ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের রিপোর্ট

অসুস্থদের মধ্যে ৬১ শতাংশই অসংক্রামক রোগী

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ১২ আগস্ট ২০১৭

অসুস্থদের মধ্যে ৬১ শতাংশই অসংক্রামক রোগী

নিখিল মানখিন ॥ বাংলাদেশে গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু হ্রাসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হলেও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত এক্ষেত্রে শিশু ও নারীর জন্য এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত সেবা নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে অবকাঠামোগত সুবিধা এবং রোগীর চাহিদা অনুযায়ী যথাযথ সেবার প্রস্তুতি নেই। বর্তমানে অসুস্থ মানুষের ৬১ শতাংশই অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত । দেশের ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ৯৭ শতাংশের কমপক্ষে একটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি আছে। আর এই জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের আছে দুটি রোগের ঝুঁকি। অনেক অসংক্রামক রোগের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশে নেই। পাশাপাশি এসব রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। তাই অনেক অসংক্রামক রোগীকে চিকিৎসার অভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। এসব রোগ মোকাবেলায় কোন জাতীয় দিক নির্দেশনা নেই। ‘বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ রিপোর্ট ২০১৬’-তে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করে জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ। গত বৃহস্পতিবার গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আলোকে এই রোগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরা হয়। সেগুলো হচ্ছে: অসংক্রামক রোগের সেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা হিসেবে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত না করা, অকার্যকর নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং জাতীয় পর্যায়ে সমন্বয়ের অভাব এবং এই রোগ পর্যবেক্ষণে গ্রাম ও শহর ভিত্তিক সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে তথ্য অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় পর্যায়ে কার্যকর তথ্যভা-ার না থাকা ইত্যাদি। প্রতিবেদনটিতে এসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় করণীয় হিসেবে প্রধানত পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো - অসংক্রামক রোগের ব্যাপকতা ও গুরুত্বের ওপর নীতিনির্ধারক এবং পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা দরকার। রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বিভিন্ন সেক্টরকে কেন্দ্র করে একটি সমন্বিত পদ্ধতির প্রবর্তন করতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় জনশক্তি ও কাঠামোগত উন্নয়ন, ঝুঁকির কারণ সংশোধন ও নিয়ন্ত্রণ, রোগ শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সকল পর্যায় শক্তিশালী করতে হবে। চারটি প্রধান অসংক্রামক রোগের জন্য চলমান এবং ভবিষ্যত কর্মসূচীসমূহ তদারকি ও পর্যালোচনার জন্য জাতীয় পর্যায়ে সামগ্রিক তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা এবং নিবন্ধীকরণ পদ্ধতি চালু করা দরকার। আর সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আলোকে দক্ষতার সঙ্গে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা (গবেষণা) করতে হবে। সংক্রামক রোগগুলোর চিত্র অসংক্রামক রোগের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, কিডনি, লিভার ও ফুসফুস সমস্যা, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা এখনও অপ্রতুল। চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসা বিশ্বের কোথাও নেই। চিকিৎসা করাতে না পেরে এ রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুর অস্বাভাবিক হারে খোদ চিকিৎসকরাও চিন্তিত হয়ে পড়ছেন। চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেলেও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও মেডিক্যাল উপকরণ এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে ক্যান্সারের চিকিৎসা। দেশের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। প্রতিবছর প্রয় তিন লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আর বছরে মারা যায় প্রায় দেড় লাখ রোগী। সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশে বছরে ৫০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা সেবার আওতায় নিয়ে আসা গেলেও আড়ালে থেকে যায় আরও আড়াই লাখ রোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, জনসংখ্যার অনুপাতে বর্তমানে দেশে সব ধরনের সুবিধাসংবলিত ১৫০টি ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে এখন এমন কেন্দ্রের সংখ্যা আছে মাত্র ১৮টি। আমাদের ৩০০টি লিনাক মেশিনের প্রয়োজন। আছে মাত্র ১৪টি আবার এর সবই কার্যকর নয়, বেশিরভাগই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ক্যান্সার শনাক্তকরণে ভুল তথ্য দিয়ে থেরাপি ব্যবসার অভিযোগ উঠেছে। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্যান্সার একটি সমন্বিত চিকিৎসা। সার্জারি, কেমো ও রেডিওথেরাপি কখন, কোন্টি, কীভাবে করতে হবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অপারেশনের ছয় মাস পর কেমো নিলে ফলপ্রসূ হবে না। শুধু ভাল চিকিৎসক থাকলেই হবে না; এর সঙ্গে প্যারামেডিক, নার্স ও অন্যান্য সহযোগী মানবসম্পদ থাকতে হবে। কোন ওষুধ ৮ ডিগঈ, কোনটি ২৫ ডিগ্রী সে?লসিয়াস তাপমাত্রায়, আবার কখনও সূর্যের আলোর বাইরে রাখতে হয়। এ জন্য ভাল ফার্মাসিস্টের প্রয়োজন হয়। যারা ওষুধ লিখবেন তাদের দক্ষতা থাকতে হয়। ওষুধ প্রয়োগের আগে প্রস্তুত করতে হয়। ওষুধ প্রস্তুত, কেমো ও রেডিওথেরাপি দেয়ার কাজগুলো অনকোলজিস্টরা করেন। দেশে অনকোলজিস্টের স্বল্পতা রয়েছে। অনকোলজিস্ট বাড়াতে হবে। দেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা যা বলা হচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যা তার থেকে অনেক বেশি হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, প্রতি ১০০ রোগীর জন্য একজন করে অনকোলজিস্ট থাকা দরকার। দেশে বর্তমানে ১ হাজার ২০০ ক্যান্সার রোগীর জন্য একজন অনকোলজিস্ট। ভারতে ৬৬৪ ও পাকিস্তানে ১ হাজার ৪০০ জনের জন্য একজন অনকোলজিস্ট। দেশে কিডনি রোগী দেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোন না কোন ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে। আক্রান্তের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগী কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে এ মরণব্যাধির অস্তিত্ব ধরতে পারেন না। কিডনি বিকল রোগীর চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, মাত্র শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ লোকের চিকিৎসা চালিয়ে যাবার সামর্থ্য আছে। দেশে প্রতিবছর ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়। প্রতিবছর কিডনিজনিত রোগে প্রায় ৪০ হাজার লোক মারা যায়। দেশে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট হয়েছে উঠেছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ মোট রোগীর শতকরা ২ ভাগ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। অন্যরা নিজেদের মতো চেষ্টা করে রোগী নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। বাকিরা ডায়ালিসিস দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও বিভিন্ন কারণে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনিদাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সঙ্কট। আইনী জটিলতাসহ অনাকাক্সিক্ষত নানা ঘটনার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা। কিডনি বিকল রোগীদের নিয়ে কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী নিম্নমানের ডায়ালিসিস ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ব্যাপক কিডনি রোগীর তুলনায় ডায়ালিসিস সেন্টার খুবই কম মাত্র ৯৬ টি এবং ১৮ হাজার রোগী এসব সেন্টারে সপ্তাহে ২ বার করে ডায়ালিসিস পায়। দক্ষিণ এশিয়ায় মোট কিডনি রোগীর তুলনায় মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী ডায়ালিসিসের সুযোগ পায়। বাকি অসংখ্য রোগী অর্থাভাবে ডায়ালিসিস করাতে পারে না। এ সুযোগে কিডনি বিকল রোগীদের কাছ থেকে নানা কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। মফস্বল এলাকা থেকে আগত রোগীরাই এমন ফাঁদে বেশি পড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ডায়াবেটিস বাংলাদেশসহ সারাবিশে¡ ডায়াবেটিস এখন মহামারী হয়ে উঠছে। বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৪১ কোটি। দেশে প্রায় ৭১ লাখ, বছরে বাড়ছে আরও ১ লাখ রোগী। শুধু ডায়াবেটিসের কারণে বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু হয়। বিশ্বের সর্বত্র বয়সী মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত ও ওসব রোগের আক্রমণের পথ প্রশস্ত করে ডায়াবেটিস। কেবল ডায়াবেটিসের জটিলতা কমাতে পারলে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতেই বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় কমানো সম্ভব বলে মনে করছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ৬৪ কোটি ২০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
×