ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সেই রিয়াদ এখন শতভাগ প্রস্তুত

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১৯ আগস্ট ২০১৭

সেই রিয়াদ এখন শতভাগ প্রস্তুত

রুমেল খান ॥ গত ২ আগস্টের পড়ন্ত বিকেল। কিছুক্ষণ পরেই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ ফুটবলের খেলা শুরু হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের গেট দিয়ে মাঠে ঢুকে প্রেসবক্সের দিকে যাবার সময় হঠাৎই পেছন থেকে কারুর ডাক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জড়িয়ে ধরলেন। তারপর করমর্দন। জানতে চাইলেন কুশল। চেহারা দেখে মনে হলো পরিচিতই। তারপরও সংশয় হচ্ছিল। সেটা আঁচ করেই হয়তো একগাল হেসে ‘আধো চেনা’ আগন্তুক নিজের পরিচয় দিলেন। এবার সংশয় পরিণত হলো মহাবিস্ময়ে। সাত মাস আগে তাকে যে চেহারায়, যে অবস্থায় দেখেছিলাম এখন তার সঙ্গে কোন মিল নেই। সঙ্গে সঙ্গেই যেন সাতমাস আগের সেই দিনটিতে (২ জানুয়ারি) ফিরে গেলাম। মানসপটে ভেসে উঠলো সব। মৃত্যুকে যিনি জয় করেন, তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। ওমর শরীফ রিয়াদের নামের আগে সন্দেহাতীতভাবেই এই শব্দটি যোগ করা যায়। ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালের মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসায় কিডনিজনিত সমস্যায় মরতে বসেছিলেন ৩০ বছর বয়সী এই ফুটবলার। ভুল চিকিৎসার কারণে শুধু ক্যারিয়ারই নয় এই কৃতী গোলরক্ষকের জীবনই হয়ে পড়ে সঙ্কটাপন্ন। ভারতে গিয়ে উন্নত ও সঠিক চিকিৎসা করে প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন হয় বেশ কয়েক লাখ টাকার। অথচ হাতে পর্যাপ্ত নেই টাকা। চোখে দেখেন ঘোর অমানিশা। হৃদয়ে বেঁচে থাকার সুতীব্র আর্তি ও বাসনা। সবমিলিয়ে একরাশ হাহাকার আর অসহায়ত্ব। ঢাকা আবাহনী, মুক্তিযোদ্ধা, ব্রাদার্স, শেখ রাসেল ও শেখ জামালের মতো বড় দলে একসময় খেলা সেই মৃত্যুপথযাত্রী রিয়াদকে নিয়ে গত ৪ জানুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘ফুটবলার রিয়াদের আকুতি’ শিরোনামে। তারপর? শুনুন তা রিয়াদের মুখেই, ‘সাতমাস আগে তো এই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই আমাকে ইন্টারভিউর সময় দেখেছিলেন আমার চেহারা কেমন ফুলে গিয়েছিল। হাঁটাচলা করতে ভীষণ কষ্ট হতো। এখন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। এজন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে লাখো শুকরিয়া। শুধু সুস্থই হইনি, আমি এখন মাঠে নেমে যে কোন প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলার জন্যও পুরোপুরি প্রস্তুত। যখন অসুস্থ ছিলাম তখন ওজন বেড়ে ৮৯ কেজি হয়ে গিয়েছিল। এখন কমে আগের মতো ৭৫ কেজিতে চলে এসেছি। দলের সঙ্গে নিয়মিত পুরোদমে অনুশীলন করি, প্র্যাকটিস ম্যাচও খেলি। ফিজিক্যালি আমি এখন শতভাগ ফিট।’ রিয়াদের কথার সত্যতা নিশ্চিত করেন ফরাশগঞ্জ ক্লাবের ইকুইপমেন্ট ম্যানেজার মানস ঘোষ বাবুরাম-ও, ‘রিয়াদের ফিটনেস এবং একাগ্রতা দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ। প্র্যাকটিস ম্যাচে তার খেলা দেখেছি। একটু জড়তা থাকলেও সেটা কেটে যাবে। আশাকরি শীঘ্রই কোচ তাকে খেলার জন্য প্রথম একাদশে ঠাঁই দেবেন।’ সুস্থ ও ফিট হয়েছেন তা চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিভাবে তা সম্ভব হলো? জনকণ্ঠে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর অনেকেই অর্থ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন রিয়াদকে। ‘বন্ধু-বান্ধবসহ অনেকেই আমাকে সাহায্য করেছেন। তাদের মধ্যে বিশেষ তিনজনের নাম না বললেই নয়। এরা হলেন জাতীয় দলের ফুটবলার মোনায়েম খান রাজু, আরিফুল ইসলাম এবং মোবারক হোসেন। এরাই আমাকে চিকিৎসার জন্য সিংহভাগ অর্থ সাহায্য করেছেন। তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তাদের এবং নিজের কিছু জমানো টাকা সম্বল করে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পাড়ি জমাই মাদ্রাজের চেন্নাই সিএনসি হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি থেকে চিকিৎসা করাই ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। আল্লাহ্র রহমতে আমার কোন অপারেশন হয়নি। ওষুধ আর বেডরেস্টেই ধীরে ধীরে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসি।’ সেই সঙ্গে আক্ষেপের স্বরে যোগ করেন, ‘ভাই, এখন বুঝি, দেশের মানুষ কেন দেশে চিকিৎসা না করিয়ে বিদেশে যায়।’ গত বছরের ৩ নবেম্বর। রিয়াদ তখন সাইফের খেলোয়াড়। হঠাৎ প্রচ- জ¦রে আক্রান্ত হন। ক্লাবের খরচেই (দুই লাখ টাকা) ধানম-ির ল্যাব এইড হাসপাতালে ৫ নবেম্বর ভর্তি হন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ (ড. মনিরুজ্জমান) জানান রিয়াদের নাকি কিডনিতে সমস্যা। অবিলম্বে ডায়ালাইসিস করাতে হবে। অথচ ডায়ালাইসিস করানোর পর আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন রিয়াদ। ল্যাব এইডের ওপর ভরসা হারিয়ে পাড়ি জমান ভারতের চেন্নাইয়ের ভেলোরে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, বাংলাদেশে মারাত্মক ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন রিয়াদ। তার কিডনিতে কোন সমস্যাই ছিল না। ওষুধ খেলেই তিনি সুস্থ হয়ে যেতেন। ভাল কিডনি ডায়ালাইসিস করানোয় রিয়াদের দুটি কিডনিই ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। যাহোক, এবার দেশে ফিরে সিএমসির চিকিৎসকদের কড়া নির্দেশ ও ফলো-আপের মধ্যে ছিলেন নেত্রকোনার আটপাড়ার ছেলে রিয়াদ। তারা বলে দিয়েছিলেন কমপক্ষে দেড় মাসের মতো বেড রেস্টে থাকতে হবে, প্রচুর জল পান করতে হবে। কোনভাবেই দৌড়ানো যাবে না। এরপর এপ্রিলের মাঝামাঝি হাল্কা রানিং করার অনুমতি পান। এর মধ্যেই শুরু হয়ে যায় নতুন মৌসুমের জন্য দলবদল। সৌভাগ্যবশত তার সুস্থতার বিষয়টি অনেক ক্লাবের জানা ছিল। ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের নজর পড়ে রিয়াদের ওপর। মূলত ক্লাবটির সহকারী কোচ আবু ফয়সাল আহমেদের আগ্রহেই সাইফ স্পোর্টিং ছেড়ে তিনি ‘লালকুঠি’ খ্যাত ফরাশগঞ্জে যোগ দেন। আবাহনী এবং জাতীয় দলের এক সময়কার প্রখ্যাত ফুটবলার আবু ইউসুফ এবার ফরাশগঞ্জের কোচ। রিয়াদের অন্তর্ভুক্তিতে সায় দেন ইউসুফও। ফরাশগঞ্জ দলবদলের সময় রিয়াদকে নিয়েছিল দলের এক নম্বর গোলরক্ষক হিসেবেই। অথচ এখনও লীগের কোন ম্যাচেই তাকে খেলানো হয়নি। কারণটা অবশ্য ব্যাখ্যা করেছেন আমিুনল হক, জিয়াউর রহমান মোস্তাক এবং মামুন খানের গোলকিপিংয়ের গুণমুগ্ধ রিয়াদ।
×