ করেছিলেন। প্রায়ই তাকে যেতে হয় ডাক্তারের কাছে। শুধু কি রূপ! তার কাছেই তিনি যেন দেখলেন পুরুষের অন্যরকম হৃদয়। কি নরম করে হাত ধরে যেন ভালবেসে বলেন ‘হাউ আর ইউ আমিনা!’ কখনও তিনি কি কল্পনা করেছিলেন এমন করে নাম ধরে এ জীবনে কেউ ডাকবে, তিনি যখন কাউকে দেখেন কেমন যেন ধুকপুক করে আমিনা নয়, মিনার হৃদয়। সেদিন তিনি তার কেয়ারার মেয়েটিকে নিয়ে হাঁটছিলেন রাস্তার পাশের সাইড ওয়াক ধরে। প্রতিদিন বিকেলে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে হাঁটেন বেশ কিছুক্ষণ। যে ডাক্তার তাকে প্রায় মরণের পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছে, তার জীবনদাতা, তার কথা তাকে মানতেই হয়। শুধু মানা নয়, শয়নের এবং স্বপনের বেশিরভাগ সময়জুড়ে কেন যে ঘুরেফিরে আসে ডাক্তার! ইদানীং হাঁটবার সময়টিতেও সে ভাসে চোখের ওপর। -দেখ তো ওই লাল বাড়িটা কি আমার ডাক্তারের? সামনের বাগানে তাকে দেখছি যেন! -না খালাম্মা, উনি অন্য লোক। আর এ পাড়ায় তো ওনার বাড়ি নয়। -ও! -আচ্ছা দেখ তো ওই যে গাড়িটা থামল ওখানে ওটা কি ডাক্তারের গাড়ি! মেয়েটি এবার কি বুঝে বলে- হতেও পারে নাও পারে। কোটি কোটি গাড়ি এদেশে। কেয়ারার মেয়েটি বাঙালী। ইদানীং সরকার থেকে অসুস্থ বুড়ো-বুড়িদের দেখাশোনার জন্য বাঙালী মেয়েও পাওয়া যায়। অবশ্য ইদানীং সে তাকে খালাম্মা ডাকলে আমিনা অসন্তুষ্ট হন। কথা বোঝেন না বলে এর আগে অনেকগুলো ইংরেজী কইয়েদের বাদ দিয়ে দিয়েছেন। মাস দুয়েক হলো বাঙালী মেয়েটি আছে। তাকে তিনি চুপিচুপি বলেন- দেখ আমাকে তুমি দাদি বলবে না, আপা বলেই ডাকবে। নতুন করে হাঁটাহাঁটি শেখার পর দুই আমেরিকা প্রবাসী সুন্দরী নাতনি বেড়াতে নিয়ে এলো কনি আইল্যান্ডের সমুদ্র পাড়ে। গাঁয়ের আকাশের নীল সে তো ছিল আজন্ম চেনা, চেনেন নদীর পানিও। যাদবপুরে শুধু একটা নয় নদী ছিল দু-দুটোÑকুমারখালী আর অন্যটার নাম মাথাভাঙ্গা। ওই নদীগুলোতেই নিশুতি রাতে নৌকা বাইতে বাইতে মাঝিরা গান ধরত ‘নদীর কূল নাই কিনার নাই গো। ...’ কিন্তু আটলান্টিকের বিশাল জলরাশির সামনে আমিনা যখন প্রথম দাঁড়ালেন সেদিন চোখ দুটো যেন বিস্ময়ে বিপন্ন এক তরুণীর। আমেরিকার নিউইয়র্কে এ কোন্ অকূল দরিয়া এসে দাঁড়ালো সম্মুখে! ভরদুপুরে যার পানি আকাশের সঙ্গে মিলেমিশে দুনিয়াটাকে যেন নীলাভ করে দিয়েছে। এরকম আশ্চর্য নীল তিনি এদেশে এসে দেখেছেন তার ডাক্তারের চোখে। মনে হলো আকাশে যেন উড়ে বেড়াচ্ছে তারই চেনা সেই চোখ দুটো। হঠাৎ যেন বহুকাল আগে সখীদের সঙ্গে খেলার যুগের আমিনা বলে উঠল- কূলকিনারাহীন এ কেমন নদী গো- ঢেউয়ের নাচ দেখে চোখ কেবলি ধাঁধিয়ে যাচ্ছে! কিন্তু ভাসিয়ে নেয়া বিশাল বিশাল ঢেউ দেখে তার একটুও ভয় করছিল না। বড় নাতনি বলল- নদী নয় নানি, এটাকে বলে ওসান- আটলান্টিক মহাসমুদ্র যার নাম। সমুদ্রেরই খবর যার জানা ছিল না এবার তার কাছে এসে দাঁড়ালো মহাসমুদ্র! রূপকথার গল্পে সেই কোন্কালে শুনেছিলেন সমুদ্দুর পাড়ি দিয়ে রাজকুমার ছুটছে রাজকন্যার খোঁজে। পূর্ণিমায় পৌঁছানো মিনা নামের এক রাজকন্যাকে নিয়ে রূপকথার গল্প তৈরি করতে থাকেন আমিনা- যে পঞ্চদশী মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে নতুন দেশে এসেছে তার রাজপুত্রের সন্ধানে। হঠাৎ একদিন পারুলের সঙ্গে কেয়ারার নভেরার ফিসফিসে কথা কানে গেল আমিনার- আমি আমার বইতে পড়েছি আপা ওনার মতো বয়স হলে কারও কারও মাথা এমন উল্টাপাল্টা হয়! দেশে যাকে ভীমরতি বলে। নিজেকেই প্রশ্ন করেন আমিনা- তার কি সত্যি তাই হয়েছে? প্রবাসী লেখিকা sharifa.k@outlook .com
×