ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির এই চক্রান্ত অবশ্যই ঠেকানো দরকার

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২৫ আগস্ট ২০১৭

রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির এই চক্রান্ত অবশ্যই ঠেকানো দরকার

এখন আশা নিরাশায় দুলছি! প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তার অন্যতম উপদেষ্টা গহর রিজভী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাত করার পর মনে হয়েছিল ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কিত রায় নিয়ে বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে যে বিবাদ ও বিতর্ক চলছে তার সম্ভবত উপশম হবে। গত মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) মাননীয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আমারও টেলিফোনে আলাপ হয়েছে। তাকে বিনীতভাবে অনুরোধ করেছি এই বিবাদে দেশে একটি রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির সুযোগ যেন কেউ না পায়। তিনি বলেছেন- ‘এই সঙ্কট সৃষ্টি হতে আমি দেবো না’। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গহর রিজভী আমার সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব আমার কাছে ব্যাখ্যা করেছেন; সঙ্কট অবশ্যই কেটে যাবে! তিনি আরও বলেছেন- ‘আমার রায়টি আপনারা পড়ে দেখুন, তাহলেই দেখবেন জাতির পিতার কোন অবমাননা আমি করিনি। বরং জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কটু মন্তব্য করেছি’। আমি প্রধান বিচারপতিকে সবিনয়ে বলেছি- ‘রায় নয়, আপনার পর্যালোচনা সম্পর্কে বিতর্ক চলছে, এর সুযোগ নিচ্ছে গণবিরোধী মহল। এই পর্যালোচনা সম্পর্কে আপনার সুচিন্তিত পুনঃবিবেচনা চাই’। এই আলাপে আমার মনে আশা জাগ্রত হয়েছিল, দু’পক্ষের মধ্যেই একটা নমনীয় ভাব দেখা যাচ্ছে, হয়ত সহসা সঙ্কটের কালো মেঘ কেটে যাবে। কিন্তু প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলাপের একদিন না যেতেই অনলাইন নিউজপোর্টালে দেখলাম, প্রধান বিচারপতি বলেছেন- ‘দেশের জন্য প্রয়োজন হলে প্রাণ দেব, কিন্তু পিছপা হবো না’। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণœ রাখতে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন, যাতে বিচার বিভাগ চিরদিন তাকে মনে রাখে। তার সম্পূর্ণ বিবৃতিটিই আমি পাঠ করেছি। অনলাইনের এই খবরটি কতটা সঠিক তা আমি জানি না, তবে বিষয়টি নিয়ে উভয়পক্ষই যদি আর কথা না বাড়িয়ে একটা মীমাংসার দিকে এগুতেন, তাহলে দেশের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেন। প্রধান বিচারপতিকে সবিনয়ে জানাই- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় তিনি অবদান রাখুন এবং ইতিহাসে চিরজীবী হয়ে থাকুন, এই কামনা আমারও; কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। গাছের শিকড় মজবুত না হলে যেমন গাছটি টিকে থাকতে পারে না, তেমনি কোন দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী না হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও সমুন্নত থাকতে পারে না। কোন দেশের স্বাধীনতা অক্ষুণœ না থাকলে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণœ থাকে না, দেশের স্বাধীনতা হচ্ছে একটি গাছের মূলকাণ্ড। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, এগুলো হচ্ছে এর ডালপালা। মূলকাণ্ডটি রক্ষা না পেলে এই ডালপালাগুলো রক্ষা পায় না। বাংলাদেশে যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বার বার বিপন্ন হয়েছে তার কারণ দেশটিতে দীর্ঘকালীন সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসন। এখন এই শাসনের অবসান হলেও গণতন্ত্র এখনও শক্ত ভিত্তি পায়নি। এককালে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং এখনও যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগুলোর বিরোধিতা করছে, তারা সম্মিলিত হয়ে এই নাজুক গণতন্ত্রকে উৎখাতের চক্রান্ত চালাচ্ছে। এই চক্রান্ত যদি সফল হয়, তাহলে বিচার বিভাগ এতদিনে যেটুকু স্বাধীনতা অর্জন করেছে তাও রক্ষা পাবে না। দেশের এই পরিস্থিতিতে আমাদের বিচার বিভাগের কী করণীয় তা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। শুধু একটা কথাই বলি- আমাদের মাননীয় বিচারপতিদের দক্ষ বিচারপতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুবিবেচক হওয়ারও প্রমাণ দিতে হবে। ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কিত রায়কে সরকার মেনে নিয়েছে, সুতরাং বোঝাই যায় সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চায় না। বিতর্ক হচ্ছে প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত পর্যালোচনাগুলো নিয়ে। বর্তমানে ব্রিটেনের মতো গণতান্ত্রিক দেশেও উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে বিতর্ক হয়। বিচারপতিদের সমালোচনাও হয়। বিচারপতিরা সকল বিতর্কের উর্ধে এই কলোনিয়াল যুগের লেগাসিও বর্জিত হয়েছে। লন্ডনে একটি ধর্ষণ সম্পর্কিত মামলায় উচ্চ আদালতের এক বিচারপতির ধর্ষিতা সম্পর্কিত মন্তব্য এবং রায় নিয়ে বিরাট প্রতিবাদ দেখা দিয়েছিল। সংবাদপত্র ও পার্লামেন্টেও তার তুমুল সমালোচনা হয়। ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি ওঠে! তার রায় সংশোধিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিকে সবিনয়ে জানাই তার পর্যালোচনাগুলো নিয়ে দেশে যে বিতর্ক চলছে, জাতীয় স্ব^ার্থে তার অবসান ঘটানোর জন্য তার অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্যগুলো নিজের বিবেচনা থেকেই প্রত্যাহার করা উচিত। দেশের বর্তমান নাজুক অবস্থার কথা বিবেচনা করে প্রধান বিচারপতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ভাল করবেন। নির্বাহী ও বিচার বিভাগের এ বিবাদে আমার বড় শঙ্কা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যত নিয়ে। যে দেশে গণতন্ত্রই এখন পর্যন্ত বিপন্মুক্ত নয়, সে দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে এতটা হৈচৈ করা কি দেশের মঙ্গল ডেকে আনবে? বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্ত হতে দীর্ঘ একুশ বছর সময় লেগেছে। তারপরও গণতন্ত্র বিপদ ও আশঙ্কামুক্ত হয়নি। ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র চলেছে এবং এখনও চলছে! হত্যার রাজনীতি, সন্ত্রাসের রাজনীতি এখনও বর্তমান। দেশের নির্বাহী বিভাগ এখনও স্বৈরাচারী আমলের লেগাসিগুলো থেকে মুক্ত হতে পারেনি। বার বার এ সরকার হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এই হুমকি প্রদান সফল হলে, এই সরকারের পতন হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যেটুকুও আছে তাও বিপন্ন হবে। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বিচার বিভাগও অতীতের লেগাসি মুক্ত হয়ে তাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা লাভ করবেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি দেশের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি সম্পর্কে নিশ্চয় অবহিত আছেন। সুতরাং এই মুহূর্তে যেটুকু গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি হয়েছে তাকে রক্ষা করার ওপর গুরুত্ব দেয়া আমাদের সর্বোচ্চ আদালতেরও কর্তব্য বলে মনে করি। এই বিতর্কে যদি বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা পাবে কি? এই সরকারকে একটি রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে, ক্ষমতা থেকে অপসারণ করলে তার বিকল্পটা কি বিএনপি-জামায়াত সরকার? নাকি সুশীল সমাজের অনির্বাচিত সরকার? তারা বিচার বিভাগের বর্তমান স্বাধীনতাও অক্ষুণœ রাখবেন কি? নাকি বিচার বিভাগকে তখন নাকের বদলে নরুন পেলাম বলে আহাজারি করতে হবে? ব্রিটেন থেকে একটি তুলনা দিই। তখন হেরল্ড উইলসনের নেতৃত্বে লেবার পার্টি ক্ষমতায়। পার্লামেন্টে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল মাত্র এক ভোটের। সরকারের বিরুদ্ধে টোরি পার্টি অনাস্থা প্রস্তাব আনে। ওই দিন পার্লামেন্টে লেবার পার্টির দুজন এমপি অনুপস্থিত, সরকারের পতন অনিবার্য। ওই দিন পার্লামেন্টের স্পীকার ছিলেন টোরি দলের। যখন ভোটাভুটি শুরু হলো তখন লেবার পার্টি হারবে জেনে টোরি দলের স্পীকার এমপি হিসেবে তার একটি ভোট নিজ দলে এবং স্পীকার হিসেবে তার আরেকটি ভোট উইলসন সরকারের পক্ষে দিয়ে এ সরকারকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেন। যখন স্পীকারকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনার টোরি দল যখন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা দিয়েছে তখন তাকে সমর্থন না দিয়ে আপনি সে সরকারকে রক্ষা করলেন কেন? তিনি তার উত্তরে বলেছিলেন- ‘বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে ব্রিটেনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে সারা ইউরোপের জন্য বিপদ ঘনিয়ে আসবে। পার্লামেন্টে কোন দলেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের পতন ঘটিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারি না। স্পীকার হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে’। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার দায়িত্ব সর্বোচ্চ বিচার বিভাগেরও! তারা শুধু বিচারক নন, জাতির অভিভাবকও! এ অবস্থায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নামে দেশের বৃহত্তর স্বাধীনতার জন্য কোনও হুমকি সৃষ্টিতে তারা সহায়তায় জড়াতে পারেন না। তারা জানেন দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এখনও কারা ষড়যন্ত্রে রত এবং প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণকে তারা কিভাবে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে ব্যবহার করতে চাইছে। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণকে আমি সমালোচনা করতে চাই না। আমার কথা ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কিত রায়টি তো সরকার মেনে নিয়েছে। তার সঙ্গে এই ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণগুলো দেয়ার কী কোন দরকার ছিল? সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের কথা আমাদের দেশের কিছু শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী ও প্রবীণ রাজনীতিক এই সঙ্কটকালীন মুহূর্তে কোন গঠনমূলক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেননি। বরং প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগিয়ে সেই আগুনেই আলু পুড়িয়ে খাবার নীতি গ্রহণ করেছেন। জাতীয় সঙ্কটকালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিশপ টুটুঁ, ব্রিটেনের চার্চিল, সুইডেনের ডাগ হ্যামারশোল্ড, ভারতে সর্বপল্লী রাধা কৃষ্ণণন যে জাতীয় অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন, আমাদের দেশের বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ও আইনজীবীদের মধ্যে তাদের একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ তারা জানেন বর্তমান মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যদি ধ্বংস হয়, তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা তো দূরের কথা, দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষা করাই কঠিন কাজ হবে। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিদ্বেষে শেখ হাসিনাকে ধ্বংস করতে গিয়ে তারা গোটা দেশটাকেই ধ্বংস করতে পারেন। আরেকটি ব্যাপারে কিছু কথা বলা দরকার। সুরেন্দ্র কুমার সিনহা একজন ব্যক্তিমাত্র! তিনি সমালোচনার উর্ধে নন। কিন্তু প্রধান বিচারপতির পদটি একটি ইন্সটিটিউশন, ব্যক্তিকে সমালোচনা করতে গিয়ে আমরা যেন সীমা না ছাড়াই এবং এই ইন্সটিটিউশনটির মর্যাদা ধ্বংস না করি। আওয়ামী লীগের কিছু মন্ত্রী ও নেতা প্রধান বিচারপতির রায় সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের কোন আইনভিত্তিক সমালোচনা না করে যেভাবে ব্যক্তিগত গালাগালি করেছেন এবং করছেন তা দেশের জন্য মঙ্গল বহন করবে না। যুক্তি দিয়ে যুক্তি খণ্ডন করতে হয়। ব্যক্তিগত আক্রমণ করে নয়। প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করতে গিয়ে একশ্রেণীর মন্ত্রী ও নেতা সীমা লঙ্ঘন করেছেন। দেশে যদি কোন অঘটন ঘটে, তবে এদের দুরবিন দিয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না। শেখ হাসিনাকেই একা লড়াইয়ের ময়দানে নামতে হবে। যেমন তিনি নেমেছেন রাজনীতিতে পা দিয়েই। এই সঙ্কটকালীন মুহূর্তে যদি উভয়পক্ষই সংযত হন, তাহলেই মঙ্গল। প্রধান বিচারপতিকে দুর্নীতির মামলায় জড়ানোর বাজারে যে গুজব চলছে তা অসত্য হোক এই কামনা করি। এই মুহূর্তে ওই ধরনের পদক্ষেপ প্রতিশোধাত্মক ব্যবস্থা বলে জনগণ মনে করতে পারে এবং একটি সাধারণ নির্বাচনের আগে সরকারের জন্য তা কল্যাণকর হবে না। আবার বলছি, আমি আশা-নিরাশার দোলায় দুলছি! প্রার্থনা করি গহর রিজভীর দ্বৈতগিরি সফল হোক। দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির নতুন চক্রান্ত ব্যর্থ হোক। লন্ডন, ২৪ আগস্ট, বৃহস্পতিবার ২০১৭
×