ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরাঞ্চলে পরিস্থিতির আরও অবনতি, ৭ লাখ পানিবন্দী

মধ্যাঞ্চলেও বন্যার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৬ আগস্ট ২০১৭

মধ্যাঞ্চলেও বন্যার আশঙ্কা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ উত্তরাঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে দু-একদিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের পানি স্থিতিশীল হয়ে পড়বে। এরপর নদীগুলো থেকে পানি নেমে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির আশা ব্যক্ত করেছেন তারা। তবে তারা জানান, পানি নেমে যাওয়ার পথে দেশে মধ্যাঞ্চলেও বন্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে ঢাকার আশপাশ এলাকাও বন্যাকবলিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, টঙ্গী খাল, ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গার পানি বাড়ছে তবে তা এখনও বিপদসীমার নিচে রয়েছে। এদিকে যমুনা নদী একটি পয়েন্টে পানি রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকায় সোমবার যেখানে পানি বিপদসীমার ১২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল মঙ্গলবার তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৩৩ সেন্টিমিটারে গিয়ে পৌছেচে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন প্রথম দিকে নদীগুলোর পানি যে হারে বাড়ছে এখন কিন্তু সেই হারে বাড়ছে না। পানি বৃদ্ধির এই হার অনেকটা কমে আসছে। তিনি বলেন, দু-একদিনের মধ্যে পানি স্থিতিশীল হয়ে তা কমতে শুরু করবে। তবে পানি এবং নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন এখন পর্যন্ত বন্যার যে ধরন তাতে বলা যায় বন্যার উত্তরাঞ্চলের মধ্যেই সীমাব্ধা থাকবে। প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, উজান থেকে নেমে আসার পানির কারণে উত্তরাঞ্চলেই বন্যার বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের অন্য কোন এলাকায় বন্যা হয়নি। তাই এই বন্য কোনভাবেই ’৮৮ সালের বন্যার রেকর্ড অতিক্রম করেনি। তিনি বলেন, ’৮৮ সালে বন্যা হয়েছিল সারাদেশে। সে বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এ কারণে সব নদীর পানি এক সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়ে সারাদেশে বন্যা দেখা দেখা। এছাড়া ’৯৮ সালে ভূমিকম্পের কারণে হিমালয়ের বরফ গলে সারাদেশ বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। তিনি বলেন, এবারের সে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। বড় ধরনের বন্যার কোন লক্ষণও নেই। দু-একদিনের মধ্যে পানি নেমে যাবে। ইতোমধ্যে নদীগুলো থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তিনি জানান বন্যা শুধু উত্তরাঞ্চলেই দেখা দিয়েছে। কোন ক্রমেই এবারের বন্যা ’৮৮ সালের বন্যার রেকর্ড অতিক্রম কবরে না উল্লেখ করে। এদিকে জনকণ্ঠের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৪ লাখ মানুষ। রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অপরিবর্তিত রয়েছে। হাওড়ে নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় জনদুর্ভোগ বেড়েছে। দিনাজপুরে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কমতে শুরু করেছে নদ নদীর পানি। সৈয়দপুর তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী। বিধ্বস্ত বাঁধে দুই কিশোরের মৃত্যু। বন্যার কারণে রাজশাহীতে ১৩শ’ হেক্টর ক্ষেতের ফসলে ক্ষতি হয়েছে। পুকুর ভেসেছে ১৫০। বগুড়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে কমেছে বন্যার পানি। জামালপুর দেওয়ানগঞ্জ রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। নেত্রকোনায় ৪০ গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। সিলেটে নদ নদীর পানি বাড়ছেই। ফরিদপুর ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ৩৯ সেন্টিমিটার। সিরাজগঞ্জে প্রায় আড়াই গ্রাম বন্যার পানি নিচে। নীলফামারিতে বন্যার উন্নতি হলে আরও তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নওগাঁয় পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। কুড়িগ্রাম ॥ বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পাহাড়ী ঢলের কারণে কুড়িগ্রামে ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় মঙ্গলবার ভোর থেকে চিলমারী উপজেলা শহরে পানি ঢুকছে। পানিতে তলিয়ে গেছে পুরো শহর। জেলায় নতুন করে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ। ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১০১ সে.মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। লালমনিরহাট ॥ তিস্তার পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১০০ সেমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ধরলা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অপরবর্তিত রয়েছে। তিস্তা নদীর তীরবর্তী এবং চরাঞ্চলের লোকজন ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। তিস্তা ও ধরলা নদী বন্যায় লালমনিরহাট জেলার ৫ উপজেলার ৩৫ ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার ১ লাখ ২শ’ পরিবার বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাইবান্ধা ॥ বন্যার পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ৩৮টি ইউনিয়ন বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। ওইসব ইউনিয়নের প্রায় আড়াই লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ডুবেছে ৩২ হাজার ৫৫টি। ইতোমধ্যে আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে ৬৯টি। