ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সুপ্রীমকোর্ট থেকে পাঠানো নথিপত্র যাচাই বাছাই এবং অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার রিপোর্টের পর পরবর্তী পদক্ষেপ

বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ॥ অবশেষে দুদকে নথি

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৯ আগস্ট ২০১৭

বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ॥ অবশেষে দুদকে নথি

আরাফাত মুন্না ॥ অবশেষে আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনসংক্রান্ত নথিপত্র দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠিয়েছে সুপ্রীমকোর্ট। এসব নথির মধ্যে তার সার্ভিস বুক এবং জীবনবৃত্তান্তও রয়েছে বলে জানা গেছে। দুদক সূত্র বিষয়টি জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছে। সূত্র জানায়, নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে এবং অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার রিপোর্টের পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এর আগে এ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে দুদককে বাধা দেয়া হয়েছিল। আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেয় দুদক। তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে। বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে অনুসন্ধানের স্বার্থে গত ২ মার্চ সুপ্রীমকোর্টের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়ে চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। এর জবাবে গত ২৮ এপ্রিল আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দুদকে পাঠায় সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন। ওই চিঠিতে বলা হয়, বিচারপতি জয়নুল আবেদীন দীর্ঘকাল বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপীল বিভাগের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনকালে তিনি অনেক মামলার রায় প্রদান করেন। অনেক ফৌজদারি মামলায় তার প্রদত্ত রায়ে অনেক আসামির ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দেয়া রায় সবার ওপর বাধ্যকর। এমন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আদালতের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তার দেয়া রায়সমূহ প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং জনমনে বিভ্রান্তির উদ্রেক ঘটবে। সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোন রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমীচীন হবে না মর্মে সুপ্রীমকোর্ট মনে করে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। দুদক সূত্র জানায়, চিঠি পাওয়ার পর তা যাচাই-বাছাইও করেছে দুদক। চিঠি পাওয়ার পর তা কমিশনের সভায় উপস্থাপন করা হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠিটির সঠিকতা সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয় ওই সভায়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চিঠির সঠিকতা যাচাই করে তা আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তীরই বলে নিশ্চিত হয় দুদক। এ বিষয়ে দুদকের একটি নথিতে বলা হয়েছে, ‘পত্রটি স্বাক্ষরকারী অরুনাভ চক্রবর্তী মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতির অনুমোদন ও নির্দেশক্রমে প্রেরিত পত্রটিতে তার স্বাক্ষর সঠিক।’ এ বিষয়ে দৈনিক জনকণ্ঠে গত ৫ ও ১৭ জুন ‘সাবেক বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের বাধা!’ এবং ‘সাবেক এক বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে থেমে নেই দুদক’ শিরোনামে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন যুক্ত করে আগাম জামিনের আবেদন করেন সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীন। পরে হাইকোর্ট তাকে জামিন দেয়। এরপর এ জামিন আবেদনের বিরুদ্ধে দুদক আপীল বিভাগে গেলে সেখানেও তার জামিন বহাল থাকে। একই সঙ্গে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের জামিনের বিষয়ে জারি করা রুল দ্রুত নিষ্পত্তির আদেশ দেয় আপীল বিভাগ। এদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রীমকোর্টের দেয়া রায় নিয়ে গত ৯ জুলাই সংসদে ক্ষোভ প্রকাশের মধ্যে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের প্রসঙ্গটিও আসে। জনকণ্ঠের ওই প্রতিবেদনগুলো উদ্ধৃত করে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করতে গিয়ে এ বিষয়টি তুলে ধরে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘ওই চিঠি দেয়ার মাধ্যমে বিচারপতি এস কে সিনহা ন্যায়বিচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন, যা দ-বিধির অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি সুপ্রীমকোর্টের নাম শুধু ব্যবহারই করেননি, তিনি সুপ্রীমকোর্টের প্যাড ব্যবহার করেছেন, যদিও এটা ছিল তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত।’ এর আগে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিষয়ে দুদকের তদন্ত করা সমীচীন নয়- এমন চিঠি সুপ্রীমকোর্ট থেকে পাঠানোর পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তিনি বলেন, সাবেক বিচারপতির দুর্নীতির তদন্ত বন্ধের সুপ্রীমকোর্টের দেয়া চিঠির নির্দেশনা মানতে দুদক আইনত বাধ্য নয়। আইনের চোখে সবাই সমান। যে কোন অভিযোগের বিষয়েই দুদক তদন্ত করতে পারবে, দুদক আইনে তাই বলা আছে। আরেক সাবেক প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলামও বলেছেন, আইনের চোখে সবাই সমান। সুপ্রীমকোর্ট থেকে নথিপত্র পাঠানোর বিষয়ে মঙ্গলবার দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব আবু মোঃ মোস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। অনুসন্ধানের স্বার্থে আমরা সুপ্রীমকোর্টের কাছে কিছু কাজ চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বলেন, শুরুতে সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে দুদকের তদন্ত করা সমীচীন হবে না বলে জানিয়েছিল। তবে সম্প্রতি বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে আমরা যেসব নথি চেয়েছিলাম, সুপ্রীমকোর্ট তা পাঠিয়েছে। তিনি আরও বলেন, তার বিষয়ে আমাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার বক্তব্য এবং এসব নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উল্লেখ্য, মোঃ জয়নুল আবেদীন ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে ২০০৯ সালে আপীল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসরে যান তিনি। আলোচিত এ বিচারপতি ২০০৪ সালে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টাও করেছিলেন বলে জানা গেছে। আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেয় দুদক। দুদকের দেয়া নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ২০১০ সালের ২৫ জুলাই হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও করেছিলেন। রিটের ওপর শুনানি গ্রহণের পর বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দেয়। ওই সময় দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রিট খারিজের ফলে এখন দুদকের দেয়া নোটিসের ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণে আর কোন আইনগত বাধা নেই। সম্পদ বিবরণী চেয়ে গত ১৮ জুলাই দুদক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনকে নোটিস দিয়েছিল বলে তিনি জানান। রিট দায়েরকারীর আইনজীবী আহসানুল করিম ওই সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনাকে দুদক সম্পদের বিবরণী চেয়ে নোটিস দেয়। ওই নোটিস দেয়ার প্রক্রিয়া আইনানুগ হয়েছে বলে আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত রয়েছে। আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত হাইকোর্টের জন্য মানা বাধ্যকর। এ যুক্তিতে আদালত রিটটি উপস্থাপন করা হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দেয়।
×