ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বৃষ্টি, জঙ্গীভয় উপেক্ষা করে হাজারও মানুষের ঢল ৩২ নম্বরে

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৬ আগস্ট ২০১৭

বৃষ্টি, জঙ্গীভয় উপেক্ষা করে হাজারও মানুষের ঢল ৩২ নম্বরে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা-দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক ধানম-ির বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনের লেকের পাড়। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে আসা হাজারো মানুষের ভিড়। ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনে ব্যস্ত সবাই। সেই ভিড়ের এক কোনায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দেয়ালে ঘেঁষে স্থাপন করা পূর্বের জাতির জনকের কাঁচে ঘেরা প্রতিকৃতির সামনে অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে এক অশীতিপর বৃদ্ধ অপলকে তাকিয়ে অছেন স্বাধীনতার এ স্থপতির দিকে। তার দু’চোখেই অশ্রু। এভাবেই চলল অনেকক্ষণ। কাঁদছেন কেন, জানতে চাওয়ামাত্রই অশ্রুভেজা দু’চোখ মুছেই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। নাম না বলে শুধু এতটুকু বললেন- “আমি এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক। শুধু আমি নই, লজ্জা থেকে গোটা জাতিরই কাঁদা উচিত। এ মানুষটি (বঙ্গবন্ধু) আমাদের স্বাধীন দেশ দিলেন, ভাষা দিলেন, স্বাধীন পতাকা ও মানচিত্র দিলেন। সারাজীবন শুধু কষ্টই করে গেলেন এ জাতির জন্য। অথচ আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি- এমন মহাপুরুষকে হত্যা করলাম। বাঁচতে দিলাম না তাঁর স্ত্রী-পুত্রসহ কাউকে। এ সীমাহীন লজ্জা ও কলঙ্ক বাঙালীর ললাট থেকে কোনদিনই মুছবে না।” এ রকম সাধারণ গৃহিণী, ছিন্নমূল মানুষ থেকে সব শ্রেণীর, সব বয়সের লাখ লাখ মানুষ ব্যথাতুর হৃদয়ে শ্রদ্ধা জানান জাতির পিতাকে। বিশেষ করে বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় সব হারানোর বেদনার্ত অশ্রু সবাইকে আবেগতাড়িত করে। দু’বোন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে ঘাতকের বুলেটে যে স্থানে বঙ্গবন্ধুর মতো মহাপুরুষের নিথর প্রাণ পড়ে ছিল সেখানে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে ও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ভয়াল ওই রাতের শোকাবহ স্মৃতি স্মরণ করেন। আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালীর। শোকাচ্ছন্ন নীরবতায় যেন থমকে গিয়েছিল গোটা দেশ। যেন শোকস্তব্ধ হয়ে উঠেছিল দেশের সব প্রান্তর। ৪২ বছর হয়ে গেল, এখনও মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে এতটুকু ভোলেনি কৃতজ্ঞ বাঙালী। বরং নতুন শপথে বলীয়ান হয়ে বাঙালী জাতি শনিবার ৪২ বছর আগের ভয়াল এক রাতের শোকাবহ স্মৃতি স্মরণ করেছে। কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি, কখনও বা মুষলধারে বৃষ্টি এমন বৈরী আবহাওয়ার, অন্যদিকে আত্মঘাতী বোমা হামলার আতঙ্ক- কোন কিছুই শোকার্ত মানুষের ঢল থামাতে পারেনি। এবার শোক দিবসে সর্বত্রই উচ্চারিত হয়েছে প্রধানত তিনটি দাবি। তা হলো-শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন, পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকর এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের নেপথ্যের কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচন করতে পৃথক কমিশন গঠন। এই দৃঢ় প্রত্যয় আর সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদসহ দেশবিরোধী সব ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় মঙ্গলবার পালিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস। স্মৃতিভারাতুর হয়ে এবং বিনম্র চিত্তে শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। প্রাণের অর্ঘ্যে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িকতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ ও ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় শপথও নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ব্যক্তি নামে সীমাবদ্ধ নন, তিনি একটি আদর্শ। তার আদর্শের আলো ছড়িয়ে পড়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুঞ্জয়ী। তাই ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তার আদর্শকে যে হত্যা করা সম্ভব হয় না তা আবারও চোখে আঙ্গুল দিয়ে পঁচাত্তরের ঘাতকচক্র ও নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের জানিয়ে দিল কৃতজ্ঞ জাতি। আদর্শিক বঙ্গবন্ধু যে চিরঞ্জীব- তা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া দেশের পথে-প্রান্তরে শ্রদ্ধা জানাতে আসা শোকার্ত মানুষের অস্বাভাবিক ঢল আবারও তা প্রমাণ করেছে। ৪৩ বছর হয়ে গেল এখনও কৃতজ্ঞ বাঙালী এতটুকুও ভোলেনি সেই বজ্রকণ্ঠের মহামানবকে। যিনি শুনিয়েছিলেন