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করেছে প্রায় ৬ হাজার মানুষ। রাজশাহী ॥ ফুলে ফেপে উঠতে শুরু করেছে রাজশাহীর পদ্মা। হঠাৎ পানি বৃদ্ধিতে প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সেই সঙ্গে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে রাজশাহীবাসী। বগুড়া ॥ যমুনার পানি ভয়াবহভাবে বেড়ে চলায় বিভিন্ন পয়েন্টে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। যমুনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাঙালী নদীর পানিও বাড়ছে। দুই নদীর নিম্নাঞ্চলের এলাকাগুলো এখন প্লাবিত। বন্যার্ত ও বাঁধের ওপরসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়া লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। দিনাজপুর ॥ বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ধীরগতিতে জেলার ৮টি উপজেলায় বন্যার পানি নামছে। সোমবার রাতে আশ্রয় কেন্দ্রে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় বন্যার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ১৭ জনে। প্রধান দুটি নদীর পানি কমলেও একটি নদীর পানি বিপদসীমার সামান্য ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিদ্যুত কেন্দ্রে পানি প্রবেশ করায় এবং অধিকাংশ এলাকা এখনও পানির নিচে ডুবে থাকায় গত ৭২ ঘণ্টা ধরে জেলার বেশিরভাগ পাড়া-মহল্লায় এখনও বিদ্যুত নেই। ঠাকুরগাঁও ॥ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় জেলার নদ নদীর পানি কমে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে বের হয়ে আসছে ভয়াবহ করুণ চিত্র। এদিকে বন্যার পানিতে নিখোঁজের তিনদিন পর মঙ্গলবার এক কলেজ ছাত্রের লাশ উদ্ধার করেছে দমকল বাহিনীর কর্মীরা। নিচু এলাকা থেকে পানি সরে না যাওয়ায় এখনও জেলার ৬৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ অবস্থান করছে। সেখানে বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় বিপাকে পড়ছেন তারা। জামালপুর ॥ যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি হু হু করে বাড়তে থাকায় জামালপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইসলামপুর উপজেলার আটটি ইউনিয়নের সবগুলো গ্রাম পানিতে ভাসছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলায় যমুনা নদীর বাম তীরের অন্তত ৩০০ মিটার বাঁধ ভেঙ্গে ৩০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। সিরাজগঞ্জ ॥ বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। দ্রুত পানি বৃদ্ধির ফলে কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালি, শাহজাদপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ২৫৬ গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই ১৫৬ আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৯০ জন বানভাসী মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ব্যাহত পানি বাড়ার খবরে নদী তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারীদের মাঝে আতংক বিরাজ করছে। নীলফামারী ॥ নদীতে পানি কমছে। টানা ৫ দিন পরে মঙ্গলবার দেখা মেলেছে চড়া রৌদ্র। এছাড়া দুদিন ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মঙ্গলবার নীলফামারী জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। তবে এখনও অনেক স্থান হতে বানের পানি নেমে যেতে না পারায় সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে বন্যার পানিতে ডুবে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ৭ জনে। নওগাঁ ॥ উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢল এবং গত কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষণে নওগাঁ সদর, ধামইরহাট, পতœীতলা, মহাদেবপুর, মান্দা ও রানীনগর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে আলমপুর, খেলনা ও আগ্রাদ্বিগুণ ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম পানিতে ভাসছে। হাজার-হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এলাকার মানুষ বাড়ি ঘর ছেড়ে বাঁধ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। রাঙ্গামাটি স্কুল, খাদ্য গুদাম, বস্তাবর বিজিবি ক্যাম্প হুমকির সম্মুখীন। শিমুলতলি বিজিবি ক্যাম্পে মঙ্গলবার দুপুরে নদীর পানি প্রবেশ করছে। সিলেট ॥ অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। সুরমা কুশিয়ারাসহ সবকটি নদীতে নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সুরমা নদীর পানি দুকূল উপচে সিলেট নগরীর নিচু এলাকায় প্রবেশ করছে। সিটি কর্পোরেশনের একটি সূত্র জানায়, বন্যার পানি নগরীর মাছিমপুর, কালিঘাট, শিবগঞ্জ, উপশহর, মেন্দিভাগ, তেররতন এলাকায় প্রবেশ করেছে। নেত্রকোনা ॥ জেলার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলায় বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও নেত্রকোনা সদর উপজেলার নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সদর উপজেলার কালিয়ারা-গাবরাগাতি, মৌগাতি, মেদনী ও ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের অন্তত ৪০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। সুনামগঞ্জ ॥ পাহাড়ী ঢল অব্যাহত থাকায় সুনামগঞ্জে বন্যার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমলেও হাওড় এলাকার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বেসরকারী হিসেবে জেলায় প্রায় সাত লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবন-যাপন কাটাচ্ছে। বন্যার পরিস্থিতির স্বাভাবিক না হওয়ায় জেলার ৯ শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে। বন্ধ রয়েছে ২৮৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
×