ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাস্টার কার্ডে অর্থ পাচার ॥ বিদেশী প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১১ আগস্ট ২০১৭

মাস্টার কার্ডে অর্থ পাচার ॥ বিদেশী প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ অর্থপাচার ঠেকাতে বাংলাদেশে মাস্টার কার্ডের ব্যবসায় জড়িত বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ভুয়া এ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে বিদেশে অর্থপাচারের পথ সুগম করে দেয়ার তথ্য মিলেছে। যে ব্যক্তির বাংলাদেশের কোন ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট নেই, তার নামে বিদেশী কোন কোম্পানি কর্তৃক মাস্টার কার্ড ইস্যু না করার বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। পুরো বিষয়টি মনিটরিং করতে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগে বিদেশে যাতায়াতকারীদের মাস্টার কার্ড চেকিং করার চিন্তাভাবনা চলছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই এদেশে মাস্টার কার্ডের ব্যবসায় জড়িত বিদেশী কোম্পানিগুলোকে ডাকা হবে। কোম্পানিগুলোর ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোম্পানিগুলোর যাবতীয় কর্মকা-ের ফিরিস্তি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হবে। ভুয়া তথ্য দিয়ে মাস্টার কার্ড তৈরি করে বিদেশে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত পাঁচ জনকে গ্রেফতারের পর এমন চিন্তাভাবনা চলছে। গ্রেফতারকৃতদের একদিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে মাস্টার কার্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি পুলিশের সংঘবদ্ধ অপরাধ তদন্ত বিভাগ। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র আসকার ইবনে ইসহাক শাকিল (২৪), ঢাকা কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রিয়াজুল ইসলাম ওরফে ইমরান (২২), ২০১৫ সালে সরকারী তিতুমীর কলেজের মার্কেটিং বিভাগ থেকে পাস করা সৈয়দ মেহেদী হাসান (২৯), ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী জহিরুল হক (২৫) ও কেরানীগঞ্জের বিকাশ ও ফ্ল্যাক্সিলোডের ব্যবসায়ী হায়দার হোসেন (৩০)। তাদের কাছ থেকে ১৪১টি মাস্টার কার্ড ও নগদ নয় লাখ সাড়ে ২১ হাজার টাকা, ইসলামী ব্যাংকের সিল, ৩২টি ব্যাংক চেকসহ অনেক আলামত উদ্ধার হয়। সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলছেন, গ্রেফতারকৃতরা প্রথমে ভুয়া নাম ঠিকানা ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরসহ প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে অনলাইনে এ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আবেদন করে। এ্যাকাউন্ট খোলার পর তা সচল করে। ওই এ্যাকাউন্টে অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা স্থানান্তরসহ ক্রয়-বিক্রয় করতে থাকে। পরবর্তীতে তারা অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে মুদ্রা পাচারকারীদের কাছে ডলার ক্রয়-বিক্রয় শুরু করে। এছাড়া তারা অবৈধ প্রি-পেইড মাস্টার কার্ড তৈরি করে। এই প্রি-পেইড মাস্টার কার্ড তৈরির জন্য অনলাইনে তারা আবেদন করে। আবেদনে তারা ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে। ওইসব কার্ড তৈরি করে দেয়ার সঙ্গে জড়িত কয়েকটি বিদেশী কোম্পানি। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে স্ক্রিল, পাইওনিয়ার, নেটেলার ও ফাস্ট চয়েজ। এছাড়াও বাংলাদেশে মাস্টার কার্ডের ব্যবসার আড়ালে অর্থপাচারের প্লাটফর্ম হিসেবে পেপাল, পারফেক্ট মানি, ওয়েব মানি ও বিট কয়েন নামের কয়েকটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান কাজ করছে বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে যে ১৪১টি প্রি-পেইড মাস্টার কার্ড উদ্ধার হয়েছে, তা পাইওনিয়ার কোম্পানির মাধ্যমে তৈরি যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে এসেছে বলে তথ্য মিলেছে। এসব কার্ড কুরিয়ার সার্ভিস ও ডাকযোগে পাঠানো হয়। এসব কুরিয়ার সার্ভিসের বেশকিছু অসাধু কর্মকর্তা রয়েছে। তারা এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। যারা এসব প্রি-পেইড মাস্টার কার্ড তৈরি করার জন্য বিদেশে তালিকা পাঠায়, ওই চক্রটি তাদের একটি নামীয় তালিকা কুরিয়ার সার্ভিস বা পোস্ট অফিসের সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তার হাতে আগাম দিয়ে আসে। কার্ডগুলো আসা মাত্রই সেগুলো চক্রের সদস্যরা নিয়ে যায়। এজন্য কুরিয়ার সার্ভিস ও পোস্ট অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বাড়তি আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকে। এসব প্রি-পেইড মাস্টার কার্ড তৈরির ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বিদেশী কোম্পানিগুলো চাহিদা মোতাবেক মাস্টার কার্ড তৈরি করে চক্রের দেয়া ঠিকানা মোতাবেক পাঠিয়ে দেয়। এসব নামে কোন ব্যক্তি বাংলাদেশে আছে কিনা বা কোন ছিল কিনা সে তথ্যের প্রয়োজন নেই। যার নামে মাস্টার কার্ড তৈরি হলো, তার পরিচয় নিশ্চিত করার প্রয়োজন নেই। কার্ডে পাচারকারীদের চাহিদা মোতাবেক বৈদেশিক মুদ্রা রিচার্জ করে দেয়া হয়। সেই কার্ড মানিব্যাগে ভরে বা পকেটে করে বিমানবন্দর দিয়ে অনায়াসে মুদ্রা পাচারকারীরা তাদের নির্দিষ্ট দেশে (যে দেশে অর্থ পাচার করবে) চলে যান। ধরা পড়ার ন্যূনতম কোন আশঙ্কাই থাকছে না। কারণ অর্থপাচারকারী নগদ অর্থপাচার করছে না। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগ মাস্টার কার্ড, এটিএম কার্ড বা এ ধরনের ব্যবহার্য সামগ্রী তেমন আমলে নেয় না। আর মাস্টার কার্ড কম্পিউটারে চেকিং করে তাতে কত অর্থ আছে বা দেশে ফেরার পর খরচ শেষে কত অর্থ মাস্টার কার্ডে রয়েছে তা জানার কোন প্রয়োজনীয়তা মনে করে না। মোল্যা নজরুল বলছেন, এমন সুবিধার কারণে অর্থপাচারকারীরা এক বা একাধিক প্রি-পেইড মাস্টার কার্ড নিয়ে বিমানবন্দর দিয়ে অন্য দেশে গিয়ে অর্থপাচার করে দিয়ে আবার দেশে ফিরছে। বিষয়টি কারও নজরেই আসছে না। সেই দেশে যাওয়ার পর দ্রুত অর্থ মাস্টার কার্ড থেকে নির্দিষ্ট এ্যাকাউন্টে বা সুবিধাজনক এ্যাকাউন্টে বা কারও নামে থাকা এ্যাকাউন্টে হস্তান্তর করছে। আবার অনেকে ক্যাশ টাকাও তুলে গচ্ছিত করে রেখে আসছে। বিষয়টি অনেকটাই এদেশে ব্যবহৃত এটিএম কার্ডের মতো। যে কারও এটিএম কার্ডের গোপন পিন নম্বর জানা থাকলে যেমন টাকা তোলা সম্ভব, তেমনকি মাস্টার কার্ডের পিন নম্বর জানা থাকলে যে কোন ব্যক্তি টাকা স্থানান্তর বা অর্থ উত্তোলন করতে পারেন। এক্ষেত্রে যার নামে কার্ড তৈরি হয়েছে এবং যিনি কার্ড ব্যবহার করে অর্থ তুলছেন, সেই ব্যক্তি এক না হলেও কোন সমস্যা নেই। বরং পাচারকারীদের জন্য এটি বাড়তি সুবিধা। কারণ যিনি অর্থপাচার করছেন, তিনি আড়ালেই থেকে যাচ্ছেন। বেনামে অর্থ পাচার হচ্ছে। কারণ যে কার্ড দিয়ে অর্থপাচার হচ্ছে, সেটি পাচারকারীর নামে নয়। এজন্য শত চেষ্টা করেও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বেনামে তৈরি মাস্টার কার্ডের মাধ্যমে অর্থপাচার ঠেকাতে পারছে না। গ্রেফতারকৃতরা গত এক বছরে এভাবেই কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করতে সহায়তা করেছেন। পাচারকারীদের শনাক্ত করতে গ্রেফতারকৃতদের কড়া জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, এজন্য বাংলাদেশে মাস্টার কার্ডের ব্যবসায় জড়িত বিদেশী কোম্পানিগুলোকে নজরদারির আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশে মাস্টার কার্ডের অবৈধ ব্যবসায় জড়িত বিদেশী কোম্পানিগুলোর তালিকা তৈরির কাজ চলছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাদের ডাকা হবে। কোম্পানিগুলোর কাছে তাদের কর্মকা-ের প্রক্রিয়া সর্ম্পকে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা পাচার নিয়ন্ত্রণ বিভাগসহ উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশে মাস্টার কার্ডের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বিদেশী কোম্পানিগুলোর ওপর শতভাগ সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে যাদের নামে বাংলাদেশের কোন ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট নেই, তাদের নামে কোন প্রকার মাস্টার কার্ড ইস্যু না করার বিষয়ে কড়াকড়ির আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। অবশ্যই বিদেশী কোম্পানিকে বাংলাদেশী কারও নামে মাস্টার কার্ড ইস্যু করতে হলে কোন না কোন বাংলাদেশী ব্যাংকের লিংক দিতে হবে। অর্থাৎ যার নামে মাস্টার কার্ড তৈরি হবে, অবশ্যই ওই ব্যক্তির বাংলাদেশের কোন না কোন ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। সেই এ্যাকাউন্টে থাকা তথ্যাদি সঠিক কিনা তা যাচাই-বাছাই শেষেই তার নামে মাস্টার কার্ড ইস্যু করতে পারবে। বর্তমানে বিমানবন্দরে থাকা ইমিগ্রেশন বিভাগ কোন বিদেশগামী ব্যক্তি কত অর্থ মাস্টার কার্ডে ভরে নিয়ে যাচ্ছেন, সাধারণত তার কোন হিসেবে রাখে না। অর্থপাচার ঠেকাতে ইমিগ্রেশন বিভাগে মাস্টার কার্ডধারীদের কার্ডে থাকা অর্থের পরিমাণ বিদেশ যাওয়ার আগে এবং বিদেশ থেকে ফেরার পথে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।
×