সেই অমর বাণী- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” শোক দিবসে রাজধানীর সব পথ মিশেছিল ৩২ নম্বরের দিকে। গন্তব্যস্থল একটাই সেটা হলো বঙ্গবন্ধু ভবন। চারদিক থেকে স্রোতের মতো মানুষ আসছে। চারপাশে শুধু কালো রঙের সমাহার। অনেকের পাঞ্জাবি ও অন্য পোশাকের রংও কালো। কেউ কেউ এসেছেন কালো গেঞ্জি পরে, কেউবা ধারণ করেছেন কালোব্যাজ। শোকের প্রতীক এ কালো রং ধারণ তার জন্য যিনি জাতিকে দিয়েছেন একটি মানচিত্র। যিনি দিয়ে গেছেন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। সেই মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কে আসেনি সেখানে। যুদ্ধাহত প্রৌঢ় মুক্তিযোদ্ধা, ঘরের মাঝে আবদ্ধ থাকা গৃহবধূ কিংবা বাবার কোলে চড়ে ছোট শিশু- সবাই এসেছিলেন জাতির জনককে নিজেদের ভালবাসার অর্ঘ্য নিবেদন করতে। ৩২ নম্বরের মতো রাজধানীর বনানীতেও ছিল একই চিত্র। সকাল সাড়ে ৭টায় প্রধানমন্ত্রী বনানীতে শায়িত শহীদদের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করার পর পৌনে ৮টায় এলাকা ত্যাগ করেন। বনানী কবরস্থানেও শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের ঢল ছিল। রাজনৈতিক দল ছাড়াও সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা, দফতর, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ১৫ আগস্টের শহীদদের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দুপুরের পর রাজধানীর সকল ওয়ার্ড, পাড়া-মহল্লায় মিলাদ মাহফিলের পর এতিম, দুস্থ ও অসহায় মানুষের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়। জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস মঙ্গলবার পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালিত হয়েছে। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা অবধি রাজধানী থেকে শুরু করে সারাদেশের পথে-প্রান্তরে, অলি-গলিতে বেজেছে জাতির জনকের সেই বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সাড়া জাগানিয়া সব দেশাত্মবোধক গান। সারাদেশের মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গীর্জাসহ সব উপাসনালয়ে বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্টের সকল শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সকালে দেশ ও জাতির পক্ষ থেকে ধানম-ির ৩২ নম্বরে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে শোকের কর্মসূচীর সূচনা করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সারাদেশই যেন শোকের লাখ লাখ কালো ব্যানার, ফেস্টুন আর পোস্টারে ঢেকে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাসভবন এবং টুঙ্গিপাড়ার মাজারস্থল হয়ে উঠেছিল শোকার্ত লাখো মানুষের মিলন-মোহনা। দিনভর কৃতজ্ঞ বাঙালীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসার পুষ্পাঞ্জলিতে ভরে উঠেছিল ধানম-ির ৩২ নম্বর জাতির জনকের প্রতিকৃতি, টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধুর মাজার এবং বনানীর ১৫ আগস্টের শহীদদের সমাধিস্থল। সকাল সাড়ে ৬টায় দেশ ও জাতির পক্ষ থেকে ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। এ সময় বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পৃথক দুটি ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের পর সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। পরে পবিত্র কোরান থেকে তেলাওয়াত করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তারা মোনাজাত করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। পরে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়াসহ ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে বঙ্গভবনের দরবার হলে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বিশেষ মিলাদ মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানম-ি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির ভেতরে যান। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের কালরাতে যে সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ পড়েছিল, সেখানে গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে দেন তিনি। পরে ওই ভবনের একটি কক্ষে বসে কিছু সময় পবিত্র কোরান তেলাওয়াত করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় আধা ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধু জাদুঘর থেকে বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে বনানী কবরস্থানে যান শেখ হাসিনা। সেখানে মা, ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ১৫ আগস্ট শহীদদের প্রতিটি কবরে গোলাপের পাপড়ি ছিটান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। সেখানে জাতির পিতার সমাধিতে প্রধানমন্ত্রী পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ শেষে সেখানে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে অংশ নেন তারা। পরে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। মোনাজাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। মোনাজাতে দেশ-জাতি এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। এ দুটি স্থানেও তিন বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল বঙ্গবন্ধুর প্রতি গার্ড অব অনার প্রদান করে। বাদ আছর বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় সব হারানোর বেদনার্ত অশ্রু সবাইকে আবেগতাড়িত করে। মা-ভাইয়ের সমাধি পাশে শোকবিহ্বল দু’বোন ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় বনানীর কবরস্থানের সারিবাঁধা ১৮টি কবর। এসব কবর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে নরপিশাচ ঘাতকচক্রের নির্মম বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে নিহত বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শিশুপুত্র রাসেলসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের। ৪২ বছর আগে ঘাতকদের বন্দুকের নলের মুখে স্বজনদের চোখের জলে শেষ বিদায়টুকু দিতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। মঙ্গলবার সকালে মা-ভাইদের কবরে গিয়ে চোখের জল থামিয়ে রাখতে পারেননি একসঙ্গে স্বজনহারা শোকবিহ্বল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তারা অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রিয় স্বজনদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে মোনাজাত ও ফাতেহা পাঠ করেন। জাতির পিতার জীবিত দুই কন্যা নিজ হাতে মুঠো মুঠো ভালবাসার ফুল ছড়িয়ে দেন প্রিয় স্বজনদের কবরে। নেতাকর্মী, মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বনানী কবরস্থানে গেলে সেখানে এক অন্যরকম আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সকাল থেকেই সেখানে চলছিল শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনায় কোরানখানি ও দোয়া মাহফিল। প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে একে একে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শহীদদের কবরে শ্রদ্ধা জানান। বঙ্গভবনে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে বঙ্গভবনের দরবার হলে অনুষ্ঠিত মিলাদে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ অংশ নেন। মিলাদ শেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে নৃশংসভাবে নিহত বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্যরাসহ বঙ্গভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলাদে অংশ নেন। বঙ্গভবন মসজিদের পেশ ইমাম সাইফুল কবীর মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। এর আগে দরবার হলে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচীর ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের তৈরি প্রামাণ্য চিত্র ‘সোনালি দিনগুলি’ প্রদর্শিত হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য স্থানটি উš§ুক্ত করে দেয়া হয়। পরে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, যুবলীগ মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এছাড়া জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবার, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, জাতীয় প্রেসক্লাব, বিএফইউজে, ডিইউজেসহ অজস্র সংগঠন দিনভর জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শেরে বাংলানগরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রণালয়টির সচিব আখতার হোসেন ভূঁইয়া। এ সময় জাতির পিতার ওপর নির্মিত ৩৪ মিনিটের একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। আলোচনা শেষে বিশেষ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-এ (বিইউপি) দিনব্যাপী কোরান খতম, মিলাদ মাহফিল, বিশেষ মোনাজাত, রক্তদান কর্মসূচী, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ এমপি ও বিশেষ অতিথি ছিলেন বিইউপির উপাচার্য মেজর জেনারেল মোঃ সালাহ উদ্দিন মিয়াজী, আরসিডিএস, পিএসসি। এছাড়া বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ভাতা ভোগী হুইল চেয়ারধারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য ও ট্রাস্টের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে জাতির পিতার জীবনী নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রামী ঐক্য পরিষদ জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শোক মিছিল ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। কমিটির সভাপতি এস এম গোলাম মোস্তফা কামাল, সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান ও সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হাসান মাসুদ এতে নেতৃত্ব দেন।